শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মণিপুরি

মণিপুরি

মণিপুরি বাংলাদেশের অন্যতম আদিবাসী সম্প্রদায়। প্রাচীনকালের সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং এখনকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর এদের আদি বাসস্থান। প্রাচীনকালে মণিপুরি সম্প্রদায় ক্যাংলেইপাক, ক্যাংলেইপাং, ক্যাংলেই, মেইত্রাবাক, মেখালি প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। মণিপুরিদের মেইতেই নামেও অভিহিত করা হতো। মহারাজ গরিব নেওয়াজের (১৭০৯-১৭৪৮) শাসনামলে সিলেট থেকে আগত মিশনারিরা এ স্থানকে মহাভারতে বর্ণিত একটি স্থান মনে করে এ ভূখ-ের নাম দেন মণিপুর। এভাবেই এখানকার প্রধান অধিবাসী মেইতেইদের নাম হয়ে যায় মণিপুরি। পরে অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এখনকার মণিপুর ও মহাভারতে উল্লিখিত মণিপুর একই স্থান নয়। মণিপুরিরা বিভিন্ন সময় যুদ্ধ, সংগ্রাম ও অন্যান্য সামাজিক, রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করে। এ ধরনের অভিবাসন প্রথম শুরু হয় (১৮১৯-১৮২৫) মণিপুর-বার্মা যুদ্ধের সময়। একটি অনুসন্ধানী গবেষণায় লক্ষ্য করা যায়, এ যুদ্ধের সঠিক কাল আরও আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং রাজা ভাগ্যচন্দ্রের সময় (১৭৬৪-১৭৮৯) ওই অভিবাসন শুরু হয়। তবে মণিপুর-বার্মা যুদ্ধের সময় অভিবাসন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এ সময় মণিপুর পরাধীন হয়ে পড়ে এবং বর্মি দখলদাররা প্রায় সাত বছর অঞ্চলটি শাসন করে। ওই সময় মণিপুররাজ চৌরাজিত সিংহ তার দুই ভাই মারজিত সিংহ, গাম্ভির সিংহসহ সিলেটে আশ্রয় নেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন অনেক ধনসম্পদ। তারা সিলেটের মির্জা জঙ্গলে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন যার ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুর ও ঢাকার তেজগাঁওয়ে মণিপুরি বসতিগুলো সে সময়ই গড়ে ওঠে। তবে সময়ের স্রোতে এসব বসতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বর্তমানে মণিপুরিরা বৃহত্তর সিলেটে বসবাস করছে। সিলেট শহর ও শহরতলি, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, বড়লেখা এবং হবিগঞ্জের চুনারঘাট ও সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় এদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মণিপুরিদের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ১৩ হাজার, সিলেটে ৭ হাজার ও হবিগঞ্জে ৪ হাজার মণিপুরি বাস করে। অন্যান্য আদমশুমারির উপাত্ত প্রকাশ করা হয়নি।

জাতিগত উৎপত্তি : ঐতিহাসিকভাবে মণিপুরিদের সাতটি ইয়েক বা সালাইসে  ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- নিংথাউজা, লুওয়াং, খুমান, মৈর‌্যাং, অংঅম, চেংলেই ও খাবা-গণবা। প্রতিটি ইয়েক বা সালাইসকে আবার অনেক শাগেইসে (Shageis) (পারিবারিক নাম) বিভক্ত করা হয়েছে। পরে এসব ইয়েক বা সালাইস বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। আর এভাবেই নিংথাউযা ইয়েক হয়ে যায় শান্ডিল্য গোত্র, খুমান হয় মৌদ্গল্য, মৈর‌্যাং হয় আত্রেয় ও অঙ্গীরাশ্ব, অংঅম হয় গৌতম, লুওয়াং হয় কাশ্যপ, চেংলেই হয় বশিষ্ঠ ও অঙ্গীরাশ্ব  এবং খাবা-গণবা থেকে হয় ভরদ্বাজ ও নৈমিষ্য  সম্প্রদায়।

জাতিগত দিক থেকে মণিপুরিরা মঙ্গোলীয় মানবগোষ্ঠীর তিব্বতি-বর্মি পরিবারের কুকি-চীন গোত্রভুক্ত। তবে মণিপুরিদের মধ্যে আর্য ও অন্যান্য রক্তের যথেষ্ট মিশ্রণ ঘটেছে। বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান এবং বেশ কয়েকটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে বহুকাল থেকে মণিপুর বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী ও সংস্কৃতির মিলন কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের সংমিশ্রণের ফলেই আধুনিক মেইতেই জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে, যাদের আজ মণিপুরি হিসেবে অভিহিত করা হয়।

ভাষা ও সাহিত্য মণিপুরিদের মাতৃভাষা মেইতেই লন বা মণিপুরি ভাষা মঙ্গোলীয় ভাষা পরিবারের তিববতি-বর্মি উপপরিবারভুক্ত এবং কুকি-চীনা দলভুক্ত। মণিপুরি ভাষা ও সাহিত্য খুবই প্রাচীন। এর রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ও বর্ণাঢ্য ইতিহাস এবং দীর্ঘ ঐতিহ্য। মণিপুরি ভাষা আজ শুধু মণিপুরের রাষ্ট্রভাষাই নয়, এটি ভারতের সংবিধানে অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

মণিপুরি সাহিত্যের প্রাচীনতম মূল্যবান নিদর্শন হচ্ছে ঔগরি। এটি একটি গীতিকবিতা। ৩৩ সালে মণিপুরি রাজা পাখাংবার সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সূর্য দেবতার উদ্দেশে এটি গীত হয় বলে ধারণা করা হয়। তবে অষ্টম শতাব্দীর একটি তামার পাত্রে পাওয়া গেছে প্রথম লিখিত সাহিত্য। এটি মহারাজা খংটেকচার সময় লেখা হয়। পরে মণিপুরি সাহিত্য দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং আধুনিক মণিপুরি ভাষায় লেখা অনেক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। অনুবাদের ক্ষেত্রেও মণিপুরিরা খুব একটা পিছিয়ে নেই। মহাভারত, রামায়ণের মতো মহাকাব্য এ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ধর্মীয় গ্রন্থ শ্রীভগবদ্গীতা, বাইবেল প্রভৃতি মণিপুরি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বসাহিত্যের মহান লেখক যেমন হোমার, সফোক্লিস, শেকস্পিয়র, তলস্তয়, বার্নাড শ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্রসহ অন্যদের ধ্রুপদি লেখাসমূহ এ ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। প্রাচীন মণিপুরি হরফের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটি হরফের নামকরণ হয়েছে মানবদেহের এক একটি অঙ্গের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা গরিব নেওয়াজের শাসনামলে মণিপুরি হরফকে বাংলা হরফে প্রতিস্থাপিত করা হয়।

                শেখ সিয়াম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর