মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

রাবণ সীতাকে অপহরণ করলেও অসম্মান করেননি

সাইফুর রহমান

রাবণ সীতাকে অপহরণ করলেও অসম্মান করেননি

সনাতন ধর্মের প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণের চারটি প্রধানতম চরিত্র হচ্ছে-রাম, রাবণ, সীতা ও লক্ষ্মণ। পাঠকবৃন্দদের মধ্যে হয়তো অনেকেই জানেন বিবাহের পর রাম তাঁর ভার্যা সীতা ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে গমন করেন সেখানে তাঁরা চিত্রকূট নামক পর্বতের পাদদেশে বসবাস করছিলেন। বছর দশেক এদিক সেদিক ঘুরেফিরে তাঁরা আশ্রয় নিলেন গোদাবরী নদীর তীরে পঞ্চবটী নামক একটি অরণ্যে। এই অরণ্যধামটি সীতার বিশেষ পছন্দ হওয়াতে আপাতত সেখানেই থিতু হলেন তাঁরা। সেখানে তাঁদের দিন ভালোই কাটছিল বলা চলে কিন্তু হঠাৎ একদিন রাবণের ভগিনী শূর্পণখা সেই বনে বেড়াতে এসে সাক্ষাৎ পেলেন রাম ও লক্ষ্মণের। সুন্দরী রমণীর ছদ্মবেশে রাম ও লক্ষ্মণকে প্রলুব্ধ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন শূর্পণখা। ক্রোধে অন্ধ হয়ে শূর্পণখা সীতাকে ভক্ষণ করতে গেলে লক্ষ্মণের খড়গাঘাতে নাক কাটা গেল শূর্পণখার। শূর্পণখার অপর দুই রাক্ষস ভ্রাতা খর ও দূষণ এই সংবাদ পেয়ে সসৈন্যে রাম ও লক্ষ্মণকে আক্রমণ করলেন। সৈন্য সামন্তসমেত খর ও দূষণ উভয়কেই বধ করলেন রাম। রাবণ এই সংবাদ পেয়ে ভগিনীর অপমানের প্রতিশোধকল্পে সীতাকে অপহরণ করার পরিকল্পনা করলেন। এই কাজে রাবণকে সাহায্য করলেন মারীচ নামে এক মায়াবী রাক্ষস। মারীচ স্বর্ণমৃগ ছদ্মবেশ ধারণ করে সীতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। হরিণটির রূপে মোহিত হয়ে সীতা রামকে বললেন, আমার সোনার হরিণ চাই। সীতার মন রক্ষার্থে হরিণটির পিছন পিছন ছুটলেন রাম। খানিকবাদে সীতা শুনতে পেলেন, রাম আর্তচিৎকার করছেন। আসলে মায়াবী মারীচ রামের কণ্ঠ নকল করে আর্তনাদ করেছিল। ভীত হয়ে সীতা লক্ষ্মণকে রামের সন্ধানে যেতে অনুরোধ করলেন। রাম যে অপরাজেয় সে কথা সীতাকে বারংবার মনে করিয়ে দিলেন লক্ষ্মণ। কিন্তু সীতা সে কথায় কর্ণপাত না করে লক্ষ্মণকে বাধ্য করলেন রামকে অনুসরণ করতে। অবশেষে কুটিরের চারদিকে একটি গন্ডি কেটে সীতাকে সেই গন্ডির বাইরে যেতে নিষেধ করে লক্ষ্মণ গেলেন রামের সন্ধানে। রাবণ এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি ঋষির ছদ্মবেশে এসে সীতার নিকট ভিক্ষা প্রার্থনা করলেন। রাবণের ছলনা বুঝতে না পেরে সীতা গন্ডির বাইরে এসে তাকে ভিক্ষা দিতে গেলে দুষ্ট রাবণ বলপূর্বক সীতাকে অপহরণ করে নিজ পুষ্পক বিমান রথে তুলে পালিয়ে গেলেন লঙ্কায়।

রাবণ ছিলেন অসীম শক্তির অধিকারী। তিনি দেবতাদেরও ছাড়তেন না। তিনি তাদেরও আহ্বান করতেন সম্মুখ সমরে। প্রথম জীবনে রাবণ শিবের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে পরবর্তীতে শিবের ভক্ত হয়েছিলেন। রাবণের প্রকৃত নাম দশানন/দশগ্রীব। রাবণ নামটিও দেবতা শিবের-ই দেওয়া। কিন্তু সীতাকে কেন স্পর্শ করেননি রাবণ? সংগীত রচনায় নিপুণ রাবণ ছিলেন শিবের পরম ভক্ত। সার্বক্ষণিক শিবের সান্নিধ্য পাওয়ার লক্ষ্যে রাবণ যখন কৈলাশ পর্বতকে লঙ্কায় প্রতিস্থাপনের জন্য দুই হস্তে কৈলাশ পর্বত তুলে নেন তখন শিব তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি কৈলাশে স্পর্শ করলে রাবণের দুই হাত কৈলাশ পর্বতের নিচে চাপা পড়ে যায়। রাবণ তখন প্রচ- জোরে চিৎকার করতে থাকেন। অতি উচ্চ মাত্রায় রোদন করার জন্যই তার নাম হয়ে যায় রাবণ। শিবকে শান্ত করার নিমিত্তে তিনি একটি সংগীত রচনা করেন, যা পরে ‘শিব তান্ডব স্তোত্র’ নামে পরিচিতি লাভ করে। শিবের ক্রোধ শান্ত হয় এবং তিনি তার চন্দ্রোহাশ নামক খড়গটি রাবণকে উপহার দেন।

রামায়ণ যারা পড়েছেন তারা বেশ ভালো করেই জানেন রাবণ একজন কামুক ও ধর্ষক হিসেবে বিশেষ খ্যাত হয়ে আছেন মহাকাব্যের পাতায় পাতায়। এক দিন পুষ্পক বিমানে ভ্রমণকালে বেদবতী নামে পরমাসুন্দরী এক নারীকে বিষ্ণুর উপাসনায় রত দেখে কামার্ত হয়ে পড়েন রাবণ। ওই নারীর চুলের মুঠি ধরে তাঁকে অপহরণের চেষ্টা করার সময় অগ্নিতে সমর্পণ করে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করেন বেদবতী। এক বছরেরও অধিক কাল সীতা রাবণের কুক্ষিগত থাকলেও সীতার সম্ভ্রমহানি করেননি কেন? এর উত্তর রামায়ণে না পাওয়া গেলেও সনাতন ধর্মের আরেকটি মহাকাব্য মহাভারত থেকে জানা যায়, দিগি¦জয় কালেই স্বর্গে পৌঁছে রাবণ রম্ভা নামক এক অপ্সরাকে দেখে মুগ্ধ হন। বাসনা চরিতার্থে তিনি জোর করে ধর্ষণ করেন রম্ভাকে। রম্ভা ছিলেন রাবণের সৎ ভাই কুবেরের পুত্র নলকুবেরের স্ত্রী। সেই হিসেবে রম্ভা রাবণের পুত্রবধূসমা। সে কথা রাবণকে স্মরণ করিয়ে দেন রম্ভা। ঠিক সে সময় নলকুবেরও উপস্থিত হন সেখানে এবং রাবণকে অভিশাপ দেন। নলকুবের রাবণকে বলেন, যদি সে আবার অন্য কোনো মেয়েকে ধর্ষণ করে তাহলে তার মাথা বিস্ফোরিত হবে। সেই অভিশাপের ভয়েই সীতাকে স্পর্শ করেননি রাবণ।

প্রতিদিন পত্রিকার পাতা উল্টালেই শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ। সিলেটে গৃহবধূকে তার স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণ, আশুলিয়ায় গৃহবধূকে গণধর্ষণ। কয়েক দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম সিঁধকেটে ঘর থেকে শিশুকন্যাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ। ধর্ষকরা যেন আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সময়কেও অতিক্রম করে গেছে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে যে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হলো, নির্যাতন চলাকালীন সেই নারী আকাশ-পাতাল বিদীর্ণ করে চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আব্বাগো তোর আল্লাহর দোহাই লাগে ছাড়ি দে!’ মর্তের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দশানন রাবণ যিনি দুই হাতে হিমালয়ের কৈলাশ পর্বত তুলে ফেলেছিলেন, সর্বাধিক শক্তিশালী দেবতা শিবকেও তুচ্ছজ্ঞান করতেন সেই ব্যক্তিটিও রম্ভা ও নলকুবেরের অভিশাপের ভয়ে সীতাকে স্পর্শ করতে সাহস করেননি, অথচ নোয়াখালীর নরপিশাচ ধর্ষকদের আল্লাহর দোহাই এবং পিতৃতুল্য আসনে বসিয়েও তাদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পাননি নির্যাতিত নারী।

দেশবাসীর গণদাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করেছে। আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাই সেই প্রাচীনকাল থেকেই প্রাশ্চাত্য ও প্রাতীচ্যে ধর্ষণের শাস্তি ছিল চরম ও ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত। যেমন প্রাচীন গ্রিসের কথাই ধরা যাক। যদিও গ্রিক কিংবদন্তিতে দেবদেবীদের মধ্যে ধর্ষণের ছড়াছড়ি। গ্রিক মিথলজির প্রধান দেবতা জিউস ধর্ষণ করছেন দেবী ইউরোপা, জেনেমেড কিংবা লেডা-কে। অন্যদিকে গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে থ্যাবনের রাজা লাইয়াস (Laius) দ্বারা ক্রিসিপ্পাস-কে ধর্ষণের বিষয়টি, গ্রিক কিংবদন্তিতে ‘লাইয়াসের কুকর্ম’ নামে বিশেষভাবে খ্যাত। অনেকের ধারণা বাংলা ‘লুচ্চা’ শব্দটির উদ্ভব ইংরেজি ‘লাইয়াস’ শব্দ থেকেই।

সে যা হোক আমরা দেখি যে প্রাচীন গ্রিসে চারটি পাপের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। সেগুলো হচ্ছে হত্যা, রাষ্ট্রদ্রোহ, অগ্নিসংযোগ ও চতুর্থটি হচ্ছে ধর্ষণ। এতেই বোঝা যায়, সে সময় ধর্ষণ কতটা ঘৃণিত ও নিন্দিত ছিল। ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ইউরোপে দেখা যায়, যিনি ধর্ষণের শিকার তিনি ইচ্ছে করলে সেই ধর্ষণকারীকে নিজ হাতে হত্যা করতে পারতেন। অন্যদিকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে ধর্ষণের শাস্তি ছিল ভয়াবহ। সে সময় ধর্ষণের শিকার নিপীড়িত নারীটি নিজের হাতে ধর্ষণকারীর অ-কোষ কিংবা চোখ উপড়ে নিতে পারতেন। গ্রিসের মতো রোমান সাম্রাজ্যেও ধর্ষণের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। কিন্তু সম্রাট অগাস্টাস সিজার ধর্ষণ আইনের কিছু পরিবর্তন আনলেন। যদি কোনো কুমারী মেয়েকে (অক্ষত যোনি) ধর্ষণ করা হতো তাহলে তার শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড কিন্তু ধর্ষিতা যদি বিধবা বা বিবাহিতা হতেন তাহলে শাস্তির পরিমাণ ক্ষেত্র বিশেষে কিছুটা নমনীয় হতো। এখানে উল্লেখ্য, সেই প্রাচীন গ্রিস কিংবা রোমান সাম্রাজ্যে আইন এত উন্নত ছিল যে, বারাঙ্গনা কিংবা বারবানিতাদের ধর্ষণ করলেও ধর্ষককে শাস্তি পেতে হতো। প্রাচীন ভারতে ধর্ষণের শাস্তি ছিল পুরুষাঙ্গ ছেদ। আমরা সাধারণত যাকে খোজা করা হিসেবে বুঝে থাকি। প্রাচীন গ্রিস ও রোমের মতো ভারতেও দেখি গণিকাদের অপমান কিংবা ধর্ষণের শাস্তির বিধান ছিল। কিন্তু সে শাস্তি হতো অর্থদন্ডে।

রাজা চন্দ্রগুপ্তের (খ্রিস্টপূর্ব ৩৪০-২৯৮) অর্থমন্ত্রী কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, গণিকা অর্থাৎ বেশ্যাকে প্রকাশ্যে অপমান করার দন্ড ছিল চব্বিশ পণ। পণ হচ্ছে সেই আমলের মুদ্রা। অন্যদিকে গণিকাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করার দন্ড ছিল পঞ্চাশ পণ এবং বহুজনে মিলে পরপর ওইভাবে ধর্ষণ করলে তাদের প্রত্যেকে চব্বিশ পণ দন্ড দিতে হতো। এখন ধর্ষণের সম্ভাব্য কারণ ও প্রতিকার নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। আমার দৃষ্টিতে সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্ষণের মূল কারণ মূলত তিনটি। এক. আইনের শাসনের অভাব, দুই. মূল্যবোধের অভাব, তিন. মনোবৈকল্য। একটি রাষ্ট্রে যদি আইনের শাসন না থাকে তাহলে সেখানে কিছুতেই ধর্ষণ ঠেকানো সম্ভব নয়। দ্বিতীয় হচ্ছে মূল্যবোধের অভাব। ধর্ষণের আসল সমস্যা নারীর পোশাকে নয়, বরং এর শেকড় সামাজিক মূল্যবোধের অভাবের ভিতর প্রথিত। যেমন আমাদের সমাজে অধিকাংশ পরিবারে দেখা যায় নারীরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হচ্ছেন। একটি শিশু যখন চোখের সামনে দেখে তার মা নিগৃহীত হচ্ছেন তার পিতা দ্বারা কিংবা তার বোন অবহেলিত হচ্ছেন কারণ সে একজন নারী। এসব নানাবিধ লিঙ্গ বৈষ্যমের কারণে একজন পুরুষের মনোজগতে ধারণা জন্মায় যে নারীরা সমাজে পুরুষের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। অতএব তাদের নিগৃহ নির্যাতন করা দোষের কিছু নয়। পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেও সমাজে ধর্ষণের আধিক্য আজকের মতো এতটা ভয়াবহ ছিল না। কারণ সে সময় আমাদের সমাজে পাঠ্যাভ্যাসের প্রচলন ছিল। কমবেশি সবাই বই পড়তেন। মানুষের ভিতর কিছুটা হলেও মূল্যবোধ কাজ করত। বিভিন্ন জেলার মফস্বল শহরগুলোতে পর্যন্ত নানাবিধ সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাব প্রভৃতি ছিল। যেখানে নানা রকম সাংস্কৃতিক চর্চা কিংবা খেলাধুলা হতো। পৃথিবীতে সবচেয়ে কম ধর্ষণ সংঘটিত হয় ফিনল্যান্ড, সুইডেন, সিঙ্গাপুর, জাপান প্রভৃতি দেশগুলোতে। মজার বিষয় হচ্ছে বই পড়ার হার সূচকে এই দেশগুলোই পৃথিবীতে শীর্ষে অবস্থান করছে। অতএব পাঠ্যাভ্যাস যে মূল্যবোধ তৈরিতে ভূমিকা রাখছে এটা কিন্তু সহজেই অনুমেয়।

আইনের শাসনের কঠোরতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ধর্ষণের হার অনেক কম। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে আইনের শাসন বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছুটা উন্নত হলেও মূল্যবোধের অভাবে সেখানে প্রতি বছর অসংখ্য ধর্ষণ সংঘটিত হয়। এখানে উল্লেখ্য, হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা কেভিন স্পেসি, ডাস্টটিন হফম্যান কিংবা জর্জবুশ সিনিয়র, ডোনাল্ড ট্রাম্প, বিল ক্লিনটনের মতো সুদর্শন ও প্রতিষ্ঠিত সেলিব্রেটিদের বিরুদ্ধে যখন যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে তখন প্রশ্ন জাগে এর পেছনে কি তাদের মনোবৈকল্য দায়ী নয়? কারণ তাদের কি নারী সঙ্গীর অভাব? আমার মতে তাঁদের মনোজগতে ব্যাপক সমস্যা রয়েছে এবং এসব ক্ষেত্রে মনোচিকিৎসাটাই সর্বাগ্রে জরুরি। আইনের শাসন ও মূল্যবোধ এই দুটি বস্তুর সমন্বয় ঘটলে একটি দেশে যে কি অসাধারণ দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমি তখন ব্রিটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে অধ্যায়ন করছিলাম। নববর্ষের একরাতে খাজা মাসুদ নামে এক বাংলাদেশি বড় ভাইয়ের সঙ্গে নববর্ষ উদযাপন শেষে মধ্য রাতের দিকে স্টুডেন্ট ডর্মে ফিরছিলাম। হঠাৎ চোখ গেল একটি রেস্তোরাঁর পাশের এককোণে। সেখানে দেখলাম একটি অর্ধনগ্ন মেয়ে অতিরিক্ত সুরাসক্ত হয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। খাজা ভাই আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, দেখ কী অসভ্য দেশ! আমি বললাম, ভাই একটু উল্টা করে চিন্তা করেন। দ্রাক্ষারসে আসক্ত ও অর্ধনগ্ন হয়ে পড়ে থাকাটা মোটেও কাজের কথা নয়। কিন্তু দেখেন কী সভ্যদেশ। এই মেয়েটি সম্ভবত সারা রাত পড়ে থাকবে এভাবে। অথচ ভুলেও কেউ তার শরীর স্পর্শ করবে না। কিন্তু বাংলাদেশ হলে কি হতো একবার চিন্তা করেন তো। আমি বললাম একটি দেশ কতটা সভ্য সেটা নির্ভর করে সে দেশে নারীরা কতটুকু সুরক্ষিত। যা হোক আমার মনে হয় বর্তমান সরকারের উচিত ধর্ষণরোধে যা কিছু করণীয় সেগুলো করা। কারণ এই ধর্ষণের কারণে অতীত ইতিহাসে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটে গেছে। সেসব ঘটনার দু-একটি শুনিয়ে আজকের লেখা শেষ করব।

সেটা খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৬ সালের ঘটনা, গ্রিক ইতিহাসবেত্তা ডায়োডরাস সিকুলাস ও প্লুতার্ক লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায় মেসেডোনিয়ার রাজা সে সময় আলেকজেন্ডারের পিতা দ্বিতীয় ফিলিপ। আলেকজেন্ডার কিন্তু মোটেও সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন না। দ্বিতীয় ফিলিপের বহু পত্নী ও উপপত্নী ছিল। সেসব ঘরেও বেশকিছু সন্তানাদি ছিল ফিলিপের। তাদের মধ্য থেকেই একজনকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করেছিলেন ফিলিপ। একই সঙ্গে রাজা ফিলিপ ছিলেন সমকামীও। পাওসানিয়াস নামে ফিলিপের একজন দেহরক্ষী ছিল। পাওসানিয়াসের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ছিল ফিলিপের। তো হয়েছে কি একদিন ফিলিপের শ্বশুর এটালাস কর্তৃক এক ভোজসভায় নিমন্ত্রণ করা হয় পাওসানিয়াসকে। তো সেই ভোজসভা চলাকালীন এটালাসের এক ভৃত্য ধর্ষণ করে পাওসানিয়াসকে। পাওসানিয়াস ধর্ষণের বিচার দাবি করে তার প্রেমিক ও রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের কাছে। কিন্তু পাওসানিয়াসকে ফিলিপ বললেন, তুমি যেহেতু ধর্ষিত হয়েছ সেহেতু তোমাকে আমি পদোন্নতি দিচ্ছি কিন্তু এর বিচার আমি করতে পারব না। পাওসানিয়াস বললেন, আমি আমার সম্ভ্রম হারিয়েছি এর উপযুক্ত বিচার আমি চাই। রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ধর্ষণের বিচার না করাতে পাওসানিয়াস ক্রোধান্ধ হয়ে হত্যা করলেন রাজা ফিলিপকে আর এই সুযোগেই আলেকজেন্ডার সিংহাসনে বসে সমস্ত দুনিয়া জয় করার সুযোগ লাভ করলেন।

তবে একটি যৌন নির্যাতন আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের ভাগ্য একেবারেই পাল্টে দিয়েছিল। আমেরিকার ১৬তম রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন একসময় মাঝিমাল্লার কাজ করতেন। তো সেই কাজের সূত্রেই একবার তিনি এসেছিলেন নিউ অরলিয়ন্সে। সঙ্গে ছিল তার মামাতো ভাই জন ও সৎ ভাই জোহান্সটন। সেখানে এক দিন দাস বাজারে একটি ষোড়শ বর্ষীয়া বর্ণশঙ্কর যুবতী মেয়েকে নির্যাতিত হতে দেখে দারুণভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন তিনি। মঞ্চে শৃঙ্খলিত সেই মেয়েটিকে ক্রেতাগণের মধ্যে কেউ কেউ মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিয়ে পরীক্ষা করছিল। যেমনটি করা হয় পশু হাটে পশু ক্রয় বিক্রয় করার সময়। কেউ হাত বুলোচ্ছিল মেয়েটির ঊরুতে, কেউ আবার বক্ষে, কেউ কেউ আবার ...। এ যেন এক নারকীয় দৃশ্য! কুরুচিপূর্ণ এসব দৃশ্য দেখে আব্রাহাম লিংকন ভীষণ কষ্ট পেলেন।

আব্রাহাম প্রচ- ক্রোধে জনের কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে বলেছিলেন- জন, আমি যদি জীবনে একবার, শুধু একটি বার সুযোগ পাই তবে এই দাসপ্রথা যে করে হোক নির্মূল করে ছাড়ব আর এর জন্য আমাকে যতই মূল্য দিতে হোক না কেন, তুমি দেখে নিও।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর