প্যারিস, নিস, ভিয়েনা, কাবুল। জঙ্গি হামলা চলছেই। যত জঙ্গি হামলা চলবে, যত নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে খুন করবে জঙ্গিরা, দক্ষিণপন্থি-কট্টর-রাজনীতি তত জনপ্রিয় হবে। ইসলামের নামে সন্ত্রাস যত বেশি ঘটবে, তত বেশি ইসলামবিদ্বেষীরা ক্ষমতায় আরোহণ করবে, তত বেশি বর্ণবিদ্বেষ এবং ইসলামবিদ্বেষ গ্রহণযোগ্যতা পাবে। বিশ্বজুড়ে একের পর এক জিহাদি আক্রমণ ঘটতে দেখে ইসলামকে নিয়ে যত কটূক্তি মানুষ করে, তত কটূক্তি গত পাঁচশ’ বছরে মানুষ করেছে কিনা সন্দেহ। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘পুট ইওরসেলফ ইন মাই সুজ’। নিজেকে আমার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেখ। মুসলিমরা যদি অমুসলিমদের জায়গায় নিজেদের দাঁড় করায়, তাহলে? ধরা যাক মুসলিম বিশ্বে যদি অমুসলিমদের আশ্রয় দেওয়া হতো, আর সেই অমুসলিম লোকেরা তাদের ধর্মের নামে যদি মুসলিমদের হত্যা করতো, তাহলে? আমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া। অমুসলিমদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে মুসলিম বিশ্ব থেকে বের করে দিত, অমুসলিমদের শায়েস্তা করার জন্য তারা অমুসলিমবিরোধী রাজনীতিককে দেশের প্রধান বানাতো, যেন অমুসলিমদের জন্য মুসলিম বিশ্বের দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়। মুসলিমরা যা যা করতো, আজ অমুসলিমদের দেশে অমুসলিমরা ঠিক তা-ই করতে চাইছে।

আমি বুঝি না নিজেদের মুসলিমপ্রধান দেশ ফেলে, ইসলামী আইন যেসব দেশে বলবৎ সেসব দেশে নির্বিঘেœ ধর্মচর্চা না করে মুসলমানরা কেন অমুসলিমের দেশে পাড়ি দেয় যেখানে ইসলামী আইন এবং সংস্কৃতির লেশমাত্র নেই? পাড়ি যদি কোনও কারণে দিলই তবে সন্তানদের কেন সে দেশের সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে? সে দেশের সংস্কৃতিকে পছন্দ হয় না তো সেই দেশে বাস করা কেন? তাদের উদারনীতি, আর তাদের অর্থনীতির সুবিধে ভোগ করার জন্যই তো? এ তো নিতান্তই স্বার্থপরতা। এই স্বার্থপরতা এতকাল অমুসলিম দেশের লোকেরা গ্রহণ করেছে কিন্তু এখন আর করতে চাইছে না। কেনই বা করবে যখন তুমি ওদের ধরে ধরে জবাই করছো? তুমি কি তোমার মুসলিম বিশ্বে পাড়ায় পাড়ায় গির্জা আর মন্দির বানাতে দিতে? ওরা কিন্তু অমুসলিম হয়েও তোমাকে পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ বানাতে দিয়েছে। তুমি ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করেছো। ওদের ভাতা খেয়েছো। ওদের খেয়েছো, পরেছো। তারপর ওদেরই গলায় ছুরি বসিয়েছো, ওদেরই বুক লক্ষ করে গুলি ছুড়েছো। তুমি না ছুড়লেও তোমার ভাই ছুড়েছে, তোমার ধর্মের নাম নিয়ে ছুড়েছে। তুমি তখন তোমার ভাইয়ের অন্যায়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী না হয়ে যাকে হত্যা করা হয়েছে, তাকে দোষ দিচ্ছ, তার দেশকে দোষ দিচ্ছ, অতীতে সেই দেশ কী অন্যায় করেছে তোমার দেশের ওপর সেই দোষ তুলে আনছ, আর ধর্মের নামে হত্যাকা-কে তুমি ন্যায্যতা দিচ্ছ। ইউরোপ আর আমেরিকা গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বহুকাল অন্যায় করেছে। সাম্রাজ্যবাদ আর আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা, নিজেদের পুতুল বসিয়ে রাজত্ব করা, লাগাতার শোষণ করা, বিপ্লবীদের খতম করে দেওয়া, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে ধংস করে দেওয়া। সে তো সুদূর অতীত, নিকট অতীতেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য লাখো মানুষকে হত্যা করেছে। কিন্তু যেহেতু ওরা ভুল করেছে, তাই বুঝি আমাদের ভুল করতে হবে? এই অংকটা খুব ভুল অংক। ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছে নাৎসি জার্মানি। ইহুদিরা কিন্তু প্রতিশোধ নিতে নিরীহ জার্মানদের খুন করতে নামেনি। বরং নিজেরা পারদর্শী হয়েছে সর্ববিদ্যায়, আজ তাঁরা নমস্য। জার্মানরা আজ ইহুদিদের কুর্নিশ করে। এর চেয়ে চমৎকার প্রতিশোধ আর কী হতে পারে। বাইবেল বলে চোখের বদলে চোখ নিতে। গান্ধী বলেছিলেন, সবাই যদি চোখের বদলে চোখ নিতে শুরু করে, তাহলে গোটা বিশ্বই তো অন্ধ হয়ে যাবে।

বাম রাজনীতির মুখোশ খুলে গেছে, এই রাজনীতি ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদকে ছলে বলে কৌশলে সমর্থন করে। বাম রাজনীতি দক্ষিণপন্থি রাজনীতির বিরোধী, কিন্তু কী কারণে এই রাজনীতি ইসলামী দর্শন যে আগাগোড়া দক্ষিণপন্থি, তা অনুধাবন করতে পারছে না? অনুধাবন না করার আমি কোনও কারণ দেখি না। ইসলামী দর্শন দক্ষিণপন্থি তো বটেই। দক্ষিণপন্থি বলেই ধর্মীয় মৌলবাদের স্থান এই দর্শনে সবার ওপরে। শ্রেণি বৈষম্যও বেশ বহাল তবিয়তে উপস্থিত। দক্ষিণপন্থি বলেই নারীর সমানাধিকার এই দর্শনে স্বীকৃত নয়, সমতা স্বীকৃত নয়, শিল্প সংস্কৃতি নৃত্যসঙ্গীত এবং সকল সুকুমারবৃত্তি আদৃত তো নয়ই, বরং ধিকৃত। বাম রাজনীতিকরা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন না হয়ে চরম দক্ষিণপন্থি মৌলবাদী মতবাদকে আলিঙ্গন করে ঐতিহাসিক এক ভুল করেছেন। এই ভুলের খাদ থেকে পাড়ে ওঠা তাদের পক্ষে মোটেও সহজ নয়, সম্ভবত সম্ভবও নয়। বাম রাজনীতির পতন এভাবেই ঘটে চলেছে।

এ কারণেই বামপন্থি সব রাজনীতির জনপ্রিয়তা তলানিতে নেমে গেছে। মানুষ এখন ভরসা করছে দক্ষিণপন্থির ওপর, তাও আবার কট্টর দক্ষিণপন্থির ওপর। কারণ একমাত্র তারাই আস্থা দিয়েছে মুসলিম সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াবে। ট্রাম্প বর্ণবিদ্বেষী হয়েও, নারীবিদ্বেষী হয়েও, রাজনীতিক না হয়েও, ইনকামট্যাক্স না দিয়েও, মারণ ভাইরাসের কামড়ে গোটা বিশ্ব যখন কুঁকড়ে আছে, যখন বাঁচার জন্য মাস্ক পরা অবশ্য কর্তব্য, তখন মাস্কের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার না করে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব নিয়ে হাসি তামাশা করেছেন, করেও জিতে যাচ্ছেন নির্বাচনে।

ইসলামকে কেন মানুষ ভয় পাচ্ছে? কারণ ইসলামের নামে সন্ত্রাসীরা মানুষ হত্যা করছে। যে কেউ যে কোনও সময় খুন হয়ে যেতে পারে। আফগানিস্তানে ২২ জন শিক্ষার্থী খুন হয়ে গেল সন্ত্রাসী আক্রমণে। তার কিছুদিন আগে ২৪ জনের প্রাণ হরণ করেছে সন্ত্রাসীরা। যে মানুষই তাদের জিহাদে সায় দেয় না, সে মানুষকেই তারা শত্রু বলে মনে করে। শত্রুরা মুসলমান, অমুসলমান, অবিশ্বাসী, নাস্তিক যে কেউ হতে পারে। জিহাদে বিশ্বাস করা মানুষই শুধু তাদের বন্ধু, বাকিরা সবাই শত্রু। সুতরাং জিহাদ কোনও দেশের জন্যই নিরাপদ নয়। মুসলিম দেশগুলো কোথায় ফ্রান্সে অস্ট্রিয়ায় জিহাদি কর্মকান্ডের নিন্দে করবে, তা নয়তো ইউরোপকেই দোষ দিচ্ছে তাদের মতপ্রকাশের অধিকারের জন্য। তুরস্ক, পাকিস্তান, মালয়েশিয়ার মুসলিম নেতারা জঙ্গিবাদকে তো সমর্থনই করলেন। রাষ্ট্রনেতার কাজ বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলা, অথবা ওঁরাই বর্বরতার পক্ষে দাঁড়ালেন। এতে ওঁরা মুসলিম মৌলবাদীদের বাহবা পাবেন। আজকে মৌলবাদ তোষণ করলে কাল জঙ্গির জন্ম হয়। এই জঙ্গি কি শুধু পাশ্চাত্যেই হত্যাকা- চালাবে? প্রাচ্যেও চালাবে। আফগানিস্তানের মতো মৌলবাদী দেশও বাদ যায় না জঙ্গি হামলা থেকে। জঙ্গিবাদ মুসলিম অমুসলিম উন্নত অনুন্নত কোনও দেশের জন্যই শুভ নয়। অতএব একে রোধ করতেই হবে। মৌলবাদীদের ভোট পাওয়ার জন্য, ক্ষমতায় দীর্ঘদিন টিকে থাকার জন্য দেশে জ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞানচর্চা বন্ধ করে কেবল ধর্মচর্চা বিস্তার করে আখেরে লাভ হয় না, বরং ক্ষতিই হয়। এই ক্ষতির চিহ্ন প্রতিটি মুসলিম দেশে স্পষ্ট।

যে মুসলমানরা জিহাদি আদর্শে বিশ্বাসী নয়, তাঁদের প্রতিবাদ কোথায়? বাংলাদেশে লাখ লাখ লোকের মিছিল হয়েছে জিহাদিদের পক্ষে। এককালের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ মাত্র তিন দশকের মধ্যেই মৌলবাদের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। কুমিল্লায় জিহাদিরা পুড়িয়ে দিয়েছে অমুসলিমদের ঘরবাড়ি। সম্ভবত জিহাদিরা চায় না দেশে কোনও অমুসলিম বাস করুক। প্রগতিশীল মানুষেরা দেশান্তরী হয়েছে। তাহলে এটাই সত্য যে দেশের ভিতর কোনও প্রগতিশীলতার ঠাঁই নেই, কোনও মুক্তচিন্তার ঠাঁই নেই, কোনও মতপ্রকাশের অধিকার চলবে না।

সরকারের দায়িত্ব মৌলবাদ দমন করা। মৌলবাদ দমন না করলে দেশ অচিরে দারুল ইসলামে রূপ নেবে, এ বিষয়ে কারও সংশয় থাকার কোনও কারণ দেখি না। আর সেই দারুল ইসলামে নারী নেতৃত্বের কিন্তু কোনও স্থান নেই। আমাদের নারী নেত্রীরা নিশ্চয়ই এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।