বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ময়নামতি

ময়নামতি

ময়নামতি কুমিল্লা শহরের প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে বাংলাদেশের পূর্ব সীমায় বিচ্ছিন্ন অনুচ্চ পার্বত্য এলাকা, যা বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এক পরিচিত নাম। এখানে প্রতœতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনাদি উন্মোচিত হয়েছে। ঈষৎ লাল পুরান পললভূমির ইঙ্গিতবহ অঞ্চলটি প্রাচীন ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। মেঘনা বেসিনের ভাটিতে গোমতী নদীতীরে ময়নামতি গ্রাম থেকে লালমাই রেলস্টেশনের কাছে চান্দিমুরা পর্যন্ত এ ক্ষুদ্র শৈলশ্রেণি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৭ কিলোমিটার বিস্তৃত। এর প্রশস্ততম অংশটি ৪.৫ কিলোমিটার চওড়া এবং সর্বোচ্চ চূড়াটি ৪৫ মিটার উঁচু। এসব উঁচু ভূমি একসময় ঘন জঙ্গল ও অসংখ্য বন্যপ্রাণীতে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু আধুনিক উন্নয়ন এখানকার শান্ত মনোরম পরিবেশকে বিঘ্নিত করেছে। অঞ্চলটির উত্তরাংশে ক্রমবর্ধমান ক্যান্টনমেন্ট এবং এর প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত দ্রুতপ্রসারমাণ কোটবাড়ী শহরতলি এখানকার মায়াবী সৌন্দর্যকে ইতিমধ্যেই অতীতের ছায়ায় পরিণত করেছে।

লালমাই-ময়নামতি যৌথনাম এ স্থানটির সঙ্গে অতীতের এক তাৎপর্যপূর্ণ যোগসূত্র নির্দেশ করে। লালমাই- অর্থাৎ এর দক্ষিণাংশ চন্দ্রলিপিতে উৎকীর্ণ লালম্বী-বনের সঙ্গে অভিন্ন; অন্যদিকে এর উত্তরাংশ স্থানীয় গাথা ও লোকসংগীতে উল্লিখিত চন্দ্রবংশের কিংবদন্তির রানী ‘ময়নামতি’র নাম স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতœতাত্ত্বিক উদ্ঘাটন তর্কাতীতভাবেই প্রমাণ করে, এ এলাকাটিই ছিল প্রাচীন বঙ্গ-সমতটের (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র। অসংখ্য ঢিবি, স্মৃতিস্তম্ভ, খননকৃত ধ্বংসাবশেষ এবং সেগুলোর যথাযথ পরিপূরক হিসেবে বিক্ষিপ্ত নিদর্শনসমূহের আকর্ষণীয় বিন্যাস ঘটনাবহুল অতীত ও গৌরবের প্রতি জোরালো ইঙ্গিত বহন করে। তবে খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত বৌদ্ধ ধ্বংসাবশেষসমূহের জন্যই ময়নামতি বর্তমানে অধিকতর পরিচিত। বাংলাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধ ধ্বংসাবশেষসমূহের সর্বাধিক সংগ্রহ এখানেই।

১৮৭৫ সালে পাহাড়গুলোর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রসারিত পুরনো সড়কটির পুনর্নির্মাণকালে শ্রমিকরা হঠাৎ কিছু ধ্বংসাবশেষ উদ্ঘাটন করেন। তখন একে একটি ছোট ইটের দুর্গ মনে করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল একটি বৌদ্ধ মঠ। এর প্রায় ৭২ বছর আগে (১৮০৩) এ এলাকা থেকেই ময়নামতির প্রথম পুরানিদর্শন ১২২০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ রণবঙ্কমল্ল হরিকলদেবের তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছিল। এতে দুর্গ ও মঠ সমৃদ্ধ রাজধানী পট্টিকেরার বিবরণ আছে। বর্তমানে পটিকর পরগনার মাঝে এ নামটি বেঁচে আছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ময়নামতির ধ্বংসাবশেষসমূহ পুনরাবিষ্কৃত হয়। অগ্রবর্তী শিবির স্থাপনকালে সেনাবাহিনী শৈলশ্রেণির কয়েকটি স্থানে পুরনো ধ্বংসাবশেষসমূহের সম্মুখীন হয়। দ্রুত একটি জরিপের পর সরকার ১৮টি স্থান চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে আরও নিয়মিত ও নিয়মানুগ জরিপের ফলে সমগ্র অঞ্চলের জনবসতিহীন এলাকা থেকে ৫০-এর অধিক স্থান চিহ্নিত করা হয়। এর অধিকাংশই শৈলশ্রেণির উত্তরাংশে, যা এখন ক্যান্টনমেন্ট এলাকার অন্তর্গত। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন আরম্ভ হয়। খনন পর্যায়ে চিহ্নিত ৫০-এর ওপর স্থানের মধ্যে এ যাবৎ ৯টি উন্মোচিত হয়েছে। যদিও খননকার্য এখনো সম্পন্ন হয়নি এবং যে কোনো বিচারেই এর সংখ্যা বেশ সীমিত, তথাপি এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্য ও ফলাফল এত দিন যাবৎ অজ্ঞাত এ স্থানের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতি পুনর্গঠনে এক বলিষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর