রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পরমতসহিষ্ণুতা-অসহিষ্ণুতার সীমা

তুষার কণা খোন্দকার

পরমতসহিষ্ণুতা-অসহিষ্ণুতার সীমা

২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি ফ্রান্সের ব্যঙ্গ পত্রিকা শার্লি এবদো অফিসে সন্ত্রাসীরা সাংবাদিকদের গুলি করে হত্যা করেছিল, কারণ পত্রিকাটি এমন কিছু ব্যঙ্গচিত্র ছেপেছিল যা মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করেছিল। কোনো ব্যক্তি কিংবা সম্প্রদায় তাদের ধর্মবিশ্বাস কিংবা মূল্যবোধের বিষয়ে অতিসংবেদনশীল হতে পারে। কেউ তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করলে তারা সে ঘটনার প্রতিবাদ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যখন কেউ সহিংস হয়ে ওঠে তখন তা আর সভ্য প্রতিবাদ বলে গ্রহণ করা যায় না। তখন তাকে সন্ত্রাসমূলক ঘটনা বলে আমরা নিন্দা করতে বাধ্য হই। স্মরণ করে দেখুন, শার্লি এবদোর পাতায় প্রকাশিত ব্যঙ্গচিত্র, তার প্রতিবাদ করার নামে পত্রিকাটির অফিসে আক্রমণ করে সাংবাদিক হত্যা এবং সেই নৃশংস ঘটনার জেরে শুধু ফ্রান্সে ১৭ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। শার্লি এবদোর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নাইজেরিয়ায় মারা গিয়েছিল আরও পাঁচজন। এমন নৃশংস হত্যাকান্ডে  নিহতরা কে কোন পক্ষ তার তথ্য তালাশ করার নির্বুদ্ধিতা না দেখিয়ে আমি বলতে পারি- যারা মারা গিয়েছিল তারা সবাই মানুষ। একটি পত্রিকার পাতায় একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন কার্টুন ছাপানোকে কেন্দ্র করে এতগুলো মানুষকে নৃশংস উন্মত্ততার বলি হতে হলো। আমরা, শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসী নরহত্যার মতো নৃশংসতাকে কখনো স্বাভাবিক প্রতিবাদের ভাষা বলে গ্রহণ করি না। ২০১৫ সালে ১০ লাখ মানুষ শার্লি এবদো হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানানোর জন্য প্যারিসের রাস্তায় জমায়েত হয়েছিল। বিশ্বের ৩০টি দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ মিছিলে যোগ দিয়ে জনতার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলেছিলেন, ‘আমিই শার্লি এবদো’। আমি ভেবেছিলাম, শার্লি এবদোয় প্রকাশিত ব্যঙ্গচিত্রের জেরে যে নৃশংস ঘটনা ঘটল এবং তার প্রতিবাদে সারা দুনিয়ায় মানুষ শান্তিপূর্ণ উপায়ে যেভাবে প্রতিবাদ করল এতে উভয় পক্ষের বোধোদয় হলো। উভয় পক্ষের বোধোদয় বলতে আমি গণমাধ্যমগুলোর দায়িত্বশীলতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। গণমাধ্যমগুলো ভবিষ্যতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করবে না। তেমনি অন্য পক্ষ পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত কিছু শব্দ কিংবা কোনো ব্যঙ্গচিত্রকে ঘিরে নরহত্যার মতো পাপাচারে লিপ্ত হবে না। ২০১৫ সালে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ, তার প্রতিক্রিয়ায় প্রায় ২০ জন মানুষের প্রাণহানি এবং তার প্রতিবাদে প্যারিসের রাস্তায় ১০ লাখ মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মধ্য দিয়ে একটি অশান্তিপূর্ণ অধ্যায়ের অবসান হয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা নির্মূল করে দিয়ে ফ্রান্সে আবার অশান্তির আগুন জ্বলে উঠল। আপনারা ভেবে দেখুন এটি কেমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যা কিনা পাঁচ বছর আগে মিটে যাওয়া তিক্ততাকে টাটকা করে তুলল। এবার পত্রিকাটি নতুন করে কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যঙ্গচিত্র ছাপেনি। ২০২০ সালের অক্টোবরে প্যারিসের উপকণ্ঠে একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক প্যাটি তার ছাত্রদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার গুরুত্ব বোঝাতে চেয়েছিলেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার রকম বোঝাতে গিয়ে তিনি ছাত্রদের শার্লি এবদোয় প্রকাশিত ব্যঙ্গচিত্র দেখিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার চেচেন থেকে এসে ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহণকারী এক মুসলিম পরিবারের ১৮ বছর বয়সের ছেলে আবদোল্লাখ আনজোরভ সেই শিক্ষক প্যাটিকে ছুরি মেরে হত্যা করেছে। আনজোরভ নামের চেচেন ছেলেটিকে পুলিশ গুলি করে মেরেছে। একজন শিক্ষকের মৃত্যু কিংবা ১৮ বছর বয়সী একজন কিশোরের মৃত্যু কোনোটিই কি গ্রহণযোগ্য? শুরুতে সবাই ভেবেছিল ছেলেটি অতি আবেগের বশে একাই এমন জঘন্য হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু পরে পুলিশি তদন্তে আনজোরভের পেছনে ক্রিয়াশীল আরও অনেকের পরিচয় বেরিয়ে আসছে। ভেবে দেখুন, মাত্র ১৮ বছর বয়সী একটি কিশোরের ব্রেন ওয়াশ করে যারা এমন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর কাজ করিয়ে নিল তারা বেঁচে আছে! শিক্ষক প্যাটির পরিবার এবং আনজোরভের পরিবারের জন্য সামনে শুধুই বেদনা।

এ ধরনের প্রতিহিংসামূলক দুঃখজনক ঘটনার অবসান কবে কোথায় এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দুনিয়াকে মত প্রকাশের সীমা সম্পর্কে সহনশীলতার সঙ্গে ভাবতে হবে।

গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ সমাজে সব সম্প্রদায় এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করে, কারণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের মৌলিক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা কি সীমাহীন? মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিধি কি অনন্ত? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে ক্যাথলিক দুনিয়ার ধর্মগুরু মাননীয় পোপ ফ্রান্সিসের মতামতকে আমাদের অসীম গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতে হবে। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারির শার্লি এবদো হত্যাকান্ডের বিষয়ে পোপ তাঁর সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমা আছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, কেউ আমার মাকে নিয়ে কটূক্তি করার অধিকার রাখে। সত্যি যদি কেউ আমার মাকে নিয়ে কটূক্তি করে তাহলে তাকে ঘুষি মারার অধিকার আমার আছে।’ মাননীয় পোপ খ্রিস্টধর্মের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের অভিভাবক। প্রভু যিশু বলেছেন, কেউ তোমার এক গালে চড় মারলে তুমি তাকে আরেক গাল পেতে দাও। পোপ তাঁর নবী যিশুর শিক্ষা সম্পর্কে নিশ্চয়ই ভালো করেই জানেন। তার পরও প্রভু যিশুর উদারতার বাণীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তিনি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত মানবিক অনুভূতি প্রকাশের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। সাধারণ মানুষ তার আজন্ম লালিত ধর্মীয় মূল্যবোধের ব্যাপারে সব সময় অতি সংবেদনশীল। অনেক সময় ধর্মীয় মূল্যবোধ আহত হলে মানুষ তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য যুক্তির মুখ চেয়ে অপেক্ষা করে না। সংবেদনশীল বিষয়ে ঘা খেলে তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে তারা অনেক বড় অঘটন ঘটিয়ে বসে। পোপ মানুষের অতি আবেগী সংবেদনশীলতার দিক সহজ করে তুলে ধরেছেন। একজন ধর্মযাজক পোপ সাধারণ মানুষের মানবিক অনুভূতি সম্পর্কে এতটা সংবেদনশীল অথচ ইসলাম ধর্ম নিয়ে এমন উৎকট রংতামাশার পরিণাম কী হতে পারে ফ্রান্সের রাজনীতিবিদরা একবারও ভেবে দেখার তাগিদবোধ করেন না কেন? ফ্রান্সের রাজনীতিকরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে সমাজে ঘৃণা সৃষ্টির মতো একটি উপাদানকে এত দূর কেন বাড়তে দিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ফ্রান্সের রাজনীতিবিদরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে তাঁদের দায়িত্বহীনতার পক্ষে সাফাই গাইবেন। এমন জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে আমি প্রশ্ন করছি, ইউরোপে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে যা খুশি তাই লেখার কিংবা বলার অবাধ অধিকার কি সবার আছে? মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার নামে ইউরোপের কোনো দেশ কি কোনো মানুষকে ফ্যাসিবাদ কিংবা নাজিবাদের পক্ষে প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালাতে দেবে? নিশ্চয়ই নয়। ২০১২ সালের দিকে জার্মানির অল্পবয়সী একটি মেয়ে বলেছিল, ‘হোলোকাস্ট যত না বাস্তব তার চেয়ে বেশি বানোয়াট গল্প’। অর্থাৎ মেয়েটি বিশ্বাস করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি নিধনের জন্য নাজিবাহিনী বাস্তবে যে মাত্রায় নৃশংসতা দেখিয়েছে পরিবর্তিত অবস্থায় বিরুদ্ধপক্ষ সেটাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে বলছে। এটুকু বলার অপরাধে জার্মান কর্তৃপক্ষ অল্পবয়সী মেয়েটিকে জেলে পাঠিয়েছিল। কম বয়সী জার্মান মেয়েটির মতামতের সঙ্গে আমি মোটেও একমত নই কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমা ইউরোপীয় দেশগুলো মানে কি মানে না তার উদাহরণ হিসেবে বিষয়টি উল্লেখ করলাম। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত  হয়েছে, কোনো কোনো বিষয়ে ইউরোপে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমা এত সংকুচিত যে ইহুদি নিধনকে অতিকথন বললেও সেসব দেশের নাগরিককে জেলের ঘানি টানতে হয়। অথচ মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে শার্লি এবদো বছরের পর বছর দুনিয়াজোড়া মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলেও তাদের শোধরাবার শক্তি কিংবা সদিচ্ছা ফ্রেঞ্চ সরকারের নেই। শার্লি এবদোর দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণকে ফ্রান্সের সে সময়ের প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক বলেছিলেন, ‘প্রকাশ্য উসকানি’। এমন উসকানিমূলক কাজের পরিণাম ভালো হবে না বলে জ্যাক শিরাক অনুমান করেছিলেন। জ্যাক শিরাক যখন শার্লি এবদোর আচরণের প্রতিবাদ করেছিলেন তখন তাঁর দুজন উত্তরসূরি নিকোলাস সারকোজি এবং ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ শার্লি এবদোর নোংরামিকে ফ্রান্সের মানুষের স্বভাবজাত তামাশার ঐতিহ্য বলে পত্রিকাটির পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। জ্যাক শিরাক তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দিয়ে শার্লি এবদোর আচরণকে সঠিক মূল্যায়ন করেছিলেন বলে বিষয়টিকে উসকানি বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ফ্রান্স সরকার তাঁর মন্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে পত্রিকাটির নোংরা উসকানি সময়মতো বন্ধ করার পদক্ষেপ নিলে ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারির মর্মন্তুদ ঘটনা যেমন এড়ানো যেত তেমনি সে ঘটনার জেরে ২০২০ সালে ফ্রান্সে যে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে তার পথ বন্ধ হতো। ২০১৫ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মানুয়েল ভালস বলেছিলেন, ‘আমিই শার্লি এবদো- দুনিয়ার কাছে এটাই আমাদের একমাত্র বার্তা নয়। ফ্রান্স মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে লালন করার পাশাপাশি অন্যদের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে থাকে।’ ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীর মুখের কথার বাস্তব প্রয়োগ দেখা গেলে ফ্রান্স একা নয় আমরা সবাই বাড়তি অশান্তির হাত থেকে রক্ষা পেতাম। ফ্রান্সে বারবার যে নৃশংস ঘটনা ঘটছে তা দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষের কাম্য হতে পারে না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর