শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রয়োজন ভারসাম্য ও স্বার্থরক্ষার পররাষ্ট্রনীতি

মেজর জেনারেল ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন (অব.)

প্রয়োজন ভারসাম্য ও স্বার্থরক্ষার পররাষ্ট্রনীতি

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী শীতল যুদ্ধের অন্তরালে দুই পরাশক্তির দুর্দান্ত প্রতিযোগিতার মধ্যেই বাংলাদেশের জন্ম। স্বাধীনতা-উত্তর হতদরিদ্র বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের দেওয়া উপাধি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আমরা ভুল প্রমাণিত করেছি। যা পারিনি তা হলো আমাদের ভারত-বেষ্টিত বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটাতে। এ ছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য অংশীদার ভারত যখন নির্দলীয় আন্দোলনের (Nonaligned movement)-এর প্রবক্তা, তখন বাংলাদেশের পক্ষে অন্য কোনো বৃহত্তর শক্তির নিরাপত্তাবলয়ে সম্পৃক্ত হওয়া বাস্তবসম্মত ছিল না। তার ওপর ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সন্ধিস্থানে ও বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী হওয়ার কারণে একটা জুতসই পররাষ্ট্র নীতিমালা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলোকে শক্তিতে রূপান্তর করতে পারে। বৃহৎ শক্তির তেমনি আর একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিস্থিতিতে আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অনেকটা অভ্যন্তরীণ নীতিমালা প্রভাবিত। তাই আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে কখনো ভারতমুখী বা ভারতবিরোধী ও পাকিস্তানমুখী বা পাকিস্তানবিরোধী মনে করা হতো। শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা কখনো যুক্তরাষ্ট্র-চীন-পাকিস্তান ব্লক বা ভারত-সোভিয়েত ব্লকে সম্পৃক্ত ছিলাম বলে ধারণা করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কোনো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে চরম বৈরিতার পর যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্য সুসম্পর্ক বিদ্যমান। একইভাবে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যেও এককালে চরম বৈরিতা ছিল। সময় ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে এ সম্পর্কের সমীকরণ বদলাতে পারে। যাই হোক, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি আজ একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী কয়েক বছর বাংলাদেশ ছিল কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতি অর্জন ও জাতিসংঘে নিজেদের অবস্থান সংহত করাই ছিল আমাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রতিপাদ্য বিষয়। তবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারত-কেন্দ্রিক হওয়ার পেছনে কারণও ছিল। যেমন সদ্যসমাপ্ত বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতের অবদান, ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাবর্তন, ২৫ বছর মেয়াদি ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব চুক্তি, ফারাক্কা বাঁধ ও গঙ্গার পানিবণ্টনসহ অর্থনৈতিক বিষয়াদি। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য ১৬ মার্চ, ১৯৭২-এর মধ্যে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের আগেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মন্দা সম্পর্কের শুরু হয়েছিল, যা ১৯৭৫-ভারত পরবর্তী সময়ে প্রকট রূপ ধারণ করে। সম্পর্কের তিক্ততা শুরু হয়েছিল ফারাক্কা বাঁধের সুষ্ঠু পানিবণ্টন নিয়ে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বলাই যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কখনই এতটা মধুর ছিল না যতটা ভাবা হয়। তবে ভারতমুখী বা ভারতবিমুখী এর কোনোটাই নয়, বরং আমাদের প্রয়োজন একটা বাংলাদেশমুখী পররাষ্ট্রনীতি।

অনেক প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অন্য কোনো রাষ্ট্রের স্বার্থোদ্ধারে ব্যবহার হতে পারে না। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পররাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা পালন করেন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোটের ধারণা মরহুম জিয়াউর রহমানের; যদিও দুটি পরমাণু ক্ষমতাধর দেশ চিরশত্রু ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতার জন্য এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। আমাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে বেশ কিছু আরব দেশ অমুসলিম ভারতের সহায়তায় বৃহত্তর মুসলিম দেশ পাকিস্তানের ভাঙনকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মুসলিম দেশসমূহের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে মনোনিবেশ করেন। আরব দেশসমূহের মধ্যে একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল পাকিস্তানকে ভাগ করতে মরিয়া ছিল। যাই হোক, স্বাধীনতা-উত্তর বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করে আমরা ইসরায়েল-বিরোধী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করি। তবে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সুসম্পর্কের জেরেই গড়ে উঠেছে আমাদের বড় শ্রমবাজার যার মাধ্যমে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে।

এ ছাড়া ১৯৭১-এর যুদ্ধে চীন কৌশলগত কারণেই পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করে আর একই কারণে চীন ’৭৫-পরবর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে এগিয়ে আসে। হয়তো এ কারণেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে চীনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে দেখতে বলেছিলেন। ভারতের বিরক্তি সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন যাবৎ চীন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অস্ত্র-গোলাবারুদ আমদানির বিশ্বস্ত সূত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এর পেছনে অবশ্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের চীনের তৈরি অস্ত্রের প্রতি এক ধরনের পরিচিতি ও আস্থা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অবিভক্ত পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় মূলত চীনা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালেও পররাষ্ট্রনীতি অনেকটা অপরিবর্তিত ছিল।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশ জুড়েই ভারতবর্ষকে যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যে অঘোষিত Great Game-এর অংশ মনে করা হতো। ভারতবর্ষের সে গৌরব ১৯৪৭-এর পর না থাকলেও তার অবস্থানগত সুবিধা, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সীমান্ত ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভারতকে ভূকৌশলগতভাবে বেশ সুবিধা প্রদান করেছে। যদিও সমন্বিত নিরাপত্তাবোধ বিঘ্নিত হওয়ায় কিছু নতুন সমস্যার তৈরি হয়েছে। প্রথমত ভারত বিভাজনের সময় অর্জিত তিক্ত অভিজ্ঞতা ও কাশ্মীর সমস্যা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক তৈরি করেছে। এ এলাকার ছোট দেশসমূহ বড় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে আগ্রহী হয়। এ ছাড়া কৌশলগতভাবে যেসব বড় দেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক নেই তারাও এ অঞ্চলে নাক গলানোর সুযোগ পায়। আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোর অভাব চীনকে এ অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর একে অন্যের সঙ্গে সাধারণ সীমান্ত না থাকায় তা নিরাপত্তা ভাবনায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। চীনের সঙ্গে ভারতের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার সীমানা রয়েছে। আর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমানা। এ অঞ্চলে শ্রীলঙ্কা ছাড়া প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের সঙ্গেই ভারতের সীমানা রয়েছে। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারতের সমস্যা থাকলেও একে অন্যের সঙ্গে সমস্যা তৈরির ক্ষেত্র বেশ সীমিত। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে তার ছোট প্রতিবেশী দেশসমূহের উদ্ভূত সমস্যাগুলো তা-ই প্রমাণ করে। ভারতের এ আধিপত্য খর্ব করতে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন একটা কার্যকর কৌশল হতে পারে। ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত তার একটা বড় দুর্বলতা। ১৯৬২ ও ২০২০-এর চীন সীমান্ত সংঘর্ষ তা প্রমাণ করে। ১৯৭১-এর যুদ্ধেও চীন সীমান্ত নিয়ে ভারতের মাথাব্যথা ছিল লক্ষণীয়। একই কারণে ভারতীয় সেনাপ্রধান শ্যাম মানেকশ ১৯৭১-এর চূড়ান্ত যুদ্ধ শীত মৌসুমে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া একদিকে পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন পাকিস্তান ও অন্যদিকে চীন সব সময়ই ভারতের অস্বস্তি তৈরি করতে যথেষ্ট।

ভারত মহাসাগর দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৮৩ হাজার বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে, যা সমুদ্রে চলাচলকারী পৃথিবীর মোট জাহাজের ৪০%। যোগাযোগ আর বাণিজ্য যে কোনো অঞ্চলের গুরুত্ব বুঝতে সহায়তা করে। চীন এককভাবে পৃথিবীর ২৪% জ্বালানি খরচ করে, যা দিয়ে ভারত মহাসাগরের ওপর চীনের নির্ভরতা পরিষ্কার বোঝা যায়। বিগত বছরগুলোয় চীন অর্থনৈতিক লক্ষ্য সুরক্ষা করতে ভারত মহাসাগরে তার প্রভাব এতটাই বৃদ্ধি করেছে যে, ভারতীয় ও আমেরিকার সামরিক বিশারদরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী ভারত-চীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে এগিয়ে এলেও সাম্প্রতিক সময়ে আমরা উভয় দেশের সীমান্তে বেশ উত্তেজনা লক্ষ্য করছি। যখন করোনা নিয়ে বিশ্বের সবাই ব্যস্ত, সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে চীন তার বৈশ্বিক উচ্চাকাক্সক্ষা প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। পাশাপাশি চীন ভারতের চারদিকে অবস্থিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়নে মনোনিবেশ করছে। এই পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতের আঞ্চলিক শক্তির তকমাটিও যেন ঝুঁকির মুখে।

চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, চীন বাংলাদেশের জন্য জুতসই ও কার্যকর অস্ত্র-গোলাবারুদের ঠিকানা এবং উন্নয়নের বড় অংশীদার। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপড়েনে চীনের কাছ থেকে মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা লাভ। অন্যদিকে চীন চাইবে দক্ষিণ এশিয়ায় তার অবস্থান সংহত করতে, অর্থনৈতিক সুযোগ, জ্বালানি নিরাপত্তা, যোগাযোগ উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থন সংগ্রহ করতে ও ভারতকে ধারণ করার জন্য অভিন্ন কৌশল নির্ণয় করতে।

আওয়ামী লীগ বিগত বছরগুলোয় ভারতের সঙ্গে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করে আসছে। যে কোনো দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে শেখ হাসিনার সমর্থন ও সহযোগিতা অতীতের যে কোনো সরকারের চেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল। যেমন ছিটমহল হস্তান্তর, পানিবণ্টন, যোগাযোগ, সন্ত্রাস দমন, উন্নয়ন প্রকল্পসহ আরও অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পরিষ্কার সহযোগিতামূলক। কিন্তু এর বিনিময়ে বাংলাদেশ তার কাক্সিক্ষত তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়নি। তবে বিগত সময়ে বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশি নাগরিকদের অধিক হারে ভারত ভ্রমণের সুযোগ দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ নিতে ভুল করেনি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভারত রাজ্য সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে তথাকথিত বিশ্বস্ত বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ককেই খাটো করেছে।

এ অবস্থায় ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কোন্নয়নে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কে এক নতুন ও নিতান্তই সময়োপযোগী মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আর সম্পর্কের এই নুতন মোড় এমন একটা সময়ে উন্মোচিত হলো যখন চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড়াও নতুন কিছু প্রকল্পে ৬.৪ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে। নতুন প্রকল্পসমূহের মধ্যে তিস্তা নদীর খনন, পানি সংরক্ষণসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি দিল্লির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ ছাড়া সম্প্রতি চীন বাংলাদেশি ইমপোর্টের ওপর শূন্য ডিউটি প্রদান করেছে। ঠিক এর পরই যেন দিল্লির টনক নড়েছে। আমরা ভারতের পররাষ্ট্র সচিবকে জরুরি ঢাকায় এসে এ বিষয়ে আলোচনা করতে দেখেছি। এমনকি ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশসহ তার চারপাশে অবস্থিত সব ছোট দেশ চীনের ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে বলে সংবাদ পরিবেশন করছে। সীমান্তে বিএসএফ গুলিবর্ষণ করে বাংলাদেশি হত্যা করেছে। মেক্সিকোর সীমান্তে একজন মানুষ গুলিতে প্রাণ হারালে তা সংবাদ শিরোনাম হয়। সেখানে ভারত নির্বিচারে সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশি হত্যা করছে। এ বিষয়ে আমরা না দেখছি কোনো প্রতিকার না কোনো প্রতিবাদ। এ ছাড়া সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন ইস্যুতে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর আস্ফালন আমাদের বিরক্তি ধরিয়েছে। বিজেপির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যু যেন তার বিদেশনীতিকেই গিলে ফেলেছে।

রোহিঙ্গা বিষয়ে চীনের নীরবতা মিয়ানমারের পক্ষেই কথা বলেছে। বিশ্বায়নের এই সময়ে আন্তরাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগ প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা-পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রই যখন মিয়ানমারকে তিরস্কার করছে, তখন সে আরও চীনমুখী হবে- এটাই স্বাভাবিক। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সবচেয়ে বড় বিস্ময় ছিল যখন প্রতিবেশী ভারত রোহিঙ্গা প্রশ্নে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। এমনকি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দচয়নেও ছিল দেশটির প্রচ- অনীহা। উল্লেখ্য, জুলাই, ২০১৯-এ ভারত-মিয়ানমারের মধ্যে সামরিক সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে যার আওতায় ভারতীয় সামরিক বাহিনী মিয়ানমারকে আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এ ছাড়া মিয়ানমারে ভারতীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি নয়াদিল্লি চাইছে এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকতে যেন মিয়ানমার অধিক মাত্রায় চীননির্ভর হয়ে না পড়ে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশর উদার নীতিমালা ভঙ্গুর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি কিছুটা চাঙ্গা করলেও রাশিয়া, চীন, ভারত কেউ এ সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে আমাদের পাশে নেই। আর ভারত ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাস কতট ফলপ্রসূ হবে, তা বলা কঠিন। এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অনাগত দিনে জাতির জন্য চরম পরিণতি বয়ে আনবে। তার ওপর চীন-ভারতের বৈরিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পারবে কি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কোনো আনুকূল্য আদায় করতে? নিশ্চয়ই পররাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবনার এখনই সময়।

                লেখক : গবেষক, শিক্ষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা।

সর্বশেষ খবর