মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আঞ্চলিক দেশগুলোর ভূমিকা

ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আঞ্চলিক দেশগুলোর ভূমিকা

রোহিঙ্গা সমস্যা তিন বছর পূর্ণ হয়ে চতুর্থ বছরে পদার্পণ করেছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদার অব হিউম্যানিটি নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্বে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। ২৫ আগস্ট, ২০১৭-এর পর থেকে অদ্যাবধি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যৌথ ব্যবস্থাপনায় তারা মিয়ানমারে নিরাপদে ও সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় আছে। রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলায় গত তিন বছর ধরে আঞ্চলিক রাষ্ট্রসমূহের কার্যক্রম এবং এর ধারাবাহিকতায় অর্জন সম্পর্কে এ পর্বে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াংই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সহযোগিতার কথা বলেছেন। জুলাই, ২০১৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেইজিং সফরের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এবং প্রধানমন্ত্রী লি কিকিয়াং বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে চীনের ভূমিকা জোরালো হয়েছে যা একটা বড় কূটনৈতিক সাফল্য। কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার (সিপিসি) অভ্যন্তরীণ-বিষয়ক মন্ত্রী সং তাও বেইজিংয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাদের ইতিবাচক ভূমিকার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অব্যাহত রাখার পাশাপাশি রাখাইন প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে কাজ করে যাওয়ার কথা বলেছে চীন। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশে চীনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম রয়েছে। চীন এ সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারা কেন আগস্ট, ২০১৭-এর পর তিনবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। তিনি রোহিঙ্গাদের সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ তারিখে জাপান জরুরি ত্রাণ সহায়তা হিসেবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের জন্য ৪ মিলিয়ন ডলার প্রদান করে। জাপান কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সহায়তার কথা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছে। ২০১৯ সাল নাগাদ জাপান রোহিঙ্গাদের ৯৯.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মানবিক সাহায্য দিয়েছে। জাপানের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানান, জাপান রোহিঙ্গা সমস্যার একটা স্থায়ী ও টেকসই সমাধানের ব্যাপারে আগ্রহী। তিনি জানান, দ্রুত প্রত্যাবাসনের মধ্যেই নিরাপত্তা ও সম্মানজনক সমস্যার সমাধান আছে।

২০১৭ সালের অক্টোবরে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা সরাজ রোহিঙ্গা সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধানের পক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইন প্রদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ভারতীয় বিমান বাহিনী বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গাদের জন্য ‘অপারেশন ইনসানিয়াত’-এর মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ অঞ্চলের স্বার্থে বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই পদ্ধতিতে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর জানান, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দ্রুত প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ভারত। আগস্ট, ২০২০ সালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার ঢাকা সফরে ভারত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ভারত নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ভারত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট উই দো দো ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে কক্সবাজারের ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর চলা সহিংসতায় নিন্দা প্রকাশ করেন। ইন্দোনেশিয়ার বিমান বাহিনীর চারটি পরিবহন বিমান রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে আসে। মালদ্বীপ রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান সহিংসতায় তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছে এবং নৃশংসতা বন্ধের দাবি জানিয়েছে। মালদ্বীপ সরকার জাতিসংঘ মহাসচিব এবং ইউএন মানবাধিকার কাউন্সিলকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চলমান সহিংসতার বিষয়ে তাদের উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা আসিফ রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতার ব্যাপারে কষ্টের কথা জানিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এটা একটি মানবিক চ্যালেঞ্জ বলে বর্ণনা করেছেন। ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ পররাষ্ট্র সচিব তেহমিনা জানজুয়া ইসলামাবাদে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রতিবাদ জানান। ভিয়েতনাম রোহিঙ্গাদের জন্য ৫০ হাজার ডলার সাহায্য দিয়েছে এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এ সহায়তাকে স্বাগত জানিয়েছে।

২৫ আগস্ট, ২০১৭-এর সহিংস ঘটনার পর সিঙ্গাপুর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সব পক্ষকে শান্তভাবে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার অনুরোধ করে। অক্টোবর, ২০১৭ সালে সিঙ্গাপুর রাখাইন স্টেটে মানবিক সাহায্য কার্যক্রমের জন্য ১ লাখ সিঙ্গাপুর ডলার আসিয়ান হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্ট সেন্টার (এএইচএসি)-এর মাধ্যমে অনুদান দেয়। রিপাবলিক অব কোরিয়া জাতিসংঘ সাহায্যকারী সংস্থাগুলোকে রোহিঙ্গাদের সাহায্যের জন্য ৩.৪ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত অরুণরাং ফোথং হাম ফেরেস মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, থাইল্যান্ড রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে সমর্থন করবে। লাওস ও ইন্দোনেশিয়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে একত্রে কাজ করার জন্য সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। কম্বোডিয়া আসিয়ানের কাঠামোর মধ্যে থেকে রোহিঙ্গাদের রাখাইন প্রদেশে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশকে সমর্থনের কথা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছে। মালয়েশিয়া বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় সম্মানজনকভাবে নিরাপদে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে দৃঢ়ভাবে তাদের সমর্থন চালিয়ে যাবে। মালয়েশিয়া রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সাহায্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আসিয়ান দেশগুলো রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টা এবং মানসিকতার পরিবর্তন। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে স্থানীয় জনগণ ও বৌদ্ধ সংগঠনগুলোর মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি বা বর্তমান মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানা যায়নি। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী দেশগুলো রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ামারের জনগণের চলমান নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারে। মিয়ানমারের জনজীবনে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রভাব স্পষ্ট। শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ সংঘ ও অন্যান্য বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার তথা রাখাইনবাসীর মনোভাব পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরার একটা সহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।

আঞ্চলিক দেশগুলো রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং অনেক দেশ অর্থ ও মানবিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে। বাস্তবে এ সমস্যার অগ্রগতি অর্থাৎ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়নি এবং এ সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধানের পথ এখনো কোনো আলোর মুখ দেখেনি। চীন, জাপান, ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে মিয়ানমারের বাণিজ্য সম্পর্ক ও বিনিয়োগ রয়েছে। এ দেশগুলো মিয়ানমারের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এ দেশগুলোর ভূমিকা আরও জোরালো হলে সমস্যা সমাধান দ্রুত এবং টেকসই হবে। বাংলাদেশকে এ সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশগুলো যেমন চীন, ভারত, জাপান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, আসিয়ানকে একত্রে নিয়ে এ বিষয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

আঞ্চলিক দেশ এবং জোটগুলো দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে স্থানীয় রাখাইন ও বৌদ্ধ সংঘগুলোর মাধ্যমে রাখাইন প্রদেশ তথা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নিতে পারে। যোগাযোগব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি চলমান সহিংসতা বন্ধে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে রাখাইন প্রদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়ন প্রয়োজন এবং সেখানে চলমান সহিংসতা বন্ধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রাখাইন প্রদেশের জনগণের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য রোহিঙ্গাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি ও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তবে এ ব্যাপারে মিয়ানমার এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ কার্যক্রম গ্রহণে সংবিধানে সংশোধনী আনা জরুরি যা সময়সাপেক্ষ। এ কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আঞ্চলিক রাষ্ট্রসমূহ এবং সংস্থাগুলোর ঐকান্তিক সহযোগিতা ও মিয়ানমারের সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সঙ্গে জোরালো কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। দেশে-বিদেশে সব ধরনের মিডিয়ার মাধ্যমে এ সমস্যার অগ্রগতি এবং গৃহীত পদক্ষেপগুলো জানিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আরও নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এ সমস্যা সমাধানে দাতা সংস্থা, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি আঞ্চলিক রাষ্ট্রসমূহ এবং সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। বাস্তচ্যুত এ বিশাল জনগোষ্ঠী নিজ দেশ মিয়ানমারে নিরাপদে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত এ ইস্যু বিশ্বদরবারে জানান দিয়ে যেতে হবে এবং এ বাস্তবতাকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমাধানের উদ্যোগ চালিয়ে যেতে হবে।

                লেখক : ডেপুটি কমান্ড্যান্ট, বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা।

সর্বশেষ খবর