রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বিপ্লবী মহারাজ ও একটি স্মৃতি গ্রন্থাগার

সৌরেন চক্রবর্ত্তী

বিপ্লবী মহারাজ ও একটি স্মৃতি গ্রন্থাগার

তিনি কখনো রাজা ছিলেন না, তবু মহারাজ। মহারাজ নামে পরিচিত, মহারাজের মতোই ছিল তাঁর উন্নত জীবনাদর্শ, কঠোর ন্যায়নীতি, তপস্যা ও দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসার অঙ্গীকার। সত্যিকার মহাপুরুষের মতো আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা, সততার চর্চা করেছেন আজীবন। তিনি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। বিপ্লবী কর্মকান্ডের কারণে যারা এ উপমহাদেশে পরিচিত হয়েছিলেন তিনি তাদের অন্যতম। তাঁর জন্ম ১৮৮৯ সালের ৫ মে (মতান্তরে ২ আগস্ট) তদানীন্তন ময়মনসিংহ জেলা, বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ার চর উপজেলার কাপাসাটিয়া গ্রামে। প্রবেশিকা পরীক্ষার ঠিক আগেই ১৯০৮ সালে বিপ্লবাত্মক কাজের জন্য গ্রেফতার হলে এখানেই তাঁর প্রথাগত শিক্ষার ইতি হয়। ১৯০৬ সালে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন। জাতীয়ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যায়াম-প্রতিষ্ঠান গঠন করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নিজ জেলায় বিপ্লবী ঘাঁটি তৈরি করতে থাকেন। ১৯০৯ সালে ঢাকায় আসেন এবং ‘ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা’য় পুলিশ তাঁর সন্ধান শুরু করলে আত্মগোপন করেন। ১৯১২ সালে গ্রেফতার হন। ব্রিটিশ সরকার একটা হত্যা মামলায় তাঁকে জড়ালেও জোরালো প্রমাণের অভাবে মুক্তি পান। ১৯১৩-১৪ সালে রাজশাহী, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে সংগঠন গড়তে থাকেন। ১৯১৪ সালে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে ‘বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করে আন্দামানে পাঠায়। ১৯২৪ সালে মুক্তি পেয়ে দেশবন্ধুর পরামর্শে দক্ষিণ কলকাতার জাতীয় বিদ্যালয়ের ভার গ্রহণ করেন। ১৯২৭ সালে গ্রেফতার হয়ে বার্মার মান্দালয় জেলে প্রেরিত হন। ১৯২৮ সালে তাঁকে নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপে অন্তরিন করে রাখা হয়। ১৯২৯ সালে লাহোর কংগ্রেসে যোগ দেন মহারাজ। পুনরায় ১৯৩০ সালে গ্রেফতার হয়ে ১৯৩৮ সালে মুক্তি পান। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে আবার গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৬ সালে মুক্তি পেয়ে নোয়াখালীতে সংগঠন গড়ার চেষ্টা করেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি মাতৃভূমিকে ভালোবেসে নিজ গ্রামে রয়ে যান; রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে জনগণের কল্যাণে বিভিন্ন রকম কার্যক্রম গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (গচঅ) নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হলে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়েন। পরাধীন ভারতবর্ষে ৩০ বছর জেল খাটার পর ১৯৬৫ সালে পুনরায় গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। জেলে স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটলে মুক্তি পান।

মহারাজ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে ৩০ বছর জেল ও পাঁচ বছর অজ্ঞাতবাসে কাটান। রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে জেলজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় তাঁর জীবন ছিল ঋদ্ধ। জেলকোডে যেসব শাস্তির কথা লেখা আছে এবং যেসব শাস্তির কথা নেই, তার প্রায় সবই তিনি জেলজীবনে ভোগ করেছিলেন। জেলের বাইরের জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি কাটিয়েছেন মানবকল্যাণে, মানুষের শুভচিন্তায়।

১৯৭০ সালে চিকিৎসার জন্য তিনি দিল্লি যান। চলতে থাকে চিকিৎসা। ভারতের পার্লামেন্টে ভাষণ দেওয়ার জন্য মহারাজকে আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। এ ছিল এক বিরল সম্মান। এ সম্মানের পরপরই ১৯৭০ সালের ৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াত মহারাজকে সম্মান জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, জগজীবন রামসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতা। পরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানে তাঁর লাশ কলকাতায় আনা হয়। কেওড়াতলা শ্মশানঘাটে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ঢল নাম জনতার। সেখানেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীসহ বহু বিশিষ্টজন শ্রদ্ধা জানান মরদেহে। অবসান ঘটে এক মহান বিপ্লবীর বর্ণাঢ্য জীবনের। একই সালের ১৫ আগস্ট ঢাকার ফরাশগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর সম্মানে স্মরণসভা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, ফণীভূষণ মজুমদার, ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, ড. জি সি দেব, সৈয়দ আলতাফ হোসেনসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।

২০০১ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিশোরগঞ্জের কুলিয়ার চরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে  আমাকে পদায়ন করে। মহারাজের লেখা ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বইটি ছাত্রজীবনে আমার পড়া। কর্মস্থলে যোগদানের পরপরই জানতে পারি মহারাজের জন্ম এখানেই! স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে কাপাসাটিয়া গ্রামে তাঁর জন্মভিটা পরিদর্শন করি। কিছুদিন পর স্থানীয় বয়স্ক জ্ঞানী-গুণী মানুষ যাঁরা মহারাজকে কাছ থেকে দেখেছেন তাদের নিয়ে মহারাজের স্মরণে কিছু একটা করার জন্য ব্যগ্র হয়ে পড়ি। যেহেতু উপজেলা সদরে কোনো পাবলিক লাইব্রেরি নেই এবং উপজেলা কম্পাউন্ডে কোনো শহীদ মিনার নেই সেহেতু উপজেলা পরিষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে মহারাজের স্মরণে ‘মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী স্মৃতি গ্রন্থাগার’ এবং ভাষাশহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ করি।

২০০১ সালে পুরাতন কোর্ট বিল্ডিংয়ের একটি কক্ষে গ্রন্থাগারের সূচনা হলেও ২০০২ সালে নিজস্ব ভবন নির্মাণ শেষে গ্রন্থাগারটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব পায় এবং একটি গঠনতন্ত্রও প্রণয়ন করা হয়। গ্রন্থাগারটি এলাকার শিক্ষার্থী, গণ্যমান্য ব্যক্তি, কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বিশেষে সবারই একটি মিলনকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আলোকিত মানুষ তৈরিতে এ গ্রন্থাগার ভূমিকা রাখছে।

২০১৯-এর জানুয়ারিতে আমার স্মৃতিময় কর্মস্থলটি পরিদর্শন করি। ইতিমধ্যে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এ গ্রন্থাগার পরিদর্শন করেছেন। আমরা জানি ‘মানুষ হয়ে কেউ জন্মায় না, তাকে স্বচেষ্টায় মানুষ হতে হয়।’ কুলিয়ার চর উপজেলার এ গ্রন্থাগার মানুষকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার প্রেরণা জোগাবে- এটাই আজকের দিনে আমাদের প্রার্থনা।

 

                লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব।

সর্বশেষ খবর