শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

জঙ্গি হামলায় দুই বিচারকের আত্মদান নির্ভীক পথচলার প্রেরণা

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম

জঙ্গি হামলায় দুই বিচারকের আত্মদান নির্ভীক পথচলার প্রেরণা

২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর সকালে ঝালকাঠি জজশিপের দুজন বিচারক, সিনিয়র সহকারী জজ জগন্নাথ পাঁড়ে এবং এস সোহেল আহমেদ যখন সরকারি বাসভবন থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার উদ্দেশে আদালতের একটি মাইক্রোবাসে আরেকজন বিচারকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখন তাঁদের ওপর উগ্র-ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে বর্বরোচিত ও পৈশাচিক বোমা হামলা চালায়।  বোমা হামলায় ওই দুই সহকারী জজের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, ঘটনাস্থলেই তাঁদের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয় মাইক্রোবাসটিও। হামলাকারীদের একজন ইফতেখার হাসান-আল-মামুন ওরফে শিহাবকে আহত অবস্থায় পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত লিফলেট থেকে এই হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ও জঙ্গিগোষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া যায়। উদ্ধারকৃত লিফলেটে বক্তব্য ছিল- ‘মানব রচিত আইন মানি না। তাগুদি আইন মানি না। মানব রচিত আইন বাতিল কর।’ সংগঠনের নাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল জামাআ’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ।

এ ঘটনার তিন মাস আগে ১৭ আগস্ট দেশের ৬৪টি জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় একই সময় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণসহ দেশের বিভিন্ন আদালত এবং কালেক্টরেট ভবনসহ সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিস প্রাঙ্গণে। ওই ঘটনায় হতাহত বা সম্পত্তির ক্ষতি তেমন ছিল না। কিন্তু প্রতিটি বিস্ফোরণ স্থলে পাওয়া গিয়েছিল একই বক্তব্যের লিফলেট। লিফলেটে বোমা বিস্ফোরণকারীদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য উল্লেখ ছিল। লিফলেটে দেশের সংবিধান, প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল- ‘তাগুদি আইন মানি না, কোরআনের আইন চালু কর, মানব রচিত আইন বাতিল কর।’ সংগঠনের পরিচয় দেওয়া হয়েছিল উপরোক্ত সংগঠনটির।

ঝালকাঠির ওই মর্মান্তিক ঘটনার সময় সদ্যপ্রয়াত মাহবুব আলম এবং আমি যথাক্রমে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির আহ্বানে ১৭ নভেম্বর সারা দেশে সব পর্যায়ের আদালত বর্জন করা হয়। সমিতির পক্ষ থেকে নিহত বিচারকদ্বয়ের প্রত্যেক পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা প্রদানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। কিন্তু সে সময়ে সরকার নিহত বিচারকদের পরিবারের প্রতি তেমন কোনো সহানুভূতি দেখিয়েছিল মর্মে জানা নেই; বরং অভিযোগ ছিল জঙ্গিগোষ্ঠীর পেছনে তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার। সে সময়ের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, পরবর্তীতে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে যার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, গণমাধ্যমে বলেছিলেন-‘জঙ্গি মিডিয়ার সৃষ্টি, বাংলাভাই মিডিয়ার সৃষ্টি’। ওই ঘটনার ৫/৬ দিন পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষে আমরা ঝালকাঠি যাই। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পেয়েছিলাম বিধ্বস্ত মাইক্রোবাস এবং সংলগ্ন একটি গাছে ঝুলে থাকা মাংসপি- ও রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। বীভৎস করুণ দৃশ্য দেখে আমাদের সবার শরীর ভয়ে শিহরিত হয়েছিল। পরে ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতিতে গিয়ে আমরা প্রতিবাদ সভা করি। স্থানীয় আইনজীবীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান ও জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। বিচারকদের সঙ্গেও মিলিত হয়ে তাঁদের মনোবল অটুট রাখা এবং ধৈর্য ধারণ করে কোনো অপশক্তির হুমকিতে ভীত না হয়ে বিচারকার্য অব্যাহত রাখার তাঁদের দৃঢ় অঙ্গীকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি। আমরা ভোলায় সোহেল আহমেদের কবর জিয়ারত করি, তাঁর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেশের আইনজীবী সমাজের সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাই। জগন্নাথ পাঁড়ের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটায় হলেও তাঁকে দাহ করা হয়েছিল বরিশাল শ্মশানঘাটে। আমরা সেখানেও গিয়েছিলাম। বরিশাল শহরে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী ও স্বজনদের সমবেদনা জানাই। সে সময়ে তাঁদের একমাত্র সন্তানের বয়স ছিল দুই/তিন বছর।

ঝালকাঠিতে বোমা হামলার মাত্র কয়েক দিন পর অর্থাৎ ২৯ নভেম্বর গাজীপুর আইনজীবী সমিতির একটি ভবনে আদালতের কার্যক্রম শুরুর পূর্ব মুহূর্তে জঙ্গিরা আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। একজন আত্মঘাতী আইনজীবীদের ব্যবহৃত কালো গাউন পরে ওই ঘটনাটি ঘটায়। ওই হামলায় চারজন আইনজীবী, তিনজন বিচারপ্রার্থীসহ আত্মঘাতী জঙ্গি নিহত হয়। ওই দিন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আমি ১ ডিসেম্বর সারা দেশে হরতাল পালনের প্রস্তাব উপস্থাপন করলে সাধারণ আইনজীবীরা অকুণ্ঠভাবে ওই প্রস্তাবে সমর্থন জানান। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আহূত ওই হরতালে সমর্থন জানিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক দল-জোট, ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবী-সাংস্কৃতিক সংগঠন; এমনকি ওইসব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন- যারা সে সময় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির বিরুদ্ধে ছিল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির আহ্বানে ‘দেশব্যাপী হরতালের’ ব্যতিক্রম কর্মসূচিতে দেশের সর্বস্তরের মানুষের ছিল স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। হরতালে ১ ডিসেম্বর ২০০৫ সারা দেশ স্থবির হয়ে যায়-পালিত হয় শান্তিপূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসেন ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সব পেশা ও শ্রেণির মানুষ। রাজপথে ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-জোট ও শ্রমিক সংগঠনও।

জঙ্গিদের প্রধান টার্গেট ছিল বিচারব্যবস্থার ওপর। দুজন বিচারকের হত্যা মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ঝালকাঠির বিজ্ঞ অতিরিক্ত দায়রা জজ ২৯/০৫/২০০৬ইং তারিখের রায় ও আদেশে সাত জঙ্গিকে দন্ডবিধির ১২০খ/৩০২/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে ফাঁসির সাজা প্রদান করেন। বিচারকালীন সময়ে আদালতে জঙ্গিদের বক্তব্যসমূহ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় দেশের প্রচলিত আইন-আদালত ও বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের সশস্ত্র অবস্থানের কথা। মামলার অভিযোগ গঠনের সময় জঙ্গি নেতা আবদুর রহমানকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পড়ে শোনানো হলে তার জবাব ছিল, ‘যারা আল্লাহর আইনে বিচার করে না তাদের হত্যা করার জন্য আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম। আমার নির্দেশে বিচারক দুজনকে হত্যা করা হয়। মানুষের আইনে আমি দোষী, আল্লাহর আইনে নির্দোষ। আমি কোনো আইনজীবী নিয়োগ করিব না।’ সিদ্দিকুল ইসলাম প্রামাণিক ওরফে বাংলাভাই আদালতে বলেছিল, ‘যে মামলায় আমাকে অভিযুক্ত করা হইয়াছে তাহাতে আমি নির্দোষ। আল্লাহর আইনে বিচার চাই। মানুষের আইনে বিচার চাই নাই। কোনো আইনজীবী নিয়োগ করিব না’। অন্যান্য অভিযুক্ত আবদুল আউয়াল, মামুন, আতাউর রহমান সানি, আমজাদ সবাই একই ভাষায় আদালতকে জানিয়েছিল- তারা মানুষের তৈরি আইনে বিচার চায় না, আল্লাহর আইনে বিচার চায়। তারাও নিজ নিজ পক্ষে আইনজীবী নিয়োগে অস্বীকৃতি জানায়। সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন শেষে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৩৪২ অনুসারে অভিযুক্তদের পরীক্ষা করার সময়ে আবদুর রহমানের বক্তব্য ছিল, ‘... আমরা বাংলাদেশের প্রচলিত আইন মানি না। আমি আল্লাহর আইনে বিচার চাই। আমার মতে, আমি নির্দোষ, আমরা এ দেশের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। আমরা এ দেশের বিচারক, পুলিশ এদের হত্যার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আল্লাহর নির্দেশনা মতে দল গঠন করেছি ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছি।’ অভিযুক্ত মামুনের বক্তব্য ছিল- ‘শায়খ আবদুর রহমান-এর নির্দেশে ও খালেক সাইফুল্লাহ-এর নেতৃত্বে আমি দুইজন জজকে হত্যা করিয়াছি’। অপর অভিযুক্ত আমজাদের বক্তব্য ছিল- ‘... পরে আমরা সশস্ত্র জিহাদের পক্ষ অবলম্বন করেছি। শায়খ আবদুর রহমানের নির্দেশে ঝালকাঠিতে বোমা হামলা সংঘটন ও দুইজন বিচারক হত্যা করতে পেরে আমি গর্বিত।’ এ মামলায় অভিযুক্ত মামুন ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৬৪ অনুসারে প্রদত্ত জবানবন্দিতে দুজন বিচারককে হত্যার উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও আক্রমণ সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করেছে।

হাই কোর্ট বিভাগ ডেথ রেফারেন্স নং-৪৭/২০০৬-এ বিচারিক আদালত কর্তৃক দন্ডিত সবার ফাঁসির সাজা অনুমোদন করে। দন্ডিতরা হাই কোর্টে কোনো আপিল করেনি। দন্ডপ্রাপ্ত ইফতেখার মামুন আপিল বিভাগে জেল আপিল দায়ের করে, অন্যরা আপিল বিভাগে কোনো আপিল দায়ের করেনি। আপিল বিভাগে দন্ডিত আবদুর রহমান কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে একটি দরখাস্ত দাখিল করে, যেখানে তার বক্তব্য ছিল- ‘...। অতএব যারা মানুষের তৈরি করা সংবিধান, বিধান বা আইনের কাছে বিচারপ্রার্থী হয় তাঁরা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করলেও তাঁরা ইমানদার নয় বলে উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহতায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন। কাজেই যদি কেহ ইমান বিধ্বংসী কাজ করে তবে মুসলিম দাবি করলেই তাকে রেহাই দেওয়া যাবে না।’ দন্ডিত বাংলাভাই আপিল বিভাগে দায়েরকৃত দরখাস্তে উল্লেখ করেছিল ‘...। তাই মুসলিম হিসেবে এ আইনে বিচার প্রার্থী হলে ঈমান থাকবে না। আমি কোর্টে আপিল করিব না।’ অপর দন্ডিত আবদুল আউয়াল তার দায়েরকৃত দরখাস্তে উল্লেখ করে ‘...। আমার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বিরুদ্ধে মহামান্য উচ্চ আদালতে লিভ টু আপিল করতে ইচ্ছুক। যদি আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয় এবং ইসলামী বিধান অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়। ...। অতএব আমার মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করার বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে ইসলামী জুরিবোর্ড গঠন করে আল্লাহর আইনে পুনরায় বিচার করার আবেদন করছি, অন্যথায় সম্ভব না হলে আমার বিচার তাগুদি আইনে না করার আবেদন করছি।’

আপিল বিভাগ দন্ডিতদের এসব দাবি ও বক্তব্যকে ‘অলীক স্বপ্ন (রসধমরহধৎু ফৎবধস)’ মর্মে অভিহিত করে অভিমত দিয়েছে যে, আমাদের সংবিধানে এ ধরনের বিচার পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দেয় না। ইসলামী আইনে বিচারের দাবি ‘আজগুবি ধারণা (ঁঃড়ঢ়রধহ পড়হপবঢ়ঃ)’ এবং আমাদের বিচারব্যবস্থায় এটি একটি অজানা বিষয়। [ডি এল আর-৫৯, পৃ: ৩৫(এডি)]

আপিল বিভাগের রায়ে আরও অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম। দন্ডিতরা পবিত্র ইসলামের নাম ব্যবহার করে দেশের প্রচলিত আইন-বিচারব্যবস্থাকে অচল করার ‘হিংস্র পাগলামি তৎপরতায় (রিষফ সধফ ংঃৎঁমমষব)’ লিপ্ত হয়ে দুইজন বিচারককে হত্যা করেছে। ইসলাম কি এ ধরনের হত্যাকান্ড সমর্থন করে? হতভাগ্য ওই দুইজন বিচারকের ওপর কি ইসলামী আইন প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল? ইসলাম কি ধর্ম পালনে জবরদস্তি বা শক্তি প্রয়োগ অনুমোদন করে? দন্ডিতরা ইসলামের নামে গর্হিত পাশবিকতার যে পথ বেছে নিয়েছে তা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে’। রায়ে পবিত্র কোরআন শরিফের সুরা মায়িদার ৩২ নং আয়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে; যেখানে উল্লেখ আছে-‘নরহত্যা অথবা দুনিয়ার ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ব্যতীত কোনো ব্যক্তি যদি অপর কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই (মানব জাতি) হত্যা করল। আর কেউ যদি কারও প্রাণ রক্ষা করে সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’ প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ওই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (ঝালকাঠির পাবলিক প্রসিকিউটর) মো. হায়দার হোসাইনকেও জঙ্গিরা পরবর্তীতে হত্যা করে।

শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম ‘ইসলাম’ কখনই গুপ্তহত্যা কিংবা আত্মঘাতী হয়ে কাউকে হত্যা অনুমোদন করে না। রসুল মুহাম্মদ (সা.) বদরের যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনো তাঁর সহযোদ্ধা বা সাহাবাদের শত্রু পক্ষের কাউকে গুপ্ত হত্যা বা আত্মঘাতী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন এমন কোনো নজির পাওয়া যায় না। রসুল মুহাম্মদ (সা.) ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদের’ ভিত্তিতে মদিনা ও এর পাশর্^বর্তী এলাকার বিভিন্ন ধর্ম-গোত্রের মানুষকে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ করে একটি ‘জাতি (কওম) রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার সূচনা করেছিলেন। ‘মদিনা সনদে’ চুক্তিভুক্ত মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টানসহ সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষকে একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতায় এনে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকারের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও সম-অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছিল। রসুল (সা.)-এর ওই ‘মদিনা সনদ’ বিশ্বে অনন্য নজির হয়ে আছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের চরমপন্থা পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহর ঐশী বাণী হচ্ছে-‘এভাবে আমি তোমাদের এক-মধ্যপন্থি জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষী হতে পার, আর রসুল তোমাদের জন্য সাক্ষী হবেন (সুরা বাকারা-১৪৩)।’ সুরা বাকারা : আয়াত ২৫৬-এ উল্লেখ করা হয়েছে-‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই।’ আর সুরা কাফিরুন : আয়াত-৬ এ উল্লেখ করা হয়েছে-‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের। আমার ধর্ম আমার।’ পরধর্মসহিষ্ণুতা বিষয়ে মহান আল্লাহর বাণী হলো-‘অবশ্য যারা ধর্ম সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো কাজের দায়িত্ব তোমার নয়, তাদের বিষয় আল্লাহর এখতিয়ার। আল্লাহ তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে তাদের জানিয়ে দেবেন (সুরা আন্আম-১৫৮)।’ ‘তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে সবাইকে বিশ্বাস করত। তাহলে কি তুমি বিশ্বাসী হওয়ার জন্য মানুষের ওপর জবরদস্তি করবে?’ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া বিশ্বাস করার কারও সাধ্য নেই (সুরা ইউনুস-৯৯-১০০)। ‘কিন্তু তারা (মানুষ) নিজেদের ব্যাপারকে (ধর্মকে) বহুভাগে বিভক্ত করেছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট। তাই ওদেরকে কিছুকালের জন্য বিভ্রান্তিতে থাকতে দাও (সুরা মুমিনুল-৫৩-৫৪)। মহান আল্লাহর উপরোক্ত বাণীসমূহের আলোকে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইসলাম ধর্ম নিয়ে উগ্রতা বা চরমপন্থা অবলম্বন সীমা লঙ্ঘনের শামিল। ‘আল্লাহ তো সীমা-অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না (সুরা বাকারা-১৯০)। বরং পবিত্র কোরআন শরিফে সীমা লঙ্ঘনকারীদের বারংবার সতর্ক করা হয়েছে।’

জঙ্গিদের খোলামেলা বক্তব্য, অবস্থান ও কর্মতৎপরতা থেকে এটাই সুস্পষ্ট যে, তাঁদের অবস্থান বাংলাদেশের সংবিধান, আইন, বিচারব্যবস্থা অর্থাৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। তাদের প্রধান টার্গেট ছিল বিচারক ও আইন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে আবারও একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিপ্রায়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা বিভিন্ন নামে এবং অবয়বে এখনো তৎপর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে-উগ্রবাদী, জঙ্গি, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লালন-পালন পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধারাবাহিকভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী জঙ্গি দমনে যথেষ্ট তৎপর ও সফলতা দেখিয়েছে এবং দেখাচ্ছে। জঙ্গি হামলায় নিহত দুই বিচারকের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁদের প্রতি অশেষ বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁদের আত্মদান হোক দেশের সব বিচারকের নির্ভীক ও সাহসী পথচলা এবং দেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনার প্রত্যয় ও প্রেরণা।  আমরা যারা বেঁচে আছি তাঁদের ভুলে গেলে চলবে না-কবি জীবনানন্দ দাশের ‘মানুষের মৃত্যু হলে’ কবিতার পঙ্ক্তিমালা-

‘মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব

থেকে যায়, অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে

প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।

কতো দূর অগ্রসর হয়ে গেল জেনে নিতে আসে।’

 

►  লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্ট বিভাগ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর