রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পদ্মা সেতু যেভাবে এখন দৃশ্যমান

ওয়াহিদা আক্তার

পদ্মা সেতু যেভাবে এখন দৃশ্যমান

দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে উৎসরিত লেখা ‘সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। মায়ের টানের চেয়ে দেশের টান কোনো অংশে কম নয়; মায়ের চোখে সন্তান সব সময় সুন্দর আবার সন্তানের কাছে মায়ের মুখ পৃথিবীর সব থেকে আকর্ষণীয় মায়া-মমতায় ভরা। সন্তান ও মায়ের মধ্যে স্বর্গীয় ভালোবাসা, নাড়ির টান থেকে এ অনুভূতির জন্ম হয়। সর্বজনস্বীকৃত এ ভালোবাসাও প্রকাশের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মায়ের প্রশংসায় এবং উৎসাহে বড় হওয়া সন্তান আত্মবিশ্বাসী হয়। নিজেকে ভালোবাসে, ভালোবাসে আশপাশের মানুষকে। ঘরের স্বীকৃতিই তাকে বাইরের দুনিয়াতে স্বীকৃতি পেতে সহায়তা করে। বাইরের দুনিয়ার সফলতা তাকে বিনয়ী করে, অন্যকে মূল্যায়ন করতে শেখায়। মানুষের মনের গহিন কোণে সুপ্ত থাকে অন্যের মনে বেঁচে থাকার বাসনা। এ কারণে কেউ তাকে মূল্যায়ন করলে, প্রশংসা করলে, কাজে উৎসাহ দিলে সে কৃতজ্ঞ হয়। সুখে-দুঃখে সে প্রেরণাদায়ী মানুষটিকে খুঁজে পেতে চায়। ভালো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া, প্রশংসা করা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধকে জাগ্রত করে, সামাজিক সম্প্রীতি বাড়ায়। যে কথাটি একটি ব্যক্তিসত্তার জন্য প্রযোজ্য তা একটি রাষ্ট্রের জন্যও প্রযোজ্য। দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার আকাক্সক্ষা মানুষের জন্মগত। মানুষের বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমত থাকলেও রাষ্ট্রসত্তায় পরমতসহিষ্ণুতা থাকে। রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মানের সঙ্গে দেশের সম্মানও জড়িত থাকে। আমার দেশ সম্মানিত হলে আমিও দেশের নাগরিক হিসেবে ওই সম্মানের অংশীদার হব। আমি ব্যক্তিগতভাবে যত ধনী হই না কেন আমার দেশ দরিদ্র হলে সারা বিশ্ব আমাকে দরিদ্র দেশের একজন নাগরিক হিসেবে গণ্য করবে।

বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘ভিক্ষুক জাতির সম্মান থাকে না।’ এ সহজ কথাগুলো আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি। প্রতিটি দিন আমরা শুরু করতে পারি ইতিবাচক চিন্তা দিয়ে। একটি ভালো কাজের মধ্য দিয়ে বা মন ভালো করা কোনো সফলতার খবর দিয়ে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় প্রতি মুহূর্তের যে কোনো খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশের খবরের কাগজের শিরোনাম যে প্রকৃতির হবে বিশ্বে আমরা সে ভাবমূর্তিতেই পরিচিত হব। ভাবমূর্তি এক দিনে তৈরি করা যায় না। দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। এক সময় বন্যা, খরা ও দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল বাংলাদেশ। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় হাত পাততে হতো অন্য দেশের কাছে। নানা রকম অবমাননাকর শর্তসাপেক্ষে আমাদের উন্নয়ন সহায়তা নিতে হতো।

বাংলাদেশ আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। টেকসই উন্নয়নে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, ‘নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার সিদ্ধান্তই বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসন দিয়েছে।’ ২০১২ সাল থেকে আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত। একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে পদ্মা সেতু বিষয়ে অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতূহল ছিল এবং মিডিয়ার নিউজ থেকে কিছু জানার চেষ্টা করেছি। পরবর্তী সময়ে পদ্মা সেতুর সঙ্গে সম্পৃক্ত মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া স্যারের স্নেহধন্য হয়েছি। দীর্ঘ ১৫ দিন স্যারের সঙ্গে বিদেশ সফরে ছিলাম কিন্তু পদ্মা সেতু সম্পর্কে কোনো কথা কখনো জিজ্ঞাসা করিনি পাছে তাঁর মনে কোনো কষ্ট দিয়ে ফেলি। অবশেষে তাঁর লেখা বই হাতে পেয়ে আমার সব কৌতূহলের অবসান হয়েছে।

২০১৭ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করার সুবাদে তিনি প্রায়ই তাঁর পুরনো কাগজপত্র আমাকে দিতেন। এর মধ্যে পেয়ে যাই কানাডার আদালতে পদ্মা সেতু মামলার কোর্ট রেকর্ডিংস। অনেক বড় ডকুমেন্টস হলেও পড়ে দেখেছি। নির্মাণ শেষে পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। দেশের অর্থনীতির চাকার গতি বৃদ্ধি পাবে কিন্তু পদ্মা সেতুর দুঃখগাথা তখন সবাই ভুলে যাবে।

২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়। সরকার গঠনের ১৩ দিনের মাথায় পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২০১৩-এর ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হতে পারে মর্মে অনুমান করা হয়। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোটি মানুষের নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াতের স্বপ্ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মুক্তির সোপান হবে যাকে ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু’ বলা হয়। এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প হওয়ায় কোনো না কোনোভাবে দেশবাসীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে পদ্মা সেতু। সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পদক্ষেপ গৃহীত হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিন্ডিদ্র প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয় এবং সেই সঙ্গে সুশাসন ও দায়বদ্ধতা সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা করা হয়। একজন সিনিয়র পর্যবেক্ষণ এনটিটি প্রতিষ্ঠা করে প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ পান দক্ষিণাঞ্চলের কৃতী সন্তান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। তিনি বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসহ বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে সুশাসন বিষয়টি সরাসরি তদারকির দায়িত্ব পান। সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া নিযুক্ত হন। দক্ষ, অভিজ্ঞ ও প্রশ্নাতীত, সততা ও সুনামের অধিকারী এ দুজন ব্যক্তি। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সফল ব্যবসায়ী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুগত ও আস্থাভাজন একজন ব্যক্তি। কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। তারা অত্যন্ত স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করেন। দেশে-বিদেশে সুনামের অধিকারী এসব ব্যক্তিত্বের ওপর প্রভাব খাটানো কোনো দেশের ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁরা দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেন। বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক নিজস্ব পছন্দের বিষয়ে সুপারিশ করে যা কারিগরি কমিটি দেশের স্বার্থে আমলে নেয়নি। জানা যায়, এ বিশেষ কমিটির মূল্যায়নের ওপর বিশ্বব্যাংকের সম্মতি চাইলে তারা অযথা কালক্ষেপণ করে পুনঃটেন্ডারের পরামর্শ দিয়ে ফেরত পাঠায়। ২০১৩ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি থাকায় সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সতর্কতা ও অনেক দ্রুততার সঙ্গে কাজ করে। এতে বিশ্বব্যাংক অবিশ্বাস ও সংশয়ের দোলাচলে পড়ে।

পদ্মা সেতু প্রকল্প বিশ্বের একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প। নদী শাসন ব্যবস্থা, উভয় প্রান্তে সংযোগ সড়ক, সেতু প্রান্তে সুবিধাদি, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন কম্পোনেন্টের প্রতিটিই ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। প্রমত্ত পদ্মা, সর্বনাশা পদ্মা আবার কীর্তিনাশাও বটে! ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি একনেকে পদ্মা সেতুর সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন হয়। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হচ্ছে মর্মে কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী চক্র ‘পদ্মা ব্রিজ’ নামে বেনামি ই-মেইল থেকে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটির কিছু কর্মকর্তাকে গোপনে ই-মেইল পাঠায়। বিষয়টি সেতু বিভাগের সচিব অবহিত হয়ে উচ্চপর্যায়ে জানান। উচ্চপর্যায় থেকে বলা হয় এত বড় প্রকল্পে এসব বেনামি চিঠি পাঠালেও বিশ্বব্যাংক আমলে নেবে না।

এত বড় প্রকল্প! স্বার্থান্বেষী চক্রের স্বার্থের সংঘাতে অপতৎপরতা থাকা অস্বাভাবিক ছিল না। তবে মানহীন, অনুমাননির্ভর, কানকথায় পরিপূর্ণ ই-মেইল বিশ্বব্যাংকের মতো একটি সংস্থা আমলে নিয়েছে যা সত্যিই অস্বাভাবিক! শুধু বেনামি চিঠি আমলে নিয়ে ক্ষান্ত হয়নি তারা। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বে বাংলাদেশকে হেয় করার অপচেষ্টা করেছে। সিভিল সার্ভিসে অত্যন্ত সুনামের অধিকারী কর্মকর্তাদের নজিরবিহীন চূড়ান্ত হয়রানি করেছে। এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ বাবুর ব্যক্তিগত নোটবুকে কমিশন প্রদান সংক্রান্ত টুকে রাখা তথ্য ছিল ভিত্তিহীন। কানাডার আদালতের কাছে সাক্ষ্য হিসেবে যা পরবর্তীতে অগ্রহণযোগ্য হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে এদেশের কিছু কুসন্তান বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি কর্মকর্তাদের অবহিত করেছে। বিশ্বব্যাংক হুইসেল ব্লোয়ারস হিসেবে তাদের সম্পর্কে না জেনে এবং সত্যতা যাচাই না করে এ প্রকল্পে দুর্নীতির অপবাদ দিয়েছে। মূলত দেশের স্বার্থে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের টিম কারিগরি মূল্যায়নে কঠোর ভূমিকা পালন করায় স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপ আশাহত হয়ে এসব বেনামি চিঠি পাঠায়। বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতির বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করলে তিনি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, ‘আমাকে প্রমাণ দিতে হবে। মূলত ওই দিন তিনি বিশ্বব্যাংকের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। বিশ্বব্যাংক যোগাযোগমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ও সেতু কর্তৃপক্ষের সচিবের দিকে দুর্নীতির অঙ্গুলি নির্দেশ করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন যে তারা তিনজনই তার অত্যন্ত আস্থাভাজন এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি।

দেশের কিছু প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার কারণে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তারা সামাজিকভাবে, মানসিকভাবে ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের একটাই ভরসার জায়গা ছিল যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবকিছু বুঝতে পারছেন এবং তিনি তাদের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখেছেন। বিশ্বব্যাংকের নিয়োজিত তিন সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ প্যানেল দেশে এসে দুদকে চাপ সৃষ্টি করে মামলা করার জন্য। সেতু বিভাগের সচিব তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করতে যান। তিনি তদন্তে সহযোগিতা করতে চান। ফেরার সময় দুদক কার্যালয়ে অবস্থানরত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন এবং বিব্রতকর প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন। অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। বাসার সামনে সারা দিন সাংবাদিকদের অবস্থানের কারণে তিনি বিব্রত হয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে না। নানা অজুহাতে তারা কালক্ষেপণ করছে। আপনাদের এমন আচরণে আমার মানসিক চাপ বাড়ছে। আমি তো হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতে পারি।

বিশ্বব্যাংকের নিয়োজিত তিন সদস্যবিশিষ্ট প্যানেল বাংলাদেশ ভিজিটে এসে চাপ সৃষ্টি করে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি কর্তৃক অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে দুদক কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করে। এতে সরকারের একজন সৎ, দক্ষ, নিষ্ঠাবান ও যোগ্য কর্মকর্তাকে নজিরবিহীনভাবে গ্রেফতার করে হয়রানির সম্মুখীন করা হয় যা সেই সময় দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। এত সব ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অবিচল আস্থা ছিল তাঁর নিয়োগকৃত টিমের সদস্যদের ওপর। শোনা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে তন্ন তন্ন করে খোঁজ নেওয়া হয় এবং তাদের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রাখা হয়।

দুর্নীতি প্রমাণে বিশ্বব্যাংক মরিয়া হয়ে শক্তি প্রয়োগ করে। তাদের আমাদের দেশের কিছু প্রিন্ট মিডিয়া কিন্তু সুশীল ব্যক্তিত্ব উৎসাহিত করে মর্মে জানা যায়। সত্যি কথা বলতে কী একশ্রেণির মিডিয়ার অপপ্রচারে দেশবাসী বিভ্রান্ত হয়েছে। ‘পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি’ সরকারের এই দৃঢ় অবস্থানের কারণে বিশ্বব্যাংক বিচলিত হয়ে তাদের দেওয়া অভিযোগের সত্যতা প্রমাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করে এবং ঋণ চুক্তি বাতিল করে। কানাডার আদালতে মামলা করে। বিশ্বব্যাংকের উপরোক্ত অসদুদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সরকার বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে নিজ উদ্যোগে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করার ঘোষণা দেয়। এতে সাধারণ দেশবাসীর ব্যাপক সাড়া মেলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উৎসাহ দিয়ে দেশবাসী চিঠি, ই-মেইল ও টাকা পাঠাতে শুরু করে। অতঃপর ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে নিজ অর্থে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি কানাডার আদালতে পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে বিচারক জানান, চারজন হুইসেল ব্লোয়ারস অসংখ্য ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠানো তথ্যে অভিযোগের ভিত্তি রচিত হয়। বাংলাদেশের পত্রিকার কিছু কাটিং সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপিত হয়। রমেশ বাবুর কথিত নোট প্যাড, আড়িপাতা টেলিফোন রেকর্ড আদালত আমলে নেয়নি। পত্রিকার কাটিং সাক্ষ্য প্রমাণে যথেষ্ট নয়। বিচারক বলেন, শোনা কথা ও গুজবের ওপর এ মামলা রুজু হয়েছে। এর কোনো ভিত্তি নেই। সবগুলো তথ্যই সবার জানা। শোনা কথা ও গুজব যা দুর্নীতি প্রমাণে প্রাসঙ্গিক নয়। এ বিবেচনায় টরেন্টোর সুপিরিয়র কোর্ট পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলা খারিজ করে দেয়। বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়। মিথ্যার দাপট ভীতিকর কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। সত্যের গৌরব ও সততার জয় ধীরে আসে কিন্তু তা হয় চিরস্থায়ী। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের যে সব দায়িত্বশীল ব্যক্তি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ গুজবে কান দিয়েছিল তাদের উচিত ছিল নিজেদের দোষ স্বীকার করা। সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, আপনারা চিন্তা করেন যাদের দুর্নীতিবাজ বলেছিল কোর্টে নির্দোষ প্রমাণের আগে তাদের জীবনের দিনগুলো কীভাবে কেটেছে। অনেকে আত্মহত্যার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এ জীবন মানুষের জন্য কত দুর্বিষহ; যারা ভদ্রলোক, যাদের মানসম্মানের জ্ঞান আছে তারাই উপলব্ধি করতে পারে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি বিভাগকে ‘রাবিস’ এবং ‘অপদার্থ’ বলেন এবং বিশ্বব্যাংক স্বীকার করে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করার সিদ্ধান্তটি ছিল ভুল।

পদ্মা সেতু নির্মাণ দুই বছর পিছিয়েছে। ব্যয় বেড়েছে অনেক। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে মনে করে অনেক অবমাননা মেনে নেওয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক নজিরবিহীন পদ্ধতিতে স্বাক্ষরিত ঋণ চুক্তি বাতিল করেছিল যা আজও রহস্যময়! যা হয়েছে ভালো হয়েছে। বিশ্ববাসী জেনেছে বাংলাদেশের সক্ষমতা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ও জীবনমানের বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

এখন পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। দেশবাসী অপেক্ষা করছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য।

(সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া রচিত ‘পদ্মা সেতু : সততা ও আত্মবিশ্বাসের বিজয়’ গ্রন্থ পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখিত।)

               লেখক : প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-২ (অতিরিক্ত সচিব)।

সর্বশেষ খবর