বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আলোকিত মানুষ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু

আলহাজ বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদ

আলোকিত মানুষ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন একজন বনেদি ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। একজন দেশবরেণ্য শিল্পপতি হওয়া সত্ত্বেও এবং দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করার পরও নিজেকে একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পপতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন বিধায় তিনি একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। আমি নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করি। আমার জীবন ধন্য যে আমি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মতো এত বড় মাপের মহৎ হৃদয়বান জাতীয় নেতার সাহচর্য লাভের সুযোগ হয়েছে। চট্টগ্রামের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নানা ঝামেলার মধ্যেও দলীয় আদর্শে ছিলেন দৃঢ়। দলীয় নেতা-কর্মীদের জন্য হয়ে উঠেছিলেন বড় অবলম্বন। রাজনীতিসহ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। দেশের বেকারত্ব হ্রাসে সহায়তা করেছেন কর্মসংস্থান সৃষ্টির  মাধ্যমে। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বহু বছর ধরে সক্রিয় ছিলেন। তিনি দীর্ঘ একটি সময় ধরে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে চারবার নির্বাচিত হয়েছেন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৫ সালে হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আখতারুজ্জামান চৌধুলী বাবু। তাঁর পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন একজন আইনজীবী ও জমিদার। তাঁর মাতার নাম খোরশেদা বেগম। তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার মরহুম আলহাজ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা নুরনাহার জামানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। একই বছরে ঢাকা নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। এরপর তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ’৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন। ’৬৫ সালে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। ’৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ’৬৭ সালে তিনি মূল সংগঠন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। আলহাজ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় সংগ্রাম কমিটির কর্মকা- পরিচালিত হতো তাঁর পাথরঘাটার জুপিটার হাউস থেকে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইকোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তাঁর বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান, সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ’৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ’৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। এরপর ’৮৬, ’৯১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু স্বাধীনতার পর। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ’৭৫ সালে সপরিবার বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং পরে দলের পুনরাবৃত্তি ও পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। রাজনীতির পাশাপাশি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতার আগে তিনি বাটালি রোডে বয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরেতিনি আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যানাম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট কিনে তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরমিট মিল কিনে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন বাংলাদেশ বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। তিনি দেশের দ্বিতীয় প্রাইভেট ইউসিবিএলের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি ২০১১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র ও ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দুই দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিন পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জনক তিনি। একটি আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাঁর আদর্শ অন্তরে ধারণ করে প্রতিনিয়ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের পথ চলতে হবে। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মতো ত্যাগী নেতার আজ বড়ই প্রয়োজন। তিনি সারা জীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে আওয়ামী পরিবারে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, তবে তিনি আমাদের অন্তরে চিরজাগ্রত। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তাঁর স্মৃতি, অর্থপূর্ণ জীবন ও লালিত মূল্যবোধ।

লেখক : মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সাবেক একান্ত সচিব।

সর্বশেষ খবর