বাংলাদেশে প্রথম প্রাইভেট বায়োটেকনোলজি গবেষণাগার তৈরি করলাম ১৯৯৭ সালে। ৮০০ বর্গফুটের এ গবেষণাগারে অর্কিডের টিস্যু কালচার করতে করতে আলুর বীজ নিয়ে একটু পড়াশোনা শুরু করলাম। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাদের কাছে একটি বই পেলাম। তাতে লেখা- ১৯৭৩ সাল থেকে বিদেশি জাতের আলুর ওপর বাংলাদেশে কাজ হচ্ছে এবং আলুর বীজগুলো আমদানি হয় ভিত্তি বীজ (foundation seed) হিসেবে। নেদারল্যান্ডস ও জার্মানি থেকে আমদানিকৃত এ বীজ বিএডিসি চুক্তিভিত্তিক উৎপাদকের মাধ্যমে সার্টিফায়েডভাবে উৎপাদন করে কৃষকের কাছে বিক্রি করে। এটা মোটামুটি ডায়মন্ড শ্রেণির সাদা আলু যা মুন্সীগঞ্জে বেশি হয়। এবার মুন্সীগঞ্জে গিয়ে জানতে পেলাম এ আলুর বীজ নিয়ে কৃষক নানাভাবে প্রতারিত হয়। কাঠের বাক্সের আলুতে অর্ধেক থাকে সাধারণ আলু, বাকি অর্ধেক আমদানিকৃত আলু। বিএডিসি আরও জানাল, ভাইরাসমুক্ত আলুবীজের চাহিদা বাংলাদেশে বছরে ৭ লাখ টন। আলুবীজ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। আলুর প্রধান সমস্যা ভাইরাস রোগ যার কোনো ওষুধ নেই। একমাত্র টিস্যু কালচার পদ্ধতিতেই ভাইরাসমুক্ত করা যায়। এর জন্য সময় লাগে সাত বছর। ইতিমধ্যে রাজশাহীতে প্রফেসর মঞ্জুর কাজ শুরু করলেন। আলুর ফলন পেলাম সাত বছরের মাথায়। কৃষক আলুর ফলন দেখে অবাক। কিন্তু এত ছোট ল্যাবে টাকার অভাবে বাণিজ্যিকভাবে করতে পারছিলাম না। মনে আছে নিশ্চয়ই, ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ‘বেশি করে আলু খান/ভাতের ওপর চাপ কমান’ বলে সারা বাংলাদেশে রোড শো হয়েছে। কিন্তু কখনই আলুর দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। যদিও আলু এখন বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম ফসল। ২০১১ সালে সরকার আলু রপ্তানির জন্য শতকরা ২০ ভাগ প্রণোদনা ঘোষণা করল। আলু রপ্তানি হতে শুরু করল। কিন্তু বাজার খুব ছোট মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা। তবে বারবার উৎপাদিত আলুর দাম এ পর্যায়ে পড়ে যাওয়ায় সরকার কোনো পদক্ষেপ নিল না। ২০১১ সালে কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা টনপ্রতি আলু সংরক্ষণের ভাড়া ১৫০-২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫০ টাকা করে দেয়; তখনো সরকারকে কোনোরকম পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এদিকে আলুর দাম না পাওয়ায় আমাদের রোগমুক্ত আলুবীজ নিতে কৃষক আর আগ্রহ প্রকাশ করল না এবং ভালো বীজ ব্যবহার না করায় রপ্তানিযোগ্য আলু পাওয়ায় একটু সমস্যা হয়ে গেল। ২০১৮-১৯ সালে এ সেক্টরে সবাই ১২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হলো, আমার আড়াই হাজার টন আলুবীজে ক্ষতি হলো ১০ কোটি টাকা, কিন্তু কেউই আমাদের পাশে দাঁড়াল না। কৃষক আলু গরুকে খাওয়াল, নদীতে ফেলল। বিএডিসি ও ব্র্যাক মাইকিং করে বীজ বিতরণ করল। আমি টাকার অভাবে কোল্ড স্টোরেজ থেকে পরপর তিন বছর বীজ ছাড়াতে না পারায় কোল্ড স্টোরেজ আমার বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করল, ব্যাংকের দেনা আরও বেড়ে গেল। ল্যাব বন্ধ হয়ে গেল। সেই সঙ্গে কর্মহীন হয়ে গেলেন ৫ শতাধিক গ্রামীণ মহিলা ও আমার ল্যাবের বিজ্ঞানী, টেকনিশিয়ান ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী। অন্যদিকে বিদেশি কোয়ালিটির থেকে ভালো বীজের মূল্য মাত্র ৩ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করেও আমদানিকারকদের ষড়যন্ত্রের শিকার হই। গার্মেন্টের ক্ষেত্রে এ অবস্থা হলে কী হতো তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমাদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। তবে এ বছর কী হলো! কেন আলুর দাম সর্বকালের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে? এ বছর কৃষক কিন্তু মার্চ-এপ্রিলে কভিড-১৯-এর জন্য আলু মোটামুটি ৮-১০ টাকা মূল্যে কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের কাছে বা বিভিন্ন আলু সংরক্ষণকারী ব্যাবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ওটাই ছিল তাদের আলু বিক্রি করার সময়। মনে রাখতে হবে, কৃষক কিন্তু মে-র পর কোনোভাবেই আলু সংরক্ষণ করতে পারে না। বড় কিছু কৃষক ছাড়া ৯০ ভাগ কৃষক আলু মার্চ-এপ্রিলেই বিক্রি করে দেয় এবং তা যে মূল্যেই হোক। এখন পর্যন্ত প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষক তার উৎপাদিত আলু বা শাক-সবজি সংরক্ষণ করার কোনো সনাতন বা আধুনিক পদ্ধতির সুবিধা পায়নি। আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কেউ কোনো উদ্যোগও নেয়নি। তাই কৃষককে যে কোনো শাকসবজি আলু ইত্যাদি মাঠ পর্যায়ে খুব অল্প মূল্যে বিক্রি করে দিতে হয়। এতে তাদের মুনাফা দূরে থাক বিনিয়োগের টাকাও উঠে আসে না। ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাচবে’ মুখে যত কথাই বলা হোক এ স্লোগানে কৃষক কিন্তু বাঁচে না। বলতে বাধ্য হচ্ছি আমার জীবনের ৩০টি বছর কৃষকের সঙ্গে এবং নিজে কৃষিকাজ করে এটুকু বুঝেছি কৃষক একখ- জমিও পতিত রাখতে চায় না, কোনো দিন ছুটিতেও যায় না। ঈদ, পূজা, হরতাল, কভিড মহামারী সব সময় কৃষক ভোরবেলায় উঠে তার জমিতে যায় এবং কাজ করে আধপেট খেয়ে। কৃষক বীজে প্রতারিত হয়, সারে প্রতারিত হয়, কীটনাশকে প্রতারিত হয়, ন্যায্যমূল্যে প্রতারিত হয় তবু তারা উৎপাদন বন্ধ করে না। আর যে ফুলকপি কৃষক ২ টাকায় বিক্রি করে তা পাঁচ হাত ঘুরে শহরে এসে হয়ে যায় ৪০-৫০ টাকা! কৃষকের কোনো চেম্বার নেই, কোনো সমিতি নেই যে তারা এসবের প্রতিবাদ করবে। আমি করতে চেয়েছিলাম, পারিনি। সে কাহিনি আরেক দিন লিখব।
যে কথা বলছিলাম, আলুর দাম কেন ৫০ টাকা? আমার সেলের ৩৬ হাজার রেজিস্টার্ড কৃষক আছে তারা উত্তরবঙ্গে আলু বিক্রি করেছে ৭-৮ টাকা দরে এবং এ আলুগুলো কিনেছে কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা এবং অন্য ব্যবসায়ীরা কারণ ব্যাংক এ সময় আলু কেনার জন্য কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের ঋণ দেয়। এ বছর কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও অন্য ব্যবসায়ীরা প্রচুর আলু কিনে রেখে ছিল যা আমি ওই সময় উত্তরবঙ্গ ঘুরে দেখে এসেছি। এরপর উত্তরবঙ্গের বন্যা, বৃষ্টি, সবজি উৎপাদনে ঘাটতি, এ লকডাউনে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় আলু কেনার দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়ে আর এ সুযোগটাই নিচ্ছে এখন কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও আলু ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় আলুর সর্বোচ্চ দাম হতে পারত ২০ থেকে ২৫ টাকা। সরকার যদিও দাম বেঁধে দিয়েছে ৩৫ টাকা কিন্তু আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা। তাহলে এ টাকাটা যাচ্ছে কার হাতে? ৭ টাকা বিক্রি করা কৃষকের হাতে, না কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের হাতে? যদি এ মাসের মধ্যে বন্যার পানি নেমে যায় তবে বিশেষ জাতের আলু উঠতে উত্তরবঙ্গে ডিসেম্বরের শেষাশেষি লেগে যাবে। বাণিজ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গের আলু এলাকার মানুষ; তিনি সব জানেন। এখনই যদি এ সিন্ডিকেট ভেঙে কোল্ড স্টোরেজের আলুগুলো বের করে দেওয়া না হয় তাহলে একটি পর্যায়ে এসে প্রায় ১০-১৫ লাখ টন আলু থেকে যাবে। যারা আজ বেশি লাভের আশায় সিন্ডিকেট করছে তারাও ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেওয়ার সুযোগ খুঁজবে। মনে রাখতে হবে, এ বছর ২৫ লাখ টন উৎপাদিত আলু রয়ে গেছে। প্রতি বছর ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টন আলু রপ্তানি হয়। এ বছর তা মাত্র ২০ হাজার টনের মতো হয়েছে। আমার শেষ কথা : সিন্ডিকেট ভাঙুন, জনগণকে বাঁচান, দেশ বাঁচান। এ মহামারীতে একবার অত্যন্ত মানবিক হয়ে উঠুন।
লেখক : কৃষক ও উদ্ভিদ প্রযুক্তিবিদ।