শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মুক্তিযোদ্ধারা একে অন্যকে খাটো করলে ভাবমূর্তি নষ্ট হয়

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু

মুক্তিযোদ্ধারা একে অন্যকে খাটো করলে ভাবমূর্তি নষ্ট হয়

আমি করোনায় আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিলাম ১২ দিন। করোনামুক্ত হয়ে গত মঙ্গলবার সকালে বাসায় ফেরার প্রস্তুতিকালে হঠাৎ দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ খোলা কলম বিভাগে মুক্তিযুদ্ধকালীন কিংবদন্তি যোদ্ধা, কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের নিবন্ধ ‘হায় আনোয়ারুল আলম শহীদ’-এ দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। নিবন্ধ পাঠে আমি হতবাক। ওই নিবন্ধে জনাব কাদের সিদ্দিকী অযাচিতভাবে আমাকে আক্রমণ করে এমন সব তথ্য দিয়েছেন যা সত্যের অপলাপ মাত্র। আমি এহেন আচরণে মর্মাহত। মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর ভূমিকা অপরিসীম এবং আমার মতো ক্ষুদ্র মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর বীরোচিত ভূমিকার জন্য গৌরব অনুভব করি। কিন্তু আমি খেয়াল করেছি বিগত বেশ কিছুদিন যাবৎ কোনো কারণ ছাড়া আমাকে লক্ষ্য করে তিনি নানা কথা নানা পরিসরে বলেছেন যা অসত্য ও বিভ্রান্তিকর। গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনের সময়ও তিনি এমন সব উক্তি করেছিলেন যা অপমানজনক। কিন্তু আমি তার মুক্তিযুদ্ধে অবদান ও সামাজিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করে কোনো ধরনের প্রতিবাদ না করে নিশ্চুপ ছিলাম। আমি এও বিশ্বাস করি, কোনো একজন মুক্তিযোদ্ধা যদি অন্য একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ছোট করে কথা বলেন বা নেতিবাচক মন্তব্য করেন প্রকারান্তরে তা সামগ্রিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করে। যদি নিন্দিত মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মানবতাবিরোধী বা দুর্নীতিবিষয়ক অপরাধের প্রমাণ থাকে তবে তা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

সারা দেশের জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা একটি পরিবারের মতো। মতভেদ থাকতে পারে। পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে কিন্তু ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আলোকে এক ধরনের সহমর্মিতা আমাদের সবার মাঝে বিরাজমান বলে আমার বিশ্বাস। যদি তা না দেখি তবে দুঃখ দেয় বইকি। কষ্টও দেয়।

১০ নভেম্বরের বাংলাদেশ প্রতিদিনে কাদের সিদ্দিকীর রচনা আমাকে যুগপৎ দুঃখ দিয়েছে এবং হতাশ করেছে। তাই আমি অতিসংক্ষেপে শ্রদ্ধাভাজন কাদের সিদ্দিকীর কথাগুলোর একটা জবাব দিচ্ছি; যা বিগত দিনে কখনো করিনি।

প্রথমত, আমি যে অনুষ্ঠানটি বঙ্গবন্ধু শতবর্ষ উপলক্ষে নিয়মিত উপস্থাপন করছি তার শিরোনাম ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব’। অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ, যা আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বা ইতিহাস থেকে পাই তার বাইরে তাঁর জীবন স্পর্শ করেছেন এমন লাখ লাখ মানুষের স্মৃতিকথনের মধ্য দিয়ে এমন এক মুজিবকে বের করে আনা যার সাক্ষাৎ আমরা প্রচলিত ইতিহাসে পাই না। এতে রাষ্ট্র রাজনীতি শাসনকার্যের বাইরে আসল মানবিক সরল-সহজ মুজিবকে দেখতে পাওয়া যাবে। জানতে পারা যাবে। এতে প্রচলিত ইতিহাসের বাইরে সত্যিকার মানুষের পরিচয় দাঁড় হবে। এভাবেই ইতিহাস পূর্ণতা পায় ব্রাত্যজনের অংশগ্রহণে। বাংলাদেশের রক্তাক্ত স্বাধীনতার পর যে অনুষ্ঠানটি আমার পরিকল্পনা ও পরিচালনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে করি সেটি ‘আমি কি ভুলিতে পারি’। প্রযোজক ছিলেন অনন্য অভিনেতা মুহাম্মদ জাকারিয়া। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেটি প্রথম ধারাবাহিক টিভি অনুষ্ঠান। ১৯৭২-৭৩-এ এটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু এ অনুষ্ঠান নিয়মিত দেখতেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর অনুষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০০৭-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে একটি অনিশ্চিত সময় সামনে এসে দাঁড়ায় এবং এ সময়গুলোয় সঠিক দিকনির্দেশনা একটি জাতির আশা-আকাক্সক্ষা স্বপ্ন পূরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনাসহ গুরুত্বপূর্ণ সব নেতা-কর্মী কারান্তরালে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ধ্বংসের মুখে। এ অবস্থায় আমি একটি বেসরকারি চ্যানেলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন অনুষ্ঠান শুরু করি। ‘মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন’ নামের অনুষ্ঠানটি ১৯৭৫-এর পর বিতাড়িত ‘যুদ্ধ ইতিহাস’ পুনরায় জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বা লড়াইয়ের প্রস্তাব বই আর কিছু নয়। অনুষ্ঠানটি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকন্যা অনুষ্ঠানটি নিয়মিত দেখতেন। তরুণ সমাজ দীর্ঘ ৩২ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা দেখে ও জেনে গৌরবান্বিত বোধ করে। জয় বাংলা সেøাগানে দেশ আবার মুখরিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাদের অবস্থান ঘোষণা করতে দ্বিধা করেনি। মূলত অনুষ্ঠানটি ১৫ আগস্টের পর ইতিহাস বিকৃতির আলোকে নির্মিত গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের বিপরীতে জনগণ দ্বারা নির্মিত সত্য ইতিহাসের বয়ান। মুক্তিযোদ্ধারা সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে তাদের নিজেদের কথা অকপটে জাতির সামনে তুলে ধরে বিকল্প ইতিহাস তৈরি করে। কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের সঙ্গে সে সময় দুবার দূরালাপনী মারফত কথা হয়। তাঁর সহযোদ্ধা হূমায়ূন বাঙ্গালী ও অন্য দুজন যোদ্ধার সাক্ষাৎকার ধারণকালে আমাদের এ আলাপে তিনি আমার অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেন তবে কিছু ভুল তথ্য অনুষ্ঠানে প্রচারিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। আমাকে এগুলো শুধরে নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে বলি যে, সাক্ষৎকার প্রদানকারী সব মুক্তিযোদ্ধা দায়িত্ব নিয়ে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করছেন। এখানে আমার ভূমিকা গৌণ। সব কথার সত্যতা যাচাই করাও সম্ভব নয়। তবে মুক্তিযোদ্ধারা সত্য বলছেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে কিছু অতিরঞ্জন তো হতেই পারে এবং কিছু তথ্যবিভ্রাটও ঘটে। তবে ভাবীকালে ইতিহাস রচয়িতারা গবেষণার মাধ্যমে তা নিরূপণ করবেন। এ ছাড়া ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে নির্মোহভাবে তথ্য প্রদানের পরিসর তৈরি করা। যা আমি করছি।

বর্তমানে যে মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব অনুষ্ঠান নিয়ে জনাব কাদের সিদ্দিকীর অভিযোগ সে অনুষ্ঠানেও আমি একই কৌশল অনুসরণ করছি। আমি খুব বড় তথ্যবিভ্রাট না হলে আমন্ত্রিত মুক্তিযোদ্ধা বা ব্যক্তির বয়ানে বাধা দিই না বা আমার জানা না জানা বিষয়টি চাপিয়ে দিই না। কেননা এত বড় মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে কোটি মানুষের ভূমিকা ও অভিজ্ঞতার কথা আমরা কতটুকুই বা জানি এবং জানা সম্ভবও নয়। আর বহুমাত্রিক বয়ানই তো জাতীয় ইতিহাসের পূর্ণতা দেয়। যদি এই নির্মোহ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করি তবে যে ইতিহাসের খোঁজে ১৯৭২ থেকে আমার যাত্রা তা তো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। আধুনিককালে বিকল্প ইতিহাস নির্মাণের প্রধান কৌশল হচ্ছে তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তি যেন কোনোভাবেই চ্যালেঞ্জড ফিল না করে। আমি অনুষ্ঠানে আনোয়ারুল আলম শহীদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা জানতে এবং জাতিকে জানাতে। সে অনুষ্ঠানে তিনি যা বলেছেন তা তাঁর একান্ত অভিজ্ঞতা। এর কোনো একটি বাস্তব ঘটনায় আমি তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলাম না। তাই তাকে ভুল বলার অধিকার আমার নেই। কিন্তু যে কেউ তার সঙ্গে দ্বিমত করতে পারেন। যা কাদের সিদ্দিকী করেছেন। কিন্তু জনাব শহীদের ভুল নির্দেশ করতে তিনি কেন আমাকে আক্রমণ করলেন তা আমার বোধগম্য নয়। আমি অনুষ্ঠানে কোনো মন্তব্য করি না। শুধু শেষে বক্তব্যের সারমর্ম তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উদ্ভাষণ দর্শক হৃদয়ে ঘটানোই আমার উদ্দেশ্য। আমি ভুলটা কোথায় করেছি! শহীদ সাহেব যা বলেছেন তা তার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত ও অভিজ্ঞতার বয়ান, আমার নয়। তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে কিন্তু আমাকে হেয় করার কারণ বুঝতে আমি অক্ষম। তা ছাড়া আনোয়ারুল আলম শহীদ এ মুহূর্তে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাসপাতালের আইসিইউতে। তার তো আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই। আমিও কভিড আক্রান্ত শরীর নিয়ে রোগশয্যা থেকে এ লেখা লিখছি। শহীদ ভাইকে আমি একজন সজ্জন ব্যক্তি ও কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান হিসেবে চিনি। তার কথা আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে তার মতান্তরের বিষয় আমার জানার কথা নয়।

আর দ্বিতীয় যে কথাটি আমার নিদারুণ কষ্ট ও লজ্জার মনে হয়েছে তা হলো, আমার বন্ধু ও আজীবনের নাট্য সহকর্মী নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের চিকিৎসা তহবিল-সংক্রান্ত জনাব কাদের সিদ্দিকীর নির্দয় ইঙ্গিত। আমি দেশের মানুষের অবগতির জন্য আজ থেকে এক যুগ আগের সেই ঘটনা স্মরণ করছি- ২০০৮ সালে যখন সেলিম আল দীনের জীবন রক্ষার্থে আমরা সবাই তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করি তখন সেলিম আল দীন দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে সম্পূর্ণ অচেতন। এ ধরনের রোগী বিদেশে জটিল চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া একটি ব্যয়বহুল কর্ম।

আমরা তার গুণগ্রাহীরা ত্বরিত ঢাকার ল্যাবএইডে বসে সিদ্ধান্ত নিই যেভাবে হোক টাকা আমরা সংগ্রহ করবই। প্রথমে ফরিদুর রেজা সাগর, অভিনেতা আফজাল হোসেন, সেলিম আল দীনের স্ত্রী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা ও আমি প্রত্যেকে সর্বশক্তি দিয়ে সর্বোচ্চ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করি। প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো তৎক্ষণাৎ সংগ্রহ সম্ভব বিধায় আমরা সিঙ্গাপুরে যোগাযোগ করি ও এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হয়। এদিকে সেলিমের হাজারো ছাত্র, গুণগ্রাহীকে নিয়ে আমার স্ত্রী শিমূল ইউসুফ ঢাকার চিকিৎসা ব্যয় মেটানো ও পবরর্তী সম্ভাব্য ব্যয় মেটানোর জন্য সর্বসাধারণ থেকে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেন এবং বিস্ময়ের বিষয় মাত্র এক দিনে সাধারণ সংস্কৃতিকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে প্রায় ১০ লাখের মতো অর্থ সেলিম আল দীন অস্থায়ী চিকিৎসা ফান্ডে জমা হয়।

কিন্তু আমাদের সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে আদি মাতার বরপুত্র সেলিম আল দীন পরদিন সকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। হাজার হাজার নাট্যকর্মী, ছাত্র ও সাধারণ মানুষের আহাজারি ও কান্নায় সমগ্র দেশ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। আমাদের সব আয়োজন ব্যর্থ হয়। আমরা সবাই প্রতিশ্রুত টাকা আর গ্রহণ করিনি। কিন্তু যে ১০ লাখের মতো ফান্ডে জমা হয়েছিল তা থেকে হাসপাতাল ও আনুষঙ্গিক খরচ এবং কজনের টাকা ফেরত দেওয়ার পর আনুমানিক ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা উদ্বৃত্ত হয়। বাকি টাকা কেউ আর ফেরত নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিই, যেহেতু টাকা অনেকে ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন তাই সে টাকায় একটি শিল্পীকল্যাণ তহবিল গঠন করে তার সদ্ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে।। আজ এত বছর পর মনে পড়ছে প্রয়াত আনিসুল হক (পরে মেয়র) তিনিও টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানান। আরও অনেকে আছেন যাদের নাম উল্লেখ করছি না। ২০০৮-এর ফেব্রুয়ারিতে শিমূল ইউসুফকে আহ্বায়ক ও আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফকে সদস্যসচিব করে ৫১ সদস্যবিশিষ্ট ‘শিল্পীমঙ্গল’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠিত হয় ও সমাজকল্যাণ অধিদফতরের রেজিস্ট্রেশন করা হয়। শিমূল উদ্বৃত্ত টাকার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত অনুদান ১ লাখ ৮০ হাজার যোগ করে মোট ৭ লাখ টাকার একটি স্থায়ী আমানত, ‘শিল্পীমঙ্গল’ অ্যাকাউন্ট, নিউ ইস্কাটন ইউসিবি ব্যাংকে রক্ষিত করেন; যা এখনো চলমান আছে। দীর্ঘদিন ধরে স্থিতি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ অসুস্থ, অসচ্ছল শিল্পীদের সময়ভেদে এককালীন সাহায্য দেওয়া হয়েছে এবং দেওয়া হচ্ছে। অথচ কোনো তথ্য যাচাই না করে কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের মতো একজন প্রথিতযশা ব্যক্তি আমার প্রতি যেন সন্দেহের উদ্রেক হয় এমত ইঙ্গিত তার লেখায় দিয়েছেন; যা দুঃখজনক ও অপমানজনক। শহীদ মিনারে আমি জনসমক্ষে প্রাপ্ত তহবিল সম্পর্কে সঠিক তথ্য জনগণকে জানিয়েছিলাম। তাই সবার প্রতি অনুরোধ- বিভ্রান্ত হবেন না। সত্য যাচাই করুন এবং সন্দেহমুক্ত হোন।

সব শেষে জনাব সিদ্দিকী আমার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা শুধু অনভিপ্রেতই নয়, সত্যের অপলাপ। আমি সর্বসাধারণের জন্য বক্ষ্যমাণ লেখায় তার সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রদান করছি।

আমি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত হইনি। তবে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রিত রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করি। ১৯৮৬ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও গ্রাম থিয়েটারের কর্মী হিসেবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্র পরিচালনার দাবিতে সরাসরি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। এমন এক তুমুল আন্দোলনের সময় অগ্রজপ্রতিম মোনেম সরকার আমাকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে যান। তিনি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাকে সব সংস্কৃতিকর্মীকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আন্দোলন পরিচালনার পরামর্শ দেন। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত সব আন্দোলন-সংগ্রামে আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনৈতিক জোটের প্রতি আনুগত্য অব্যাহত রেখেছি। যদিও সব বিষয়ে আমরা একমত হই না। কিন্তু বৃহত্তর জাতীয় ইস্যুতে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে আসছি তিন যুগ ধরে। আমি বড় আওয়ামী লীগার নই। সমালোচনাসমেত একজন সমর্থকমাত্র।

আমার ছাত্ররাজনীতির বয়স খুবই অল্প। মাত্র চার বছর। ১৯৬৭ সালে আমি জগন্নাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই এবং সে সময় জগন্নাথ কলেজের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজু। (পরে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন) তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ও বাঙালি জাতীয়তাবাদে আকৃষ্ট হয়ে আমি ছাত্রলীগে একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে যোগদান করি। উল্লেখ্য, ছয় দফা আমাকে প্রগাঢ়ভাবে শেখ মুজিবের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আমি রাজু ভাইয়ের কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এর মাঝে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে আমিও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। একপর্যায়ে তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসি। এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী ধারার পাশাপাশি আমি বাম রাজনীতির সমাজতন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ি। যা সত্তর দশকে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। যদিও দুটি ছাত্র সংগঠনের কোনোটিতে আমি কার্যনির্বাহী পদে ছিলাম না। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সঙ্গে আমার সখ্য বাড়ে। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা কজন বন্ধু মে মাসে ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায় যাই প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে সীমান্ত লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা শেষে ঢাকায় আসি নির্দিষ্ট অপারেশনের লক্ষ্যে। ব্যাপক না হলেও সীমিত সাফল্যের মধ্য দিয়ে ঢাকা অপারেশনসমূহ শেষ করি। দেশ স্বাধীন হলে আমি সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছে গণভবনে অস্ত্র সমর্পণ করি। আমি কোনো রাজনৈতিক দল ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আর জড়িত হইনি। ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক বন্ধু ম. হামিদের নেতৃত্বে আমি, শেখ কামাল, আল মনসুর, হাবীবুল হাসান, আবদুল কাদের, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাসন্তী গোমেজ, খায়রুল আলম সবুজ, নরেশ ভূইয়াসহ একদল যুদ্ধফেরত ছাত্র ‘নাট্যচক্র’ গঠন করি। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর রাজনৈতিক টানাপড়েনে হতাশ হয়ে ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় আমি রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। আর কখনো কোনো রাজনৈতিক সংগঠনে জড়াইনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন, মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দাবিতে নানা ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয় থাকি। ’৭৫-এর ভয়াবহ মর্মান্তিক বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সময় আমি রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নই। তাই জিয়াউর রহমানের পক্ষে কাজ করার কোনো কারণ ঘটেনি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিককালে তার কিছু অ্যাকশন তাকে যুদ্ধনায়কে রূপান্তরিত করে। পরে মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শফিউল্লাহ, কাদের সিদ্দিকী, হেমায়েত উদ্দীন, মাগুরার আকবর, মেজর আফসার প্রমুখ কিংবদন্তি যোদ্ধা হিসেবে জনমানসে স্থান করে নেয়। আমি সেক্টর-২-এর যোদ্ধা হিসেবে আজীবন খালেদ মোশাররফের অনুগামী রয়েছি। ৩ নভেম্ব^র ব্রিগেডিয়ার খালেদ বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের পরাজিত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করলে আমরা আশাবাদী হই। কিন্তু স্বল্পতম সময়ে খালেদ, হায়দার নিহত হলে আমরা এক দীর্ঘ হতাশায় নিমজ্জিত হই। তখন পর্যন্ত জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত নয়- এমন ধারণা প্রচলিত। তাই তার সম্পর্কে তৈরি মিথে নির্ভর করে মানুষের কিছু প্রত্যাশা তৈরি হয়। মুক্তিযোদ্ধারা আশা করে যে, জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার করবে। জয় বাংলা ধ্বনি জাতীয়ভাবে ফিরিয়ে আনবে। আমরা তার কাছে সে রকম দাবি নিয়ে যাই কিন্তু তিনি নির্লিপ্ত রইলেন। কিছুদিন পর আমরা দেখি জিয়া সম্পূর্ণ উল্টোপথে হাঁটছে। যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে। ১৯৭৭ সালে সেলিম আল দীন ও আমি ঢাকা থিয়েটারের ‘নাচাও রাস্তা নাচাও’ আন্দোলন শুরু করি। নাটক : চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি। নাটকের বিষয় বা গল্পটা এমন- ‘এক সকালে সমুদ্র থেকে উঠে আসে এক বিশাল নিরীহ প্রাণী। চরবাসী প্রাণীটিকে বুঝতে বা চিনতে পারে না। প্রাণীটিকে হত্যা করে। সন্ধ্যায় সমুদ্রে ঝড় ওঠে। জলোচ্ছ্বাস হয়। চর ও চরবাসী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়!’ হাজার হাজার মানুষ আমাদের এই রূপক নাটক দেখে নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা পুনর্নিরিখ করে। বুঝতে চায়। ব্যাখ্যা করে ঘটনার। এক বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সড়কদ্বীপে নাটকাভিনয় চলাকালে পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। অভিনেতা হাবীবুল হাসান, শিমূল বিল্লাহ, আমিসহ ঢাকা থিয়েটারের মোট ১৭ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। সাদা পোশাকে সেনা ও অন্যান্য বাহিনীর লোকজন চার ঘণ্টা ধরে জেরা করে। জানতে চায় সামরিক শাসনের মধ্যে রাস্তায় লোক জমায়েত করে নাটক করার উদ্দেশ্য কী। বুঝতে চায় নাটকের গল্পটা আসলে কী বলতে চায়। প্রাণীটা কে! কারা হত্যা করেছে। আবার সবাই প্রকৃতির অভিশাপে কেন নিশ্চিহ্ন হবে! ইত্যাদি। আমরা সামুদ্রিক ঝড়ের কারণ মানুষ অরণ্য ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে ইত্যাদি বোঝালাম। তাদের কপালে ভাঁজ এবং চোখে সন্দেহ থেকেই গেল।

যাক, রাতে ছাড়া পেলাম। নিশ্চয়ই আমাদের নাটকের বিষয় ও আমাদের গ্রেফতার হওয়া জিয়াকে ক্ষমতায় রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা বলে প্রতীয়মান হয় না।

১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নির্বাচনকর্মী হিসেবে সরাসরি কাজ করেছি। ১৯৭৮ সালে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দেশে প্রত্যাগমনের সুযোগ দেওয়ায় দেশব্যাপী যে আন্দোলন সূচিত হয় সে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখি। শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী ও কুখ্যাত রাজাকার আবদুল আলীমসহ অনেক স্বাধীনতাবিরোধীকে মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদে স্থান দিয়ে জিয়া যে মহা অন্যায় করে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আমরাই সবচেয়ে সরব ছিলাম। ১৯৭৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ও সাম্প্রদায়িক অপচেতনার আলোকে সংবিধান ধ্বংসের যে নীলনকশা জিয়া ও তার অনুসারীরা নিয়েছিল তার বিরোধিতা করে দেশব্যাপী রাজাকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে আমি মুখ্য ভূমিকা পালন করি, ইতিহাস এ সাক্ষ্যই দেয়। সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের সব স্থাপনা জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে জিয়া নিহত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও একটা ভিন্ন বলয়ে প্রবেশ করে। খন্ডিত-বিখন্ডিত সংবিধান ধ্বংসের অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রধর্মসহ নানা সাংঘর্ষিক বিধির সন্নিবেশনায় কার্যত সংবিধানের শরীর থেকে মুক্তিযুদ্ধ নির্বাসিত হয়। সংস্কৃতিকর্মী ও ছাত্ররা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে; সেখানেও আমার ভূমিকা সুস্পষ্ট।

১৯৯০-এ স্বৈরাচার এরশাদের পতন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালত গঠন ও আন্দোলন, ১৯৯৫-৯৬ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন, ২০০৪-এ ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার জন্য দায়ী চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলাসহ সব আন্দোলনে আমি নিশ্চিতভাবে সঠিক ভূমিকা রেখেছিলাম। তার পরের ২০০৭-২০০৯-এর কথা তো আগেই বলেছি।

সর্বশেষ ২০১৩-এর গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনে আমার ভূমিকা সম্পর্কে কমবেশি সবাই জ্ঞাত। জনাব কাদের সিদ্দিকী ও প্রয়াত জাতীয়তাবাদী নেতা সাদেক হোসেন খোকা সে সময় টিভি চ্যানেলে আমাকে নিয়ে সমালোচনা করেছেন। এ কথাও এখনো স্মৃতিতে রয়েছে। গণজাগরণের অব্যাহতিতে যে কোনো ধরনের অসংগতির বিরুদ্ধে আমাদের সংস্কৃতিকর্মীদের আন্দোলন অব্যাহত আছে। আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করি এবং মন্দ কাজগুলোর নিন্দা করি। এটিই আমাদের কাজ।

আর এসব করতে গিয়ে যে কোনো অযৌক্তিক নিন্দা ও সমালোচনায় দমে না গিয়ে এগিয়ে যাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা সমাজ ও সংস্কৃতিকর্মীর কাজ। আর সে কাজে কোনো দিন পিছপা হব না।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আধুনিক রাষ্ট্র বাংলাদেশই আমাদের লক্ষ্য। আসুন ব্যক্তিগত ও ক্ষুদ্র ভেদাভেদ ভুলে সে লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাই। জয় আমাদের হবেই।

জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

     লেখক :  সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর