সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

যুব সমাজ ও সরকার

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

যুব সমাজ ও সরকার

যুব সমাজই রাষ্ট্র তথা সমাজ উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। তেমনি সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনের জন্য যুব সমাজকে সংগঠিত করতে হলে প্রয়োজন নেতৃত্বের। নেলসন ম্যান্ডেলার একটি কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। তিনি বলেছেন, ‘আমার সফলতার ভিত্তিতে আমাকে বিচার কর না, আমাকে বিচার কর আমার ব্যর্থতা এবং ব্যর্থতার পর ঘুরে দাঁড়ানোর ভিত্তিতে।’ সুতরাং যুব সমাজের মানবিক আদর্শ ও দেশপ্রেমের ভিত্তি গড়ে তুলতে হলে নেতৃত্ব ও ব্যর্থতা দুটোই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য অতীতে দুটো আদর্শ ছিল। একটি জনগণকে নিয়ে পুঁজির বিকাশ ঘটানো, রাষ্ট্রকে তথাকথিত উন্নত, সম্পদশালী এবং শক্তিধর রষ্ট্রে পরিণত করা। প্রথমটির রক্ষাকবচ হলো গণতান্ত্রিক চর্চা এবং এর সঠিক প্রতিফলন। সর্বোপরি যুব সমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়নে তাদের সচেতন করে তোলা। গণতান্ত্রিক চর্চায় যদি কখনো কুঠারাঘাত হয়, ঠিক তখনই তরুণরা সমাজের ত্রুটি নিয়ে ভয়েস তৈরি করে।  রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলাফল কখনো ধনাত্মক হয় না। দ্বিতীয়টি হলো সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। লেলিন, মাও সেতুং বা ক্যাস্ত্রোর মতো নেতৃত্বগুণেই। সে ব্যবস্থাও বিলুপ্ত প্রায়। তাই দ্বিতীয়টি বর্তমানে প্রতিস্থাপিত হতে পারে সম্পূর্ণ জনকল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থা হিসেবে, সংসদীয় জনদরদি সরকারের মাধ্যমে।

সম্পূর্ণ জনকল্যাণমূলক সমাজ ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে পারে। এখানে বুঝানো হচ্ছে বেকার ভাতার পরিবর্তে, সমবায় পদ্ধতির মাধ্যমে যুব সমাজকে কর্মমুখী করে আত্মনির্ভরশীল করে তোলে। পশ্চিমা বিশ্বে বেকার ভাতা এক রকম অভিশাপে পরিণত হয়েছে। শুধু যুব সমাজকে কর্মবিমুখ করেনি, তা তাদের অলস এবং বিভিন্ন আসক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমান যুগে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে তরুণ-তরুণী কমপক্ষে দুই লাখ হিংস্র ঘটনা পড়েন ও দেখেন বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে। বিনোদনের জন্য এসব ছেলেমেয়ে বাবা-মাকে কাছে পান না বলেই এ পদ্ধতির ওপর বিনোদনের ভরসা করে (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা)। এখানেই সেই প্রবাদ বাক্যটি যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে-অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডাখানা। অবশ্যই বয়স্ক ভাতা বা চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতা, কর্ম অক্ষম ভাতা, অনাথ পুনর্বাসন, বিধবা বা অসহায় ব্যক্তিভাতা ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক ভাতা অবশ্যই বহাল থাকবে। দুটো আদর্শ বাস্তবায়নে সমাজে প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব। যে নেতৃত্ব হতে হবে- সৎ, নির্লোভ বা দুর্নীতিমুক্ত, বাস্তববাদী, বস্তুবাদী, কঠোর পরিশ্রমী, নৈতিকতায় সর্বোচ্চ, শাসন সমন্ধে সম্যক ধারণা, হিসাবি, উন্নয়নমুখী, সর্বোপরি আশাবাদী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। যার প্রকৃত উদাহরণ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার উন্নয়ন চিন্তা তিনিই ছিলেন বহুমাত্রিক দার্শনিক, একজন পরীক্ষিত ব্যক্তিত্ব সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। বঙ্গবন্ধু বলেন, কোনো ‘ভুঁড়িওয়ালা’ এ দেশে সম্পদ লুটতে পারবে না। গরিব হবে এই রাষ্ট্র ও সম্পদের মালিক, শোষকরা হবে না। এই রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ থাকবে না। এই রাষ্ট্রের মানুষ হবে বাঙালি। তাদের মূলমন্ত্র ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। মাঝে মাঝে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার মৌলিক প্রশিক্ষণের বিদায়পর্বে একটি স্যুভিনির প্রকাশ নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা, যেখানে প্রশিক্ষণার্থীদের বিভিন্ন রকম গুণাবলির প্রকাশ পায়। আমি দেখেছি সেখানে পরিচিতমূলক পৃষ্ঠায় তাদের প্রিয় ব্যক্তিত্বের কলামে অনেকেই বাবা-মায়ের কথা, সাহিত্যিক, গায়ক-গায়িকার নাম লেখেন কিন্তু খুব কম সময়েই বঙ্গবন্ধুর কথা লেখেন। কেউ কেউ নবীজিকে প্রিয় ব্যক্তিত্ব লেখেন। আমার মতে তিনি ব্যক্তিত্ব নয়, ব্যক্তিত্বের ওপর যদি কিছু থাকে তাহলে তিনি হলেন সেখানে। ব্যক্তিত্ব হলো মানবসত্তা, আর নবীজি (সা.) হলেন মহামানব সত্তার অধিকারী। তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আমি সনাতন ধর্মের হলেও যেহেতু স্রষ্টা এবং সৃষ্টিতে বিশ্বাসী তাই অকপটে স্বীকার করি তিনি মহামানব। নেতৃত্বের কথা বলছিলাম, যুব সমাজের জন্য। সে নেতৃত্ব হতে হবে মানুষকে দেওয়ার জন্য-মানুষের কাছ থেকে নেওয়ার জন্য নয়। নেতৃত্ব হতে হবে সর্ব গুণে গুণান্বিত। তাদের গভীর দেশপ্রেম সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও উন্নত ও শক্তিশালী করবে। নেতৃত্বের হৃদয়ে, মন-মানসিকতায় থাকতে হবে অভিজাত্য, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। নেতৃত্ব হতে হবে সুদৃঢ় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। পরিষ্কার চিন্তা-চেতনার এবং সহজাতকরণের ক্ষমতাসম্পন্ন। মনে রাখতে হবে, যে রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ জীবন, সে দলেই পরীক্ষিত, দক্ষ নেতার সৃষ্টি হয়। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘ঘৃণা মনকে অন্ধকার করে দেয়। কৌশলের পথ রুদ্ধ করে দেয়। নেতাদের ঘৃণা করা সাজে না।’ সুতরাং নেতৃত্ব দিতে হলে নির্মোহ হতে হবে। ঘৃণা, সমালোচনা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার আভিজাত্য ও অহমিকা মানুষকে কর্মচঞ্চলতা থামিয়ে দিতে পারে।

আমাদের যুব সমাজের কাছে ১৬ বছরের পর ৪টি বিপ্লবের চিন্তায় জাগ্রত করতে হবে, যাতে করে তারা যে কোনো একটি বেছে নিতে পারে। তাদের নেতৃত্বের অধিকারী করতে হবে। প্রথমটি সবুজ বিপ্লব  (Green Revolution),, দ্বিতীয়টি শ্বেতবিপ্লব (White Revolution) অর্থাৎ দুগ্ধবিপ্লব, তৃতীয়টি হলো Silver Revolution বা রৌপ্যবিপ্লব অর্থাৎ মৎস্য বিপ্লব, চতুর্থটি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিপ্লব (Education & Health Revolution)। বাংলাদেশে সবুজবিপ্লব বা কৃষিবিপ্লব এবং রৌপ্যবিপ্লবে পৃথিবীতে তাক লাগানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। তবে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটি এখন সুদৃঢ় নয়। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কৃষি গবেষণায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ এবং গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। মাঠপর্যায়ে তাদের তদারকি করাতে হবে। তাদের গবেষণা ও আবিষ্কারের ফসল ঘরে তুলতে হবে।

সত্তরের দশকে প্রতিবেশী ভারতের খাদ্য সমস্যা সম্পর্কে ড. এ পি জে আবদুল কালামের লেখা একটি Phrase (বাক্য বা বুলি) ‘Ship to mouth existence’ অর্থাৎ আমদানি করা খাদ্য দ্রব্য, জাহাজে করে বন্দর থেকে বের হয়ে জনগণের মুখের অন্ন জোটাত বা পেটের ক্ষুধা ঘুচাত। সেই ভারত ১৯৭০ সালে সুব্রামনিয়ামের নেতৃত্বে সবুজবিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। যেখানে তাদের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৩৬ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য উৎপাদন। মি. সুব্রামনিয়াম সেক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক সাহায্য পেয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী আমেরিকান অ্যাগ্রোনমিস্ট Dr. Norman Borlaugh এবং ড. এম এস স্বামীনাথনের কাছ থেকে। সহযোগিতা করেছিলেন B. Sivaraman. বর্তমানে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবে তাদের লক্ষ্যমাত্রা ৩৪০ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করা। রাষ্ট্রের প্রতি যুব সমাজের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষা, দেশপ্রেম জাতিকে সমৃদ্ধ করবে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর