বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান

জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফি খান (জন্ম ১ আগস্ট, ১৯২৮-মৃত্যু ৫ নভেম্বর, ২০১৬) যিনি এম আর খান হিসেবে ছিলেন সমধিক পরিচিত। অধ্যাপক খান ছিলেন একজন অনুকরণীয় ও প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। শিশু চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রবাদপুরুষ, শিশুবন্ধু, সমাজহিতৈষী, শিক্ষাবিদ, দক্ষ চিকিৎসক, প্রশাসক ও সফল শিল্প উদ্যোক্তা যিনি সমাজসেবায় একাধারে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। নির্লোভ, প্রচারবিমুখ, সদাহাস্য মানুষটি তাঁর বিভিন্ন জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে অসংখ্য মানুষকে সেবা দিয়ে গেছেন। জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান মনে করতেন রোগীও একজন মানুষ। আর এ রোগীটি সমাজে আমাদেরই কারও না কারও স্বজন, এমনকি আপনজন। রোগী যখন ডাক্তারের কাছে আসেন; তখন সাহায্যপ্রার্থী, কখনো কখনো অসহায় বটে। আর রোগীটি শিশু হলে তো কথাই নেই। ডাক্তারের কর্তব্য হবে রোগীর কষ্ট গভীর মনোযোগের সঙ্গে ধৈর্যসহকারে শোনা, রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। রোগীকে সুস্থ করে তুলতে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যেমন প্রয়োজন, তেমন রোগীর অভিভাবকদের প্রতি ডাক্তারের সহমর্মিতা প্রদর্শন ও আশ্বস্ত করাও প্রয়োজন। সব রোগীই তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে এমনটিও ঠিক নয়। কারও কারও সুস্থ হতে সময় লাগতে পারে। মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তিনি বলতেন, হায়াত ও মউতের মালিক যেমন আল্লাহ; তেমন রোগ থেকে মুক্তিদাতাও তিনি। তবে রোগীর আপনজনরা এমন যেন বলতে না পারেন যে ডাক্তার আন্তরিক ছিলেন না, ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর আগে বেশ কয়েক মাস তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল হাসপাতালে পরিচর্যাধীন ছিলেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে ৯ সেপ্টেম্বর (২০১৬) ‘দুটি কথা’ শীর্ষক শেষ লেখায় তিনি বলেন, ‘মানুষ বাঁচে আশায়, দেশ বাঁচে ভালোবাসায়। আপনি আশা করেন এটা-ওটা করবেন। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আছে, কিন্তু আল্লাহ জানেন আপনি কত দিন এ দুনিয়ায় আছেন। সুতরাং আপনি যা ভালো মনে করেন এখনই তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করবেন। এ সুযোগ আর নাও আসতে পারে। “শুভষ্য শীঘ্রম”- রাম-রাবণের একটা গল্প শোনাতে চাই। রাবণ বললেন আমি স্বর্গের সিঁড়ি বানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার সময় শেষ। সেজন্য আমি তোমাকে একটা উপদেশ দেব, যদি তুমি কোনো ভালো কাজ করতে চাও Start now don’t wait for tomorrow.’

এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর জীবনের দুটি ঘটনা তুলে ধরেন, ‘প্রথমত, শিশুদের জন্য পথকলি নামে এক সংস্থায় কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো বর্তমান শেরাটন হোটেলের উত্তর দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাড়িতে। আমি তৎকালীন সরকারপ্রধানের কাছে তাঁদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য একটা জায়গা চেয়েছিলাম। সেটা হলো মিরপুরের এশিয়া সিনেমা হলের উল্টো দিকে। ১ বিঘা জমিতে একটা টিনের ঘর করে সেখানে আউট ডোর শুরু করা যেত। তখন পথকলি ট্রাস্ট গঠনের লক্ষ্যে অনেক টাকাও উঠেছে সে টাকা দিয়ে ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর উদ্যোগ নেওয়া যেত। হাসপাতাল ও মসজিদ সবাই চায় কেউ এর বিনাশ চায় না। সরকারপ্রধান বললেন পরে হবে। এ বাড়িটা তো কেউ নিচ্ছে না, এখানেই কাজ চলতে থাকুক। আমি স্থায়ী জায়গার জন্য আবেদন জানাই। তিনি বললেন দেখা যাক, পরে হবে। কিছু দিনের মধ্যে পট পরিবর্তন হলো। পথকলি ট্রাস্ট বন্ধ হয়ে গেল। সব শেষ। অসচ্ছল শিশুদের সেবার সুযোগ মিলিয়ে গেল।

দ্বিতীয়ত, তৎকালীন আইপিজিএমআর বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে একটা জায়গা ছিল। আমি ও প্রফেসর নূরুল ইসলাম সাহেব এ হাসপাতাল বর্ধিত করার লক্ষ্যে ওই জায়গাটি হাসপাতালের নামে বরাদ্দের জন্য ভূমিমন্ত্রী আবদুল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। কয়েকদিন যাতায়াতের পর সেখানে দেখলাম খুবই হইচই। আমি মন্ত্রী মহোদয়কে অনুরোধ জানালাম, স্যার, কাজটা ভালো মনে করলে আজকে করে দিন। আপনার এখানে যে অবস্থা না জানি আপনি কয়দিন এ দায়িত্বে থাকবেন! মন্ত্রী মহোদয় বললেন আজ তো অফিস প্রায় শেষ কালকে আসুন। আমি বললাম কাল আপনি এ পদে নাও থাকতে পারেন। সবাই আমার কথায় অবাক। বললাম আজকে সম্ভব হলে করে দিন। সন্ধ্যায় আমাদের পিএকে টাইপ মেশিনসহ তার কাছে পাঠালাম, রাতের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে গেল। ভাগ্যের পরিহাস! পরদিন তার মন্ত্রিত্ব চলে গেল। সুতরাং শুভষ্য শীঘ্রম কত উপকারী। আমার এ দুটি ঘটনা বলার উদ্দেশ্য- প্রথমটি পরে করবেন বলে রেখে দিলেন কিন্তু আর করতে পারলেন না। আর দ্বিতীয়টি তিনি যদি ওই দিন রাতে না করতেন তাহলে হয়তো এটিও হতো না।

‘দেশ বাঁচে ভালোবাসায়’ শিরোনামে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আপনি টাকার আড়াই পারসেন্ট জাকাত দেন। সময়ের জাকাত যদি আড়াই পারসেন্ট ধরি তবে সপ্তাহে প্রায় ৪.৫ ঘণ্টা হয়। সপ্তাহে দুই দিন ২.১৫ মি., ২.১৫ মি. ঘণ্টা সময় দিতে পারেন। এতে অনেক ভালো ভালো কাজ করতে পারবেন। আপনারা সবাই ব্যস্ত আপনাদের সময় অনেক মূল্যবান। তবু সবার জন্য ২৪ ঘণ্টা সমান। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও ২৪ ঘণ্টা, আপনাদেরও ২৪ ঘণ্টা, আমারও ২৪ ঘণ্টা। ব্যাপার হলো, এই ২৪ ঘণ্টা আমরা কে কীভাবে ব্যবহার করি। সেটাই ভবিষ্যতের সফলতা। যদি আপনি আপনার গ্রামের বা ইউনিয়নের বা উপজেলার বা জেলার একজন লোককে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন তাহলে তিনি তার পরিবারের, তার গ্রামের একজন আদর্শ মানুষ হতে পারেন। যার দ্বারা সমাজ ও দেশ উপকৃত হবে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর