শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস

সেবায় পার্থক্য আনতে পারেন নার্সরাই

অধ্যাপক ডা. অরূপরতন চৌধুরী

আজ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। ১৯৯১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হবে। ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালনের আরও একটি কারণ হলো, এ দিনে ফ্রেডরিক ব্যান্টিং জন্মগ্রহণ করেন। যিনি তার সহযোগী চার্লস বেল্টকে সঙ্গে নিয়ে অধ্যাপক ম্যাকয়িডের গবেষণাগারে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মহৌষধ ইনসুলিন আবিষ্কার করেন।

এ বছরের সেøাগান হচ্ছে-‘ডায়াবেটিস-সেবায় পার্থক্য আনতে পারেন নার্সরাই।’ স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনতে ডায়াবেটিস রোগীদের উপযুক্ত স্বাস্থ্যশিক্ষা দেওয়া ছাড়াও সার্বিকভাবে ডায়াবেটিস-সেবা উন্নততর করতে নার্সরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এ জন্য দরকার নার্সদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। চিকিৎসকদের পাশাপাশি নার্সরাও যাতে ডায়াবেটিস-সেবায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেন সে জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার এখনই সময়। এ প্রতিপাদ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এবার পরিবারের সদস্যদের ডায়াবেটিস থেকে বাঁচাতে এ বিষয়ে নার্সদের ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। নিজে নিজে রোগীদের তারা যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশলগুলো শিখিয়ে দিতে পারেন তবে ডায়াবেটিস সেবায় বিশাল বদল আসতে পারে। এর জন্য অবশ্য নার্সদেরও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নার্সদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের এক হিসাব থেকে জানা যায়, সারা বিশ্বে প্রয়োজনের তুলনায় নার্সদের স্বল্পতা প্রায় ৫৯ লাখ। এর মধ্যে নিম্ন ও মধ্যআয়ের দেশগুলোতেই এই স্বল্পতার হার প্রায় ৮৯ শতাংশ। বিশেষ করে বাংলাদেশে দক্ষ নার্সের অভাব খুবই প্রকট। এ কারণে দক্ষ নার্স সৃষ্টির উদ্যোগও আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। পৃথিবীতে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিস রোগীর মৃত্যু হয়।

ডায়াবেটিস বর্তমানে একটি মহামারী হিসেবে চিহ্নিত এবং এই রোগ সারা জীবনের রোগ। নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা অনেক। ডায়াবেটিসের এতসব জটিলতার কথা চিন্তা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও একটি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ দিবসটি পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ডায়াবেটিস রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ডায়াবেটিক ফেডারেশনের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ১৯৮৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি, আর এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩৭ কোটিতে। সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগী বাড়ছে। ডায়াবেটিস আজ পৃথিবীব্যাপী মহামারী। উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৃদ্ধির হার বেশি। ২০০৩ সালে সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগী ছিল ১৯ কোটি। আগামী ২০৩০ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার ১-২৮ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার মহিলাদের মধ্যে এ হার ২৫ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার ৬-১৪ শতাংশ। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশের পরবর্তী গর্ভধারণের সময়ে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা দেয়।

উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ডায়াবেটিসকে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। সুতরাং প্রতিদিন যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীদের নানা ধরনের জটিলতা। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বর্তমানে বিশ্বে ডায়াবেটিসকে মহামারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন, তা হচ্ছে-দৈনন্দিন জীবনে আমাদের শারীরিক সক্রিয়তা কম এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ না করা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বংশগত কারণ ছাড়াও নগরায়ণ ও পরিবর্তিত জীবনধারণের কারণেই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের প্রায় অর্ধেক পরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। পৃথিবীতে প্রতিদিন প্রায় ৮৩০ জন মহিলা গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিরোধযোগ্য জটিলতায় মারা যান। এদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মায়ের মৃত্যু ঘটে বংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা দিতে বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এরই মধ্যে সারা দেশে ‘গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা-কেন্দ্র’ খোলা হয়েছে যেখানে নির্ধারিত সময়ে বিনামূল্যে গর্ভধারণ-পূর্ব পরামর্শ এবং স্বল্প মূল্যে গর্ভধারণ সংক্রান্ত সেবা পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রসবকালীন নারী ও শিশুমৃত্যুর হার যেমন কমানো সম্ভব হবে, তেমনি নারীসহ আগামী প্রজন্মকেও ডায়াবেটিসের ভয়াবহ প্রকোপ থেকে অনেকাংশে রক্ষা করা সম্ভব হবে। যাদের বাবা-মা অথবা রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের বয়স ৪৫ বছরের বেশি তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাজেই ডায়াবেটিস সমন্ধে তাদের অধিকতর সতর্ক থাকা দরকার। আপনার বয়স যদি ৪০-এর বেশি, ওজন যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় কিংবা বংশে যদি কারও ডায়াবেটিস থাকে তবে অবশ্যই বছরে একবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাবেন এবং সেই সঙ্গে গর্ভবতীরা নিশ্চিত করবেন তাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে কিনা। ৫০ শতাংশের বেশি টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধযোগ্য।  আজ থেকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করুন।

 

► লেখক : চিকিৎসক।

সর্বশেষ খবর