বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

স্ট্রোক প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি

ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

স্ট্রোক প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি

আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ধারণা আছে- স্ট্রোক একটি হৃৎপিন্ডের রোগ। বাস্তবে এটি মোটেই সত্য নয়। স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ। মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালির দুর্ঘটনাকেই স্ট্রোক বলা যায়। এ দুর্ঘটনায় রক্তনালি বন্ধও হতে পারে, আবার ফেটেও যেতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। স্ট্রোক সম্পূর্ণই মস্তিষ্কের রক্তনালির জটিলতা-জনিত রোগ। স্ট্রোকে আক্রান্তের মধ্যে ৪০ ভাগ মারা যায়, আর ৩০ ভাগ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা বেঁচে থেকেও দুর্বিষহ জীবন যাপন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি ৬ সেকেন্ডে একজন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। গবেষণায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ বছর প্রায় ১ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ পৃথিবীব্যাপী প্রথমবারের মতো স্ট্রোকে আক্রান্ত হবে, যার মধ্যে প্রায় ৫৫ লাখ স্ট্রোকজনিত জটিলতায় মৃত্যুবরণ করবে। যদি কোনো যথাযথ প্রতিরোধব্যবস্থা নেওয়া না হয় তাহলে মৃত্যুর এ সংখ্যা ৬৭ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এত কিছুর পর প্রায় ৮০ লাখ মানুষ স্ট্রোকজনিত জটিলতা বা পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকবে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক শুধু ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যাই নয়, রাষ্ট্রীয় সমস্যাও। একই সঙ্গে অনেক মানুষ হারাচ্ছে তাদের কর্মদক্ষতা, বরণ করছে পঙ্গুত্ব এবং ব্যয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ। সুতরাং স্ট্রোক শুধু ব্যক্তির ভোগান্তি বয়ে আনে না, বরং তা পরিবারকে পথে বসানোর উপক্রম করে। তাই এ রোগটি আসলে জাতীয় তথা বিশ্বজনীন সমস্যা। পৃথিবীতে ২৫ বছর বয়সের ওপরে প্রতি চারজন মানুষের মধ্যে একজন জীবদ্দশায় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। আমাদের দেশে এখন ১৫ থেকে ২০ লাখ স্ট্রোকের রোগী রয়েছে। প্রতি হাজারে গড়ে তিন থেকে পাঁচজন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ্বের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার বেশি লক্ষ্য করা গেলেও যে কোনো বয়সেই তা হতে পারে। ৫০ বছর বয়সের পর প্রতি ১০ বছরে স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়। আক্রান্তের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। মহিলাদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার কম। ফাস্টফুডে আসক্তদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। শিশু ও তরুণের অনেকে খাদ্যাভ্যাসের কারণে স্ট্রোকঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। স্ট্রোকে আক্রান্তের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তাই স্ট্রোক প্রতিরোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই বিশ্বব্যাপী। জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রতি বছর ২৯ অক্টোবর একটি প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘সচলভাবে সুস্থ থাকি, স্ট্রোককে দূরে রাখি।’

তবে এ বছর স্ট্রোকের ঝুঁকির তালিকায় একটি নতুন কারণ যুক্ত হয়েছে। আমরা প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েনে, তার মধ্যে অনেকেই করোনাকালীন এবং করোনা-পরবর্তী জটিলতার মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই কোনোভাবেই স্ট্রোককে অবহেলা করার সুযোগ নেই। একমাত্র ব্যাপক জনসচেতনতার মাধ্যমে যথাযথ প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ করলেই আমরা স্ট্রোকের হাত থেকে সবাইকে রক্ষা করতে পারি। স্ট্রোক কেন হয়? স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের প্রথমেই জানা প্রয়োজন স্ট্রোক কেন হয়, এ রোগের কারণ কী। অনেক কারণেই স্ট্রোক হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ। অতিরিক্ত টেনশন, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রক্তে বেশি মাত্রায় চর্বি স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান, তামাকপাতা, জর্দা, মাদক সেবনও স্ট্রোকের কারণ। তা ছাড়া সিডেনটারি লাইফস্টাইল বা অলস জীবনযাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমল পানীয় গ্রহণ পরোক্ষভাবে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। কিছু কিছু ওষুধ যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমিয়ে দেয় যেমন অ্যাসপিরিন, ক্লপিডগ্রেল প্রভৃতি ব্যবহারে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক হতে পারে। ঘুমের সময় নাক ডাকা বা ঘুমের সময় শ্বাসকষ্টজনিত উপসর্গ থাকলে সতর্ক হতে হবে। যে কোনো ধরনের প্রদাহ অথবা ইনফেকশন ও জন্মগতভাবে ব্রেনে কিংবা মস্তিষ্কে সরু রক্তনালি থাকা ব্যক্তিদের কিন্তু স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। অনেক সময় বংশানুক্রমে কিংবা পূর্বের স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও দূরবর্তী রক্তনালি বন্ধ হওয়ার কারণেও স্ট্রোক হতে পারে।

স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ : স্ট্রোক যদি কারও হয়েই যায় তবে কিছু কিছু উপসর্গ দেখা দেয় বা কিছু কিছু উপসর্গ দেখে স্ট্রোক হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যেমন শরীরের কোথাও বা একাংশ অবশ ভাব লাগা কিংবা দুর্বল বোধ করা; কথা বলার সমস্যা অর্থাৎ কিছুক্ষণের জন্য কথা জড়িয়ে যাওয়া, অস্পষ্ট হওয়া ও একেবারে কথা বলতে বা বুঝতে না পারা; এক চোখ বা দুই চোখেই ক্ষণস্থায়ী ঝাপসা দেখা বা একেবারেই না দেখা; মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ঘোরা, দৃষ্টি ঘোলা লাগা, হঠাৎ করে কিছুক্ষণের জন্য হতবিহ্বল হয়ে পড়া, বমি বমি বোধ অথবা বমি করা, পা দুটিতে দুর্বল বোধ করা ইত্যাদি স্ট্রোকের প্রচলিত লক্ষণ। তা ছাড়া স্ট্রোকের মারাত্মক উপসর্গ হচ্ছে অজ্ঞান হওয়া, খিঁচুনি, তীব্র মাথা ব্যথা ও বমি।

স্ট্রোক হলে কী চিকিৎসা দিতে হবে : স্ট্রোক হওয়ার পর রোগীর দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন, এজন্য প্রতিটি মুহূর্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, স্ট্রোকের রোগীদের চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো সময়। সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চিকিৎসা শুরু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই উপরোক্ত উপসর্গ দেখা দিলে সময় ক্ষেপণ না করে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। সম্ভব হলে স্ট্রোকের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল বা নিউরো কেয়ারযুক্ত ইউনিটে নিতে পারলে ভালো হয়। স্ট্রোক হয়ে গেলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল।

রোগীর উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করা হয়। যদি খেতে না পারেন তবে নাকে নল দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রস্রাব ও পায়খানা যাতে নিয়মিত হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রয়োজনে প্রস্রাবের রাস্তায় ক্যাথেটার দিতে হবে। চোখ, মুখ ও ত্বকের যতœ নিতে হবে। বেডসোর প্রতিরোধ করার জন্য নিয়মিত দু-তিন ঘণ্টা পর পর পাশ ফেরাতে হবে। সম্ভব হলে বেডসোর প্রতিরোধী অটোমেটিক বা স্বয়ংক্রিয় বিছানা ব্যবহার করা যেতে পারে। রোগীর সেবাদানকারী ও আপনজনদের ধৈর্য ধারণ করতেই হবে। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি অনেক স্ট্রোক রোগীর হার্টের রোগ থাকে। এসব ক্ষেত্রে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শের প্রয়োজন হয়। অন্যান্য চিকিৎসা স্ট্রোকের ধরন অনুযায়ী করা হয়। যেমন ইশকেমিক স্ট্রোকের বেলায় এসপিরিন, ক্লোপিডগ্রিল যাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। রক্তক্ষরণের কারণে স্ট্রোক হলে কোনো কোনো সময় অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে।

স্ট্রোক চিকিৎসায় হাসপাতালে যেসব ব্যবস্থা থাকা জরুরি : সব হাসপাতালেই থাকা উচিত একটি স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট, যেখানে ডাক্তার, নার্স, থেরাপিস্ট এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসা দেবেন। একজন স্ট্রোক রোগীর প্রয়োজন হয় নিউরোলজিস্ট ও নিউরোসার্জনের। অনেক স্ট্রোক রোগীর অপারেশন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অনেক রোগীর শ্বাসকষ্ট, বেডসোর প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। সুতরাং রেসপিরেটরি মেডিসিন স্পেশালিস্ট, প্লাস্টিক সার্জনসহ সবার সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে। রোগীর অঙ্গ সঞ্চালন করে জড়তা কাটিয়ে তুলতে রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট প্রয়োজন হয়। রোগী কথা বলতে না পারলে প্রয়োজন স্পিচ থেরাপিস্টের। স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট, সমন্বিত স্ট্রোক কেয়ার টিমের ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসায় আসবে সুফল, রোগী ও রোগীর স্বজন হবে চিন্তামুক্ত, রোগী লাভ করবে আরোগ্য।

যেভাবে স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব : কীভাবে আমরা এ ভয়াল দানবকে রুখে দাঁড়াতে পারি- এটি খুবই গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন। প্রথমেই মনে রাখতে হবে, ‘স্ট্রোক প্রতিরোধযোগ্য’। স্ট্রোক রোগটি ব্রেন বা মস্তিষ্কের এক কঠিন রোগ, যা ব্রেনের কোষগুলোকে নষ্ট করে ফেলে। আর একবার নষ্ট হলে তা পুনরায় পুরোপুরিভাবে কার্যকর হয় না অথবা নতুন করে কোষগুলো তৈরি হয় না। সুতরাং ‘চিকিৎসার চেয়ে এ রোগ প্রতিরোধই উত্তম।’ যেহেতু এ রোগ মস্তিষ্কের রক্তনালি থেকে উদ্ভূত এবং স্ট্রোক হলে অনেক রোগী প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে এ জন্য সুনির্দিষ্ট ও জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে কিংবা শহরে যে কোনো হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব। তবে স্ট্রোক প্রতিরোধে কিছু বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে। নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ধূমপান, মদপান, মাদকদ্রব্য, তামাকপাতা ও জর্দা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। হৃৎপিন্ডের রোগের চিকিৎসা, রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চর্বি ও শর্করা যুক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফাস্টফুড, বাদাম, সন্দেশ-রসগোল্লা, দুধ-ঘি-পোলাও-বিরিয়ানি, পাঙ্গাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া, গরু বা খাসির মাংস, নারকেল বা নারকেলযুক্ত খাবার ইত্যাদি কম খাওয়া উচিত। শাকসবজি, অল্প ভাত, পাঙ্গাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া বাদে যে কোনো মাছ, বাচ্চা মুরগি ও ডিম খেলে কোনো ক্ষতি হয় না। নিয়মিত হাঁটাচলা বা সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যায়াম করতে হবে। খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে বাড়তি ওজন কমাতে হবে।

স্ট্রোক অবশ্যই একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল এবং কষ্টসাধ্য। স্ট্রোক হলে মৃত্যুঝুঁকি তো আছেই, বেঁচে থাকলেও অনেককেই বিকলাঙ্গতা, পঙ্গুত্ব ও অসহায়ত্বের মাঝে এক দুর্বিষহ জীবন ধারণ করতে হয়। তাই আক্রান্ত নিজে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, পরিবারের জন্য অনেক সময় তা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই কেউ আক্রান্ত হয়ে গেলে তার সঙ্গে পরিবার-পরিজনসহ অন্যদের সহনশীল মনোভাব পোষণ করে যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। স্ট্রোক নামক এ অভিশাপের দৈত্য যাতে কারও জীবনে নেমে না আসে সে জন্য আমাদের সবারই সচেষ্ট থাকা জরুরি।

লেখক : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

সর্বশেষ খবর