শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পঞ্চগড়ের সজল বায়োফ্লকে সফল

শাইখ সিরাজ

পঞ্চগড়ের সজল বায়োফ্লকে সফল

গত সপ্তাহে লিখেছিলাম নাটোরের একদল তরুণ উদ্যোক্তা কীভাবে প্রযুক্তির সহায়তায় অল্প জায়গায় অধিক মাছ চাষ করে সফলতার গল্প গাঁথছেন সে কথা। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মাছ চাষে তরুণ উদ্যোক্তারা এখন বেশ সরব। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এই তরুণরা যে শুধু যথেষ্ট আগ্রহীই তা নয়, তারা নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনেক বেশি সাহসী। প্রিয় পাঠক, আজ আরেক তরুণ উদ্যোক্তার প্রযুক্তিনির্ভর মাছ চাষের সাফল্যের কথাই আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চাই।

গত অক্টোবরের শেষ দিকে। দেশের সর্ব উত্তরের জেলায় সকাল বেলা।  বাতাসে শীতের আমেজ। সূর্য তখন উঠে গেছে, হালকা কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে আছে প্রকৃতি। গাড়ি চলছে পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে আটোয়ারী উপজেলার দিকে। খেতে খেতে সবুজ ধান। কুয়াশা ভেদ করে যতদূর দেখা যায়, শুধু ফসলের মাঠ। মাঠের মাঝখানে দু-একটা গাছ। ফলে-ফসলে উত্তরাঞ্চল এই বছরকয়েক অনেক পাল্টে গেছে। সমৃদ্ধির ছোঁয়া চোখে পড়ে। যাই হোক, মিনিট বিশের মাঝেই পৌঁছে গেলাম আটোয়ারী উপজেলায়। এখানকার বাড়িগুলোও খুব সুন্দর। বেশ গোছানো। গিয়ে থামলাম নিরিবিলি এক বাড়িতে। সেই বাড়িরই ছেলে শাহরিয়ার কবির সজল। পড়াশোনা শেষ করে কীভাবে উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত হওয়া যায়, এই স্বপ্ন ছিল তার।

২০১৫ সালে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে চাষাবাদের অনুষ্ঠান দেখে এ বিষয়ে তার আগ্রহ জন্মে। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর করে শুরু করেন অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে মাছ চাষ। কিন্তু সে যাত্রায় সাফল্য ধরা দেয়নি। সাফল্য আনার জন্য প্রচেষ্টা চলতে থাকে তার। মাথায় ঘুরতে থাকে অ্যাকুয়াপনিক্সে ব্যবহৃত ট্যাংকগুলোকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়। এ সময়ই তিনি খোঁজ পান বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের। ভারতের কেরালা থেকে বায়োফ্লক বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে মাছ চাষ শুরু করেন। এই হিসাবে একেবারে প্রথম দিকে যারা বায়োফ্লক শুরু করেছেন সজল তাদেরই একজন। বছর দুয়েক আগেই সজলের এই বায়োফ্লক প্রকল্পের খবরটি আমার কাছে আসে। কিন্তু যাব যাব করে যাওয়া হচ্ছিল না।

পাঠক বলে রাখি, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে এখনো নির্ভরযোগ্য কোনো কৌশল বেছে নেওয়া সম্ভব হয়নি। একেক উদ্যোক্তা একেকভাবে সফল হওয়ার দাবি করছেন। সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে বায়োফ্লক প্রশিক্ষণ বিষয়ক কোচিং বাণিজ্য। আরও একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলে রাখতে চাই, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ মূলত একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি। বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি দক্ষ না হয়ে বড় ধরনের বিনিয়োগে যাওয়া ঠিক হবে না।

যাই হোক, সজল বলছিলেন মাছ চাষের বিভিন্ন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাড়ির পেছনের দিকে গড়ে তুলেছেন মাছ চাষ প্রকল্প। ছোট-বড় বিভিন্ন ট্যাংক এবং পুকুরে প্রয়োগ করেছেন বায়োফ্লক প্রযুক্তি। সব মিলিয়ে ২৫ লাখ লিটার পানিতে মাছ চাষ করছেন তিনি।

অধিকাংশ তরুণ উদ্যোক্তাই বায়োফ্লক নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। নারায়ণগঞ্জের জহিরুল, কুমিল্লার রোমেল কিংবা ময়মনসিংহের আশ্রাফ সবাই বায়োফ্লক নিয়ে নিজেদের মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে সারা দেশে এই প্রযুক্তির বহু উদ্যোগের খবর পাচ্ছি। উদ্যোক্তা সজলও শুধু মাছ চাষ নয়, বায়োফ্লককে টেকসই করতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে এই পদ্ধতিতে কী কী মাছ, কোন কোন উপায়ে কিংবা কোন মৌসুমে চাষ করলে একজন উদ্যোক্তার টেকসই সাফল্য আসবে, বিষয়গুলো তিনি হাতেকলমে পরীক্ষা করছেন। আবার মোলাসেসবিহীন বায়োফ্লক করলে মাছের উৎপাদন কেমন হবে। কিংবা প্রোবায়োটিক ব্যবহারের সঠিক উপায় কী? এসব নিয়েও রয়েছে তার বিষদ গবেষণা। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মাছ উৎপাদনে লোকসান গুনতে চান না তিনি। উৎপাদন নিশ্চিত করা এবং উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতেই তার সব প্রচেষ্টা। শুধু তাই নয়, পুকুরে বায়োফ্লক প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তার অসাধারণ সাফল্য রয়েছে। সজলের দাবি, পুকুরে বায়োফ্লক প্রযুক্তি প্রয়োগ তার হাত দিয়েই শুরু।

একটি ছোট্ট ছাউনির নিচে পুকুর। বলা হচ্ছে ‘পন্ড কালচার’। দেড় শতাংশ জমিতে তৈরি ছোট্ট এক পুকুরে ৫০ হাজার লিটার পানিতে চাষ হচ্ছে তেলাপিয়া। সজলের এই কৌশলটি আর কোথাও দেখিনি। অন্যরা যেখানে সিমেন্টে বা প্ল্যাস্টিক কাগজ ব্যবহার করে ট্যাংক তৈরি করে নিয়েছে। সেখানে সজল বালুর বস্তা আর কোরিয়ান পিভিসি কোটেড প্লাস্টিক ব্যবহার করে তৈরি করে নিয়েছেন ছোট্ট পুকুর। সজল জানালেন, মাত্র ৩০ ফুট বাই ১৮ ফুট জায়গাতে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব। এতে চার মাসে খরচ হবে ৭০ হাজার টাকা। আর উদ্যোক্তার হিসাবে, বিক্রি হবে কমপক্ষে সাড়ে ৩ লাখ টাকার মাছ। শাহরিয়ার কবির সজল একটি তথ্য দিলেন, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে মাছে অটোগ্রেডিং হয়। মাছের ঘনত্ব বেশি হওয়ায় একই সময়ে ছাড়া হলেও কিছু মাছ একই সময়ে সমানভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। ফলে তিন আকারের মাছ পাওয়া যায় পুকুরে।

সজলের বায়োফ্লক খামারে চোখে পড়ল তিনটি বড় সিমেন্টের ট্যাংক। জানাল, এই তিনটি সিমেন্টের ট্যাংক দিয়েই শুরু হয়েছিল তার প্রথম অ্যাকুয়াপনিক্স উদ্যোগ। এখন তা ব্যবহার হচ্ছে বায়োফ্লকে। একটা থেকে ভিয়েতনামি কৈ মাছ তোলা হচ্ছে। সাড়ে তিন মাস আগে সেখানে মাছ ছাড়া হয়েছিল। আর এই সময়ে তিন/চারটায় এক কেজি ওজন হয়ে গেছে। আর একটু এগোতেই চোখে পড়ল গ্রিন হাউস। সজল জানাল, সেটা ছিল গ্রিন হাউসে অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে মাছ চাষ ব্যবস্থা। যা পাল্টে এখন গড়া হয়েছে বায়োফ্লক প্রকল্প। একপাশে তেলাপিয়া আর অন্যপাশে রূপচাঁদা চাষ হচ্ছে। সজল বলছেন, রূপচাঁদা মাছে সফলতা পাওয়া গেলে আরও একধাপ সাফল্য আসবে বায়োফ্লক পদ্ধতির।

পাশেই পাশাপাশি দুটো পুকুরে ভিয়েতনামি কৈ-এর চাষ। তৃতীয়বারের মতো মাছ ধরা চলছে। এর আগেও দুবার মাছ ধরা হয়েছে সেখান থেকে। এরই মধ্যে এখান থেকে এবার ৬ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে। যাতে খরচ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ টাকার মতো। দৃষ্টি গেল পানি সরে যাওয়া পুকুরের তলদেশে বসানো ডিফিউজারগুলোর দিকে। এগুলো কীভাবে পানিতে অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণ করে সে বিষয়ে কথা হলো সজলের সঙ্গে। তরতাজা কৈ মাছ। মাছের আকার দেখলেই পুলকিত হয়ে ওঠে মন। মনে হয় যেন প্রাকৃতিক উৎসের মাছ। মাছ ব্যবসায়ী বেলাল হোসেনও তেমনটাই বলছিলেন। বাজারে বিক্রির অভিজ্ঞতাও বেশ ভালো তার। বললেন, এই মাছের রং ও স্বাদে দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। সজলের সাফল্যটিও বোধহয় এখানেই। উৎপাদন ও বিক্রি নিশ্চিত করতে পেরেছে সে। তার উৎপাদিত মাছ ক্রেতা বা ভোক্তার কাছে গ্রহণযোগ্য। গত চার বছরে তার নিরলস শ্রম, মেধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে একটু একটু করে লগ্নি করেছে আর লাভ তুলেছে কোটি টাকার উপরে।

একেবারে উত্তরের প্রত্যন্ত জনপদ থেকে বেড়ে উঠতে সজলকে মোকাবিলা করতে হয়েছে বহু প্রতিবন্ধকতাও। কিন্তু সেখানে টিকে থাকতে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তার মা সামশুন্নাহার। মায়ের এমন শক্তিশালী উৎসাহ আর গণমাধ্যমের অনুপ্রেরণায় সজল আগামীতে বায়োফ্লক নিয়ে মাছ উৎপাদন করে এগিয়ে যেতে চায় বহুদূর।

সাফল্যের জন্য প্রয়োজন দায়বদ্ধতা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা। কৃষি সাফল্যের প্রতিটি উদ্যোক্তার ক্ষেত্রেই এ বিষয়গুলো পাই। এই বিবেচনায় সজলও একজন অসাধারণ উদ্যোক্তা। অনেকেই সজলের কাছে এসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে সফল হয়েছেন, অনেকেই পারেননি। তবে এটি বেশ চ্যালেঞ্জের বিষয়। বাংলাদেশের তরুণরা এ বিষয়ে খুব আগ্রহী। সারা দেশেই বইছে বায়োফ্লকের জোয়ার। তাই সরকারের মৎস্য গবেষণা সংস্থাগুলোর উচিত হবে বায়োফ্লক কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত, প্রকৃত অর্থে মাছ চাষে এই পদ্ধতি কতটুকু লাভজনক তা তলিয়ে দেখা।  আমি বিশ্বাস করি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যারা সত্যিকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তারা শুধু নিজের আর্থিক সাফল্য নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নয়নে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

► লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর