সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

৭ অক্টোবর অটো পাস দিবস নাকি...!

ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন

৭ অক্টোবর অটো পাস দিবস নাকি...!

৭ অক্টোবর, ২০২০ সাল। ভাবনার বাইরে হঠাৎ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির মুখ থেকে ঘোষণা এলো উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অটো পাস। ফলাফল নির্ধারণ করা হবে, এসএসসি ও জেএসসির ফলাফলের ওপর নির্ভর করে। এবারের পরীক্ষার্থী প্রায় ১৪ লাখ, শতভাগ পরীক্ষার্থীকে পাস করানো হবে, ফেল করানো হবে না কাউকে, এরই অপর নাম ‘অটো পাস’। উচ্চশিক্ষার প্রবেশদ্বারে এসে স্বপ্নে বিভোর শিক্ষার্থীরা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ল। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থায় টিকে থাকতে হবে বাংলাদেশকে। আর করোনা মহামারী নিছক শুধু এ দেশকেই নয়; নাড়া দিয়েছে সারা বিশ^ময় অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থাকে।

ইতিহাস থেকে মানব জাতি শিক্ষা নেয় না। দার্শনিক George Santayana বলেছেন, মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না বলেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে (Those who do not learn history are doomed to repeat it). নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে অটো পাস দেওয়া হয়। তবুও পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার গতিপথ নির্ধারণের জন্য মেধার মাপকাঠি হিসেবে পাবলিক পরীক্ষাগুলো সংক্ষিপ্ত পাঠ্যক্রমে ও স্বল্প নম্বরে নেওয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সৃজনশীলতা পরিহার করে গাইড বই, নোটবই ব্যবহারের মাধ্যমে জন্ম নেয় অভিশপ্ত ‘নকল’। ১৯৭১ সালের প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষা সংঘটিত হয় ১৯৭২ সালে। এরই মধ্যে সৃষ্ট সেশনজট এড়ানোর জন্য ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দুটি ব্যাচকে একত্রিত করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের গ্রিডলক থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে দীর্ঘ দুই যুগ। তখন থেকেই বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা শিক্ষার জন্য বিদেশ পাড়ি জমাতে শুরু করে। তাই প্রশ্ন ওঠে, কার স্বার্থে, কী কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হলো!

এই ভূখন্ডে অটো পাসের প্রথা প্রথম নয়। অনেক সময় দেশের অস্বাভাবিক ও অনিবার্য কারণে উপায়ন্তর না পেয়ে সরকারকে অনেক অনাকাক্সিক্ষত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেমনটি হয়েছিল ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময়। সে সময় যারা ডিগ্রি পরীক্ষার্থী ছিলেন, তাদের বিনা পরীক্ষায় সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। যদিও পরবর্তীতে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। লোকে তাদের ‘পার্টিশন গ্র্যাজুয়েট’ বলে বিব্রত করত। ১৯৬২ সালে শরীফ কমিশন সুপারিশ করেছিল তিন বছরের ডিগ্রি পাস কোর্স। এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তা দুই বছরে ফেরত আনা হয়। তবে তৃতীয় বর্ষে যারা অধ্যয়ন করছিল, তারা বিনা পরীক্ষায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে। এদের জনগণ ‘অটো গ্র্যাজুয়েট’ নামে অভিহিত করত। আর ১৯৭২ সালের অটো প্রমোশনের গ্লানি আজও শেষ হয়নি। এবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে করোনা-১৯ মহামারীর কারণে নতুন সংযোজিত হলো ‘করুণা পাস’।

৮ মার্চ, ২০২০ প্রাণঘাতী করোনার প্রথম সূচনা ঘটল বাংলাদেশে। ১৮ মার্চ বিনা প্রস্তুতিতে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছুটি ঘোষণা হয়। স্বল্প ছুটি ঘোষণা দেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সঙ্গে না নিয়ে যার যার গ্রামের বাড়ি চলে যায়। পরবর্তীকালে ছুটি বাড়ানো হয় এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করা হয়। দেশের প্রান্তিক জনগণ ঈদের ছুটির মতো আনন্দে দলে দলে লঞ্চ, স্টিমার, বাসে বা ট্রেনে পৌঁছে যায় নিজ নিজ গন্তব্যে। করোনাকালে কীভাবে শিক্ষার্থীরা প্রাত্যহিক পড়াশোনা চালিয়ে যাবে, সে সম্পর্কে কোনো গাইডলাইন পায়নি। পরে ২৭ মার্চ, সব অফিস-আদালত ছুটি ঘোষণা করা হয়। জুন থেকে অফিস-আদালত ফের চালু হলেও বলা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে ৩১ অক্টোবর। তা আবারও বাড়িয়ে করা হলো ১৫ নভেম্বর।

বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থায় কভিড-১৯ কোনো দেশকেই ছাড় দেয়নি। শিক্ষার হাব নামে খ্যাত দেশগুলো যেমন ভারত, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, কানাডা বা আমেরিকাকে তাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন অনুসরণ করা যেতে পারত। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় উন্নত বিশ্বের কোথাও অটো পাস দেওয়া হয়নি। কোনো শিক্ষার্থীর মেধার মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষার বিকল্প হতে পারে শুধু পরীক্ষা, অন্য কিছু নয়। এক্ষেত্রে একজন পরীক্ষার্থীর আগের দুই পরীক্ষার গড় ফলাফলের ওপর তার মেধা যাচাই করা কোনোমতে শ্রেয় নয়। কেননা, অতীতে কোনো পরীক্ষার্থী খারাপ ফলাফল করেছে বলে, ভবিষ্যতে ভালো ফল করবে না বা আগের দুটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছে বলে ভবিষ্যতে খারাপ ফলাফল করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমনকি, এমন কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) ব্যারোমিটার নেই, যা দ্বারা বিনা পরীক্ষায় মেধার পরিমাপ করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে পরীক্ষাহীন মেধাকে মূল্যায়িত করে এইচএসসির সার্টিফিকেট দেওয়া হবে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে, যা কোনোভাবেই গ্রহণীয় হতে পারে না।

বিগত তিন বছরের জেএসসি ও এসএসসি ফলনির্ভর গাণিতিক পরিসংখ্যানের নমুনা সম্ভাব্য টাইম সিরিজ ফোরকাস্টিং ম্যাথডের ভিত্তিতে দেখা যায়, এ বছর সম্ভাব্য পাসের হার হতো ৮১.২২% ও সম্ভাব্য জিপিএ-৫-এর সংখ্যা হতো ৬৫,৩১০। অনেক শিক্ষার্থী জেএসসি পরীক্ষাকে গুরুত্বহীন ভেবেছিল কিংবা জিপিএ-৫ পায়নি। অনেকেই এসএসসি পরীক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে, এরই মধ্যে ২০১৯ সালের অনেক শিক্ষার্থীই মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেবে। তা ছাড়া যারা এসএসসিতে জিপিএ-৫ পায়নি, তারা এবার মরিয়া হয়ে প্রস্তুতি নিয়েছে উচ্চশিক্ষার প্রবেশদ্বারে এসে ভালো করার জন্য অর্থাৎ এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য। জিপিএ-৫-এর সংখ্যাতত্ত্ব গাণিতিকভাবে বের করা সম্ভব হলেও মূলত কারা জিপিএ-৫ পাবে, সে নাম বের করা হবে কোন পদ্ধতিতে? তাহলে সার্বিক মূল্যায়ন কোন জাদুর কাঠি দিয়ে করা হবে, সে প্রশ্নটি রয়েই গেল। অন্যদিকে প্রশ্ন হচ্ছে, বঞ্চিত পরীক্ষার্থীদের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ বিবেচনা করা হবে (রাইটস টু আপিল) কিনা? সেই বোধ থেকেই বিশ্বের কোনো দেশই অটো পাস দেয়নি।

এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিকের ২০% এবং লিখিত ৫০% ও বহুনির্বাচনী পরীক্ষার ৩০%-এর ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হবে বলে ঘোষণা করেছে। তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে লিখিত পরীক্ষার সম্মুখীন শিক্ষার্থীদের হতেই হবে। সারা দেশে করোনার সময় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকমন্ডলী ছুটিতে ছিলেন ও শ্রেণিকক্ষগুলো অব্যবহৃত ছিল। সেক্ষেত্রে উপকেন্দ্র বাড়িয়ে দেশব্যাপী এইচএসসি পরীক্ষা নিতে বাধা কোথায়?

এখন যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার সময় বলা হয় পরীক্ষার বিকল্প পরীক্ষাই, তাহলে প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক বিষয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে একাধিক বার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে নিপতিত করা কোন মানদন্ডে বিবেচ্য হলো, সেই প্রশ্নটি রয়েই গেল।

মেধা মূল্যায়নের একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠি থাকতেই হবে। সেই বিবেচনায় স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়িয়ে যে কয়টি বিষয়ের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা প্রয়োজন, সেই কয়টি বিষয়কে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার বিষয় হিসেবে গণ্য করে, দেশব্যাপী পরীক্ষা নেওয়া হলে এবং সেই ফলাফলটিকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল হিসেবে গণ্য করলে, তাকে অটো পাস বলা হবে না। এই প্রক্রিয়ায় কোনো শিক্ষার্থীকেই অবমূল্যায়নও করা হয় না। শিক্ষার্থীর জীবনে অটো পাসের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হবে না। এই পরীক্ষার মার্কশিট উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিদেশ গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করবে। যেভাবে দেখেছি উন্নত বিশ্বের ভর্তি প্রক্রিয়া SAT, GRE, GMAT, LSAT I TOEFL এর মতো পরীক্ষা পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল।

এক্ষেত্রে, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সববিষয় না পারলেও আবশ্যিক পাঁচ বিষয়ের পরীক্ষা নিলেও শিক্ষা বোর্ড আইনে মানবিন্যাস সহজ হয়ে যেত। যেহেতু শিক্ষাবিদরা ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে মতামত দিচ্ছেন, তাহলে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়িয়ে দেশব্যাপী বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সারা দেশের প্রাথমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাকে উপকেন্দ্র বানিয়ে এক বেঞ্চে একজন করে বসিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। নকল অথবা স্বজনপ্রীতি এড়ানোর জন্য স্ব-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পাশের কেন্দ্রে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। ভর্তি পরীক্ষাটিই হোক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মানদন্ড।

ইতিমধ্যে, বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও অণুজীব বিজ্ঞানীরা আগাম বাণীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা বললেও শিক্ষাবিদরা এ বছরের শেষ দিকে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজনের জন্য তৎপর হয়েছেন। তাহলে সরকার এই শিক্ষাবিদগণের সঙ্গে আগে আলোচনা করে মেধা মূল্যায়নের জন্য একটি পরীক্ষা নিলেন না কেন? বাংলাদেশের জন্য ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ড সদ্ব্যবহার করার এখনই মোক্ষম সময়। আর এই পরীক্ষার্থীরাই ২০৪১ সালে হবে জাতির ভবিষ্যৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, কূটনীতি হতে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনার কান্ডারি, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী। তাদের অটো পাস দিয়ে কোন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা? কোন স্বার্থে দীর্ঘ সাত মাস কালক্ষেপণ করলেন? দেশ বাঁচাতে হলে শিক্ষাকে বাঁচাতে হবে। তাহলে কী ৭ অক্টোবর অটো পাস দিবস নাকি ... শিক্ষা ধ্বংস দিবস?

লেখক : সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, আন্তর্জাতিক সম্পাদক, বিএনপি ও চেয়ারম্যান, ইআরআই।

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর