বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কাক ডাকা বিকেলের লাজুক ছানু মিয়া

নজরুল ইসলাম বাসন

কাক ডাকা বিকেলের লাজুক ছানু মিয়া

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অন্ধকার বারান্দা কাব্যগ্রন্থে অমলকান্তি নামে একটি কবিতা আছে। কবিতার কয়েকটি লাইন প্রথমে তুলে ধরছি, পরে অকালপ্রয়াত কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট ছানু মিয়ার কথায় আসব। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন-

‘আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।/অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি/সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!/ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,/জাম আর জামরুলের পাতায়/ যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।’

ছানু মিয়ার সঙ্গে যারা পরিচিত ছিলেন তারা কি এখনো ছানু মিয়া জাম-জামরুলের পাতায় লেগে থাকা সেই অল্প হাসিটুকু ভুলতে পেরেছেন। আমি অমলকান্তি কবিতাটি বহু বছর আগে থেকেই ক্যাসেটে আবৃত্তি শুনে আসছি, ছানু মিয়ার কথা লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল সে কবিতার অমলকান্তির কথা, কবির প্রশ্ন ছিল- কী হতে চেয়েছিল অমলকান্তি? আর এখন আমার প্রশ্ন- কী হতে চেয়েছিলেন ছানু মিয়া?

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঝড়-তুফানের সময়কার পূর্ব লন্ডনে বেড়ে ওঠা এক উদ্যমী তরুণ মিয়া আখতার হোসেন ছানু। ১৯৭৮ সালে পূর্ব লন্ডনে আলতাব আলী, ইসহাক, কেনেথ ব্লেয়ার বর্ণবাদীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। সে সময় সারা ব্রিটেনে বর্ণবাদী গুন্ডাদের অত্যাচার ছিল, টাওয়ার হ্যামলেটসের পথে-ঘাটে ছিল ভয়াবহ অবস্থা। গার্মেন্টে কাজ করতেন আলতাব আলী, বর্ণবাদী গুন্ডাদের হামলার শিকার হয়ে মারা যান তিনি। ঘটনাটি ১৯৭৮ সালের মে-র। বহু অশ্বেতাঙ্গ লোক ব্রিটেনে ন্যাশনাল ফ্রন্টের গুন্ডাদের হাতে নিহত হয়েছেন, অনেকে মারাত্মক আহত হয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় বেঁচে ছিলেন। ব্রিটিশ ন্যাশনাল ফ্রন্টের স্কিনহেড গুন্ডারা এক ভয়াবহ তান্ডব শুরু করেছিল সারা ব্রিটেনে। ব্রিটিশ মন্ত্রী ইনোক পাওয়েলের রক্তগঙ্গা বা রিভার অব ব্লাড উক্তিটি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে।

বর্ণবাদী গুন্ডাদের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল পূর্ব লন্ডনের শেডওয়েল এলাকা, সেখানেই ছিল ছানু মিয়াদের ফ্ল্যাট, পরিবার নিয়ে থাকতেন ছানু মিয়া, বাবা মারা গিয়েছিলেন অল্প বয়সে, মায়ের আদরের ছিলেন ছানু। কিশোর বয়স থেকেই ছানু মিয়া দেখে আসছিলেন বর্ণবাদী গুন্ডাদের বিরুদ্ধে অগ্রজদের মুভমেন্ট। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছানুও তাদের সঙ্গে যোগ দিতে থাকেন। তখন পূর্ব লন্ডনে বেশ কয়েকটি যুব সংগঠন ছিল। যেমন- ইয়ুথ লীগ, বাংলাদেশ ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ইয়ুথ মুভমেন্ট, প্রগ্রেসিভ ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন। একবার এসব যুব সংগঠনের সঙ্গে ব্রিটেনের অন্যান্য শহরের যুব সংগঠন মিলে  ফেডারেশন অব বাংলাদেশি ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েন বা এফবিআইও নামে একটি ফেডারেশন গঠিত হয়। তরুণ ছানু মিয়া এ সংগঠনের স্পোর্টস সেক্রেটারির দায়িত্ব নেন। (সূত্র : আনসার আহমেদ উল্লা)।

টাওয়ার হ্যামলেটসের বাঙালিরা তখন নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে। বড়দের সংগঠন ছিল বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার ও উপজেলাভিত্তিক সামাজিক সংগঠন। যেমন বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ছাতক, মৌলভীবাজার এলাকাভিত্তিক সংগঠন। এ ছাড়া কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে অনেক ব্যক্তিত্ব বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন। ব্রিটেনের বাঙালিদের এসব এলাকাভিত্তিক সংগঠন এ দেশের বাঙালি কমিউনিটির প্রথম প্রজন্মের বাঙালিদের মধ্যে এক অটুট বন্ধনের সৃষ্টি করেছিল। বৃহত্তর সিলেটের অবকাঠামো নির্মাণে এদের শক্তিশালী ভূমিকা গবেষণার দাবি রাখে। গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাক যে মডেল প্রতিষ্ঠিত করেছে, বিলেতের বাঙালিরা আঞ্চলিক সংগঠনের মাধ্যমে ঠিক তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য করে বৃহত্তর সিলেটে স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, রাস্তাঘাট করেছেন। নারীরা ছিলেন হোম মেশিনিস্ট। তারা স্বামীর পাশাপাশি ড্রেস সেলাই করে সাপ্তাহিক বেতন পেতেন। এ অর্থ দেশে পাঠানো হতো, যার গালভরা নাম ছিল ফরেন কারেন্সি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ফান্ড কালেকশন হয়েছিল তা-ই ছিল বাংলাদেশের প্রথম ফরেন কারেন্সির রিজার্ভ ফান্ড।

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের বাঙালিদের মধ্যে সাংগঠনিকভাবে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাঙালিরা তেমন কোনো আন্দোলনে যোগ দেননি। আলতাব আলী নিহত হওয়ার পর আবার যেন প্রতিরোধের লড়াই শুরু হলো। খালি কফিন নিয়ে কয়েক হাজার বাঙালি ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিসে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছিলেন। পূর্ব লন্ডনের বাঙালিদের সঙ্গে তখন বেশ কিছু বর্ণবাদবিরোধী বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের মানুষ সমর্থন জুগিয়েছিল। ১৯৭৮ সালের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে টাওয়ার হ্যামলেটসের বাঙালি যুবকরা লেবার পার্টির রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পথ খুঁজে পায়, লকেল কাউন্সিল ও ইয়ুথ ওয়ার্কার হিসেবে অনেক যুবক-যুবতীকে চাকরি দেয়। যদি কোনো গবেষক এ নিয়ে গবেষণা করেন তাহলে তিনি দেখতে পাবেন ১৯৭৮ সালের আলতাব আলী হত্যার পর গড়ে ওঠা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমেই টাওয়ার হ্যামলেটসে লেবার পার্টি তাদের প্রয়োজনে বাঙালিদের আশ্রয় দেয়। ১৯৮৬ সালে লিবারেল পার্টি থেকেও বেশ কয়েকজন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ’৯০ সালের পর থেকে টাওয়ার হ্যামলেটসে লেবার ও লিবারেল পার্টি বাঙালিদের নিয়ে রাজনীতি শুরু করে।

টাওয়ার হ্যামলেটসের ব্রিকলেন ছিল বাঙালিদের মিলন কেন্দ্র, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, পাঁচ দলীয় বামজোট ছিল খুবই সক্রিয়। বাংলা প্রিন্ট মিডিয়াও এ আন্দোলনে একান্ত হয়েছিল। এ সময় দাওয়াতুল ইসলাম, ইসলামিক ফোরাম ও ইয়ং মুসলিম অর্গানাইজেশন ইস্ট লন্ডন মসজিদকে কেন্দ্র করে তৎপরতা শুরু করে। ইস্ট লন্ডন মসজিদের কর্তৃত্ব নিয়ে দাওয়াতুল ইসলাম ও ইসলামিক ফোরাম একসময় আলাদা হয়ে যায়। পরে ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও লন্ডন মুসলিম সেন্টার টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতিতে পাওয়ার বেইস হিসেবে আবির্ভূত হয়। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের কর্তৃত্ব নিয়ে লেবার পার্টি, লিবারেল পার্টি, কনজারভেটিভ পার্টি রাজনীতির পাশাপাশি রেসপ্যাক্ট পার্টির রাজনীতি চলতে থাকে। রেসপ্যাক্ট পার্টির জর্জ গ্যালওয়ে উনা কিংকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। রেসপ্যাক্ট পার্টির উত্থানে লিবারেল পার্টি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

লুৎফুর রহমানের মেয়র হওয়া, তার উত্থান ও পতন টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতির এক নাটকীয় অধ্যায়, রাজনৈতিক গবেষকদের জন্য এ অধ্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেয়র লুৎফুর রহমানের পতনের পর কাউন্সিলর রাবিনা খান মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান লেবার পার্টির জন বিগসের কাছে। পরের বার কাউন্সিলর ওহিদ আহমদ লুৎফুর রহমানের টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট পার্টির হাল ধরেছিলেন। তিনি ও রাবিনা খান মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জন বিগসের কাছে হেরে যান। গত চার দশকের পূর্ব লন্ডনের রাজনীতির এ উত্তাল সময়ে পলা মনজিলা উদ্দিন হাউস অব লর্ডসের সদস্য এবং প্রথমে রুশনারা আলী ও পরে আপসানা বেগম টাওয়ার হ্যামলেটসের দুটি আসন থেকে পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছেন। বয়সের কারণে এরা অতীত ঝড়-তুফানের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার সুযোগ পাননি।

ছানু মিয়া সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে এসব কথা উঠে এসেছে। কারণ ছানু মিয়া টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতি, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক জগতে সক্রিয় একজন মানুষ ছিলেন, তার সেকেন্ডারি স্কুলে পড়া শেষ হয়ে গেলে ফুটবল নিয়ে মেতে ওঠেন, তার দলের নাম ছিল শাপলা ইয়ুথ ফোর্স। বিভিন্ন টুর্নামেন্টের আয়োজন করতেন। জেনারেল এরশাদ তখন ক্ষমতায়। ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বিরোধীদলীয় নেতা। ছানু মিয়া তার নেত্রীকে দিয়ে এক টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করিয়েছিলেন। লন্ডনে তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের জোয়ার। ছানু মিয়াও এ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার জোরালো সম্পর্ক গড়ে উঠল। পূর্ব লন্ডনের টয়েনবি হলে জেনারেল এরশাদের গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা আ স ম আবদুর রব সভা করতে এসেছিলেন। ছানু মিয়া সে সভা পন্ড করে দিয়েছিলেন।

ছানু মিয়া আশির দশকের শেষ দিকে নিজের ক্যামেরা দিয়ে প্রচুর ফটো তুলতেন, আমি তখন সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকায় কাজ করি, ছানু মিয়া আমাকে নিয়মিত তার তোলা ফটো দিতেন কিন্তু কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না। শুধু ফটো তোলা নয়, নিজে ডার্ক রুম প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন আমরা সাদা-কালো ছবি ব্যবহার করতাম। ছানু মিয়া তার তোলা ছবি দিয়ে সহযোগিতা করতেন, এভাবে তার সঙ্গে বাংলা প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পর্ক গড়ে উঠল।

লন্ডনে তখনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া আসেনি, প্রিন্ট মিডিয়ায়ও দু-তিনটি সাপ্তাহিক পত্রিকা মাত্র। ছানু মিয়ার সঙ্গে মিডিয়ার সবার সখ্য, স্বৈরাচার পতনের পর এলো ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।  ছানু মিয়ার বন্ধুবান্ধবরাই সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন আর ছানু মিয়া তো ছিলেনই। ১৯৯৫ সালের দিকে ছানু মিয়া টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে সোশ্যাল সার্ভিসে চাকরি নিলেন। কিন্তু ধরাবাঁধা গন্ডিতে থাকার মানুষ নন ছানু মিয়া। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় যাওয়া-আসা শুরু হলো। ছানু মিয়ার সে আরেক জীবন। এ সময়টায় ছানু মিয়া সাংস্কৃতিক ইভেন্ট আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। লন্ডনের হেকনি এম্পায়ার ও ইয়র্ক হলে ছানু মিয়া নিয়ে এলেন গুরু আজম খান, কালা মিয়া, মামুন, সাজ্জাদ নূরসহ কত শিল্পীকে। ছানু মিয়া রাজনীতি, স্পোর্টস ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক ভিন্নধর্মী সংগঠক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন।

ছানু মিয়া হঠাৎ করে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই বসবাস করতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকায়ই ছিলেন। লন্ডনে মাঝেমধ্যে আসতেন। একদিন খবর এলো ছানু মিয়া আর নেই। কবিতার সেই অমলকান্তি-

‘আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।/অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি/সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!/ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,/জাম আর জামরুলের পাতায়/ যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।’

আমাদের ছানু মিয়াও কিছুই হতে চাননি, তিনি একদিন আমাদের মাঝে ছিলেন। আজ নেই, তবে রেখে গেছেন তার- জাম আর জামরুলের পাতায় লেগে থাকা একটু হাসি আমাদের স্মৃতিপটে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর