বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ইসলামের দৃষ্টিতে চিকিৎসকের দায়িত্ব

মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী

ইসলামের দৃষ্টিতে চিকিৎসকের দায়িত্ব

মানবজীবন রক্ষা করা ইসলামী শরিয়তের পাঁচটি প্রধান উদ্দেশ্যের অন্যতম। চিকিৎসাও মানবজীবন রক্ষার অন্তর্ভুক্ত। এ জন্য ইসলামী সভ্যতার সূচনা থেকে মুসলিম-সমাজে চিকিৎসকের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। রোগীর সেবা প্রদানের মাধ্যমে চিকিৎসকের ইমান ও সমাজের সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। সামগ্রিক প্রচেষ্টা ও সচেতনতার মাধ্যমে বড় ধরনের বিপর্যয় রোধ করা যায়।

চিকিৎসকসহ যারা আন্তরিকতার সঙ্গে রোগীর সেবায় এগিয়ে আসবে তাদের জন্য আখিরাতেও রয়েছে পুরস্কার। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যখন তার (অসুস্থ) মুসলিম ভাইয়ের সেবায় নিয়োজিত হয়, সে ফিরে আসা পর্যন্ত জান্নাতের ফলবাগানে (তার ছায়া) অবস্থান করতে থাকবে।’ মুসলিম। জাবির (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখতে যায় সে বরাবর রহমতের সাগরে সাঁতার কাটতে থাকে। আর যখন রোগীর কাছে গিয়ে বসে তখন যেন সে রহমতের সাগরে ডুব দিল।’ মুসনাদে আহমদ।

চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যেহেতু মানুষের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, তাই ইসলাম চিকিৎসা ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধও আরোপ করেছে। যাতে চিকিৎসকের স্বার্থ ও রোগীর সেবা পাওয়ার অধিকার সুসংহত হয়।

এক. চিকিৎসকের বিশুদ্ধ নিয়ত থাকতে হবে। মুসলিম চিকিৎসক তাঁর কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সৃষ্টির সেবার নিয়ত করবেন। কেননা বিশুদ্ধ নিয়ত জাগতিক কাজকেও ইবাদতে পরিণত করে। রসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই নিয়তের ওপর সব কাজের ফলাফল নির্ভরশীল।’ বুখারি। দুই. চিকিৎসকের বিশুদ্ধ বিশ্বাস একান্ত জরুরি। মুসলিম চিকিৎসক মাত্রই গভীরভাবে বিশ্বাস করেন তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি ও প্রচেষ্টা উপলক্ষ মাত্র। রোগমুক্তি ও আরোগ্যের প্রকৃত ক্ষমতা আল্লাহর। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি যখন অসুস্থ হই তিনি আমাকে আরোগ্য দেন।’ সুরা শুয়ারা, আয়াত ৮০। তিন. চিকিৎসক তার পেশাগত কাজে যতœবান হবেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আল্লাহ পছন্দ করেন যে, তোমরা যখন কোনো কাজ করবে তাতে তোমরা যতœবান হবে।’ মুসনাদে আবু ইয়ালা। ৪. রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের আচরণ হবে বন্ধুসুলভ। এক ব্যক্তি রসুল (সা.)-এর কাছে নিজেকে চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিলে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক আল্লাহ। তুমি বরং তার একজন বন্ধু বা হিতাকাক্সক্ষী। তার চিকিৎসক যে তাকে সৃষ্টি করেছেন।’ আবু দাউদ। ৫. চিকিৎসক রোগীর প্রতি কল্যাণকামী হবেন। তিনি রোগীর জন্য সবচেয়ে উপকারী পরামর্শটি দেবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের কাছে পরামর্শ চায়, সে যেন তাকে উত্তম পরামর্শ দেয়।’ বুখারি। ৬. চিকিৎসক নিজের অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতা গোপন করে বা নতুন কোনো বিষয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীর জীবন ঝুঁকিতে ফেলবেন না। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোগের চিকিৎসা করে অথচ তার প্রতিষেধক তার জানা নেই সে দায়ী বলে গণ্য হবে।’ নাসায়ি।

‘চিকিৎসা কাজের জন্য চিকিৎসককে দায়ী করতে হলে তার ব্যাপারে তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হতে হবে। এক. ইসলামী শরিয়ত ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রচলন ও রীতির আলোকে বাড়াবাড়ি করা। দুই. বিকল্প থাকার পরও ক্ষতিকর কোনো ওষুধ বা পদ্ধতি প্রয়োগ করা। ৩. পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা।’ তাকরিবু ফিকহিত তাবিব।

সেবা পাওয়া রোগীর মৌলিক অধিকার। ইসলামে এ অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানের পাঁচটি আবশ্যকীয় রয়েছে।... এর অন্যতম হলো রোগীর খোঁজখবর নেওয়া।’ মুসলিম। রোগীর সেবা করার সুযোগ থাকার পরও যদি কোনো চিকিৎসক চিকিৎসা না করে, কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে ভর্তি না নেয়, তাহলে হাশরের ময়দানে সরাসরি আল্লাহর দরবারে তাদের জিজ্ঞাসিত হতে হবে। মানুষ রোগাক্রান্ত হলে এমনিতেই মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। এ অবস্থায় তার সঙ্গে, তার অভিভাবকের সঙ্গে অমানবিক আচরণ, অবজ্ঞা, অবহেলা তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এমন প্রবণতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এগুলো ধর্মীয় বিধিবিধান-পরিপন্থী কাজ। এমন অমানবিক কাজ থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। যে কোনো রোগীর পাশে দাঁড়াতে হবে। এটাই মানবতা ও ইসলামের শিক্ষা।

লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ।

সর্বশেষ খবর