বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

একজন সমেস ডাক্তার

হানিফ সংকেত

একজন সমেস ডাক্তার

কথায় আছে- ‘মনের সাথে মিললে মন-তেঁতুল পাতায় দশজন’। তেঁতুল পাতা না হলেও মনের মিল থাকলে একই ছাদের নিচে অনেকেই একসঙ্গে থাকতে পারেন। তার প্রমাণ ‘সরেরহাট কল্যাণী শিশুসদন’। যেখানে এক ছাদের নিচে একই পরিবারের মতো মিলেমিশে থাকেন ২৩৫ জন মানুষ। এ শিশুসদনটি সম্পর্কে ‘ইত্যাদি’র গত পর্বে আমরা একটি সচিত্র প্রতিবেদন দেখিয়েছিলাম। যেটি ধারণ করা হয়েছিল রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে, প্রচারিত হয়েছিল ২৯ অক্টোবর। প্রতিবেদনটি দেখে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। অনেকেই বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে তাদের এ মহৎ কাজ। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর প্রশংসায় ধন্য হয়েছেন এ শিশুসদনের প্রতিষ্ঠাতা ডা. সামসুদ্দিন সরকার ও তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা। আমরা প্রতিবারই ইত্যাদি অনুষ্ঠানটি ধারণ করার আগে স্থান নির্বাচন করি। তারপর সে স্থানটিকে ঘিরেই অনুষ্ঠানটি সাজাই, নির্বাচন করতে চেষ্টা করি আমাদের প্রধান প্রতিবেদনগুলো।

আমরা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্থান, আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ইত্যাদি ধারণ করি। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা এবারের পর্ব ধারণ করেছিলাম পদ্মাপলি-বিধৌত বরেন্দ্রভূমি ও ইতিহাসখ্যাত পরিচ্ছন্ন নগরী রাজশাহী জেলায়। আর আমাদের ধারণস্থান ছিল এ জেলারই সারদায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি। একসময় এ স্থানটি ছিল মুঘল সম্রাটের সেনানিবাস। প্রাচীন নিদর্শনসমৃদ্ধ অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির অভ্যন্তরে ছোটকুঠির সামনে ধারণ করা হয়েছিল ইত্যাদির এ পর্বটি। উল্লেখ্য, গ্রিক-রোমান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ২৫০ বছরের প্রাচীন নিদর্শন এ ছোটকুঠি। একসময় এ ছোটকুঠি বিভিন্ন ব্রিটিশ লর্ড, গভর্নর এবং বিভিন্ন সময়ের শাসকের খন্ডকালীন অস্থায়ী নিবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দায়িত্বের মাহাত্ম্যকে মহিমান্বিত করতে সেবার প্রথম পাঠ পুলিশ এ একাডেমিতেই শেখে। সাধারণত যেসব স্থানে ইত্যাদি ধারণ করা হয় সেসব স্থানে ইত্যাদি দেখার জন্য উপচে পড়া দর্শকের কারণে আমন্ত্রিত দর্শক ছাড়াও এর আশপাশে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে এবং কোথাও কোথাও দর্শকসংখ্যা লক্ষাধিক হয়। তবে এবারের চিত্র ছিল ভিন্ন। বর্তমানে বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনার কারণে দূরত্বকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিতসংখ্যক দর্শক নিয়ে ধারণ করা হয় এবারের ইত্যাদি। অত্যাবশ্যকীয়ভাবে নিশ্চিত করা হয় সব দর্শকের মাস্ক ব্যবহার। আর এখানে ইত্যাদি ধারণের আর একটি বিশেষ কারণ হলো পুলিশ একাডেমি কর্তৃপক্ষের আন্তরিক সহযোগিতা।

আমরা যখন যেখানে যাই সে স্থান থেকে প্রচারবিমুখ, জনকল্যাণে নিয়োজিত মানুষদের খুঁজে এনে যেমন তুলে ধরার চেষ্টা করি তেমনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের অচেনা-অজানা অনেক বিষয়ও প্রচার করি। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা রাজশাহী গিয়েও খুঁজে বেড়িয়েছি মানবিক ও সেবামূলক কার্যক্রম কিংবা জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ডে নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। ডা. সামসুদ্দিন সরকার আমাদের সে চেষ্টারই ফসল।

ডা. সামসুদ্দিনের প্রতিষ্ঠিত ব্যতিক্রমী এ শিশুসদনটি রাজশাহী থেকে ৫০ কিলোমিটার পূর্বে পদ্মার তীরে বাঘা উপজেলার গড়গড়ি ইউনিয়নের সরেরহাট গ্রামে অবস্থিত। শিশুসদন নাম হলেও বর্তমানে এখানে ১৮২ জন অনাথ এতিম শিশুসহ ৪৫ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও থাকেন। তাই এক অর্থে এটি একটি বৃদ্ধাশ্রমও। প্রথমে এটি শুধু শিশুসদনই ছিল, পরে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে একজন দানশীল ব্যক্তি ফখরুল কবির রিপনের সহযোগিতায় ৪৫ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারও দায়িত্ব নেন তিনি। অন্যান্য এতিমখানার সঙ্গে এ প্রতিষ্ঠানটির পার্থক্য হলো- এখানে এসব শিশু ও আশ্রয়হীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সঙ্গে সপরিবার থাকেন এর প্রতিষ্ঠাতা। শুধু একসঙ্গে থাকেনই না, খান একই সঙ্গে এক পাকে রান্না করা খাবার। নিজের স্ত্রী-সন্তানসহ ২৩৫ জন সদস্যের এ বিশাল পরিবারকে যিনি এক ছাদের নিচে রেখে লালনপালনের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনিই ডা. সামসুদ্দিন সরকার। স্থানীয়দের কাছে যিনি সমেস ডাক্তার হিসেবে বেশি পরিচিত।

১৯৭১ সালে রণাঙ্গন থেকে ফিরে যুদ্ধে নিহত সতীর্থ যোদ্ধা বন্ধুদের এতিম শিশু সন্তানদের অনাদরে-অবহেলায় ঘুরে বেড়াতে দেখে তাঁর মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এ শিশুদের নেই কোনো আশ্রয়। স্নেহ-আদর বঞ্চিত হয়ে দিনের পর দিন অনাহারে অবহেলায় বড় হচ্ছে ওরা। কীভাবে ওদের জীবন চলবে, কে ওদের লালনপালন করবে, কে খেতে দেবে দুই বেলা দুই মুঠো খাবার? এসব চিন্তায় সামসুদ্দিনের মনটা ছটফট করতে থাকে। তখন থেকেই অনাথ এ শিশুদের জন্য কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। আর তাঁর এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে ১৯৮৪ সালে, স্বাধীনতার ১৩ বছর পরে। ১৯৮৪ সালে তিনি স্ত্রী মেহেরুন্নেসাকে বুঝিয়ে দেওয়া মোহরানার টাকা দিয়ে বাঘা উপজেলার সরেরহাট গ্রামে ১২ শতাংশ জমি কিনে ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন এ এতিমখানা। এটিই ছিল এ এতিমখানার প্রথম স্থাপনা। সে সময় এখানে ৫৬টি শিশু আশ্রয় পায়।

জগতে মানুষ এতিম হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। প্রতিটি শিশুরই পিতা-মাতা থাকে। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অল্প বয়সেই এ শিশুরা তাদের মা-বাবা অথবা উভয়কেই হারিয়েছে। এ হারানোর পেছনে তাদের কোনো হাত না থাকলেও তারাই হয়েছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের সমাজে এসব শিশুকে আশ্রয় দেওয়ার মানুষের সংখ্যা খুবই কম। অথচ নিজের অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও এ এতিমদের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন মহৎ মনের মহান মানুষ সমেস ডাক্তার। পল্লী চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে একসময় তিনি গ্রাম্য ডাক্তারি পেশা শুরু করেন এবং সেখান থেকে যে আয় হতো তা খরচ করতেন এই শিশুদের জন্য। কিন্তু ডাক্তারির স্বল্প আয়ে দীর্ঘদিন এতগুলো মানুষের ভরণপোষণ চালানো ছিল তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তাই এ শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিতে একসময় তিনি এবং তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টি চাল সংগ্রহ শুরু করেন। ’৮৪ সাল থেকে শুরু করে টানা ১০ বছর এ বৃহৎ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে একসময় তাকে বিক্রি করে দিতে হয় নিজের গৃহস্থালির ১৭ বিঘা জমিসহ শেষ সম্বল মাথা গোঁজার ঠাঁই বসতভিটাও। আশ্রয়হীন শিশুদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজেরাই হয়ে পড়েন আশ্রয়হীন। আর এ কঠিন সময়ে তাঁকে সাহস জুগিয়েছেন স্ত্রী মেহেরুন্নেসা। বসতভিটা হারিয়ে অবশেষে ২০০১ সালের ২২ মে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি উঠে আসেন অসহায় শিশুদের জন্য গড়ে তোলা এতিমখানায়। সমেস ডাক্তার অনেক দুঃখ করে বলেন, ‘আমি সারা দিন ডাক্তারি করে যে পয়সা পাই সেটাও এতিম ছেলেদের পেছনে ব্যয় করি। আমার স্ত্রী তার নিজ নামে ১৭-১৮ বিঘা সম্পত্তি সব বিক্রি করে এতিমদের পেছনে ব্যয় করেন। শেষে আমরা অনেক টাকা ঋণী হয়ে পড়ি। আমার বাবা-মায়ের ভিটেমাটি যেখানে যা ছিল সেগুলোও বিক্রি করি। পরে আমরা গত ২০ বছর ধরে এতিমখানায় বসবাস করছি।’ এর পরও থেমে থাকেনি জীবনযুদ্ধ। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে এতিমখানার আয়তন ও অবকাঠামো বৃদ্ধি করেছেন সমেস ডাক্তার।

এ এতিমখানায় যারা বসবাস করে এরা সবাই এতিম। এদের কারও বাবা নেই, কারও মা নেই, কেউবা অকালেই হারিয়েছে দুজনকেই। আর এখানে যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আছেন তাদেরও পরিবারের কোনো খোঁজ নেই। তাদের মধ্যে কেউ পরিত্যক্ত, কেউবা দুর্ভাগ্যক্রমে পরিবারবিচ্ছিন্ন মানুষ। একেকজনের জীবনের গল্প একেক রকম। এ এতিমখানাই তাদের আসল ঠিকানা। আর এসব মানুষের জন্যই অনেক ত্যাগের বিনিময়ে সমেস ডাক্তার গড়ে তুলেছেন এ শিশুসদন। আমরা যখন এ এতিমখানায় পৌঁছি তখন বেলা ১১টা। ভিতরে ঢুকেই বাড়ির পরিবেশ দেখে মনটা ভরে ওঠে। বাড়ির বারান্দায় বসে বৃদ্ধরা কেউ লুডু খেলছেন, কেউ গল্প করছেন, কেউবা সূর্যের আলোয় নিজেকে ভিজিয়ে নিচ্ছেন, কেউবা স্মৃতির পাতায় খুঁজে বেড়াচ্ছেন হারিয়ে যাওয়া অতীত। শিশুদের মধ্যে কয়েকজন দলবেঁধে গোল্লাছুট খেলছে। কেউ গোল হয়ে বসে গল্প করছে। কেউবা সমেস ডাক্তারকে ঘিরে খেলছে। কারও মধ্যেই কোনো ক্লান্তি নেই, আছে অনাবিল আনন্দ। সমেস ডাক্তার একরাশ প্রশান্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন এ নাতি-নাতনিদের দিকে। ২৩৫ সদস্যের এ বাড়িটি সব সময় শিশু-কিশোর-বৃদ্ধদের কোলাহলে মুখরিত থাকে। শত কোলাহলেও সমেস ডাক্তার বা তাঁর স্ত্রী বিরক্ত হন না। সব সময় মুখে হাসি লেগেই থাকে। কেউ বাইরে কাজ করলে ছুটি নিয়ে বেড়াতে আসে এখানে। কারণ এটাই তাদের বাড়ি, স্থায়ী ঠিকানা। সমেস ডাক্তার আর মেহেরুন্নেসাই যেন তাদের আসল বাবা-মা। এ শিশু সদনে দুই/এক বছরের এতিম শিশুও রয়েছে। সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়ায় ওরা। ওরা জানে না কে ওর বাবা, কে মা। এখানে কেউ ওর নানা, কেউ নানি, কেউবা দাদা, কেউ দাদি।

প্রতিদিন তিন বেলা রান্না চলে এখানে। যেন একটি ব্যস্ত হোটেল, সব সময়ই চলে রান্নার মহাযজ্ঞ। বাড়ির উঠোনের পাশেই উন্মুক্ত রান্নাঘর। বাড়ির বৃদ্ধারা সবাই মেহেরুন্নেসাকে রান্নায় সহায়তা করছেন। সাত-আট জন বসে কুমড়া শাক কাটছেন, কেউবা পিঁয়াজ-রসুনের খোসা ছাড়াচ্ছেন। এদের মধ্যে আবার বেতনভুক কয়েকজন পরিচারিকাও রয়েছেন, যারা মেহেরুন্নেসাকে সহযোগিতা করেন। মেহেরুন্নেসার দিন শুরু হয় উনুন জ্বেলে। একসময় সব কাজ একাই করতেন। এখন বার্ধক্যের কারণে ইচ্ছা থাকলেও পারেন না। সবাই সহযোগিতা করেন তাঁকে। তবে মূল রান্নার কাজটি এখনো তিনিই করেন। এখানে সবকিছুই চলে যন্ত্রের মতো। ভোরের আলো ফোটার আগেই তৈরি করে ফেলতে হবে এতগুলো ছেলেমেয়ের সকালের খাবার। সকালের রান্না শেষ হতে না হতেই শুরু হয় দুপুরের খাবারের আয়োজন। এরপর বিকাল থেকেই রাতের খাবারের প্রস্তুতি। এভাবেই চলে আসছে বছরের পর বছর। তা ছাড়া সবকিছু তদারকি করতে করতেই সারা দিন ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় মেহেরুন্নেসাকে। রান্না শেষে সবাই একসঙ্গে বসে খান। বর্তমানে স্ত্রী, দুই পুত্র, পুত্রবধূ, তিন নাতনিকে নিয়ে এ এতিমখানায় থাকেন সমেস ডাক্তার।

প্রতি বেলা খাবারের সময় হলে এক অভিনব দৃশ্য দেখা যায় এখানে। দুটি বিশাল বড় বারান্দায় এবং উঠোনে সবাই একসঙ্গে বসে খাচ্ছেন। মেহেরুন্নেসা এবং তাঁর দুই সন্তানসহ আরও কিছু মানুষ মিলে সবাইকে থালায় খাবার তুলে দিচ্ছেন। একদিকে শিশুরা, একদিকে বৃদ্ধরা- তাদের সঙ্গে সমেস ডাক্তার। আবার অন্যদিকে বৃদ্ধারা আর তাদের পাশেই বসেছে সমেস ডাক্তারের পরিবারের সদস্যরা। নাতি-নাতনি, পুত্রবধূ, কন্যাসহ সবাই। জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁর কন্যা সাবিনা ইয়াসমিনকে, ‘সবার সঙ্গে একসঙ্গে খেতে কেমন লাগছে?’ হেসে বললেন, ‘খুবই ভালো লাগছে, আসলে ছোটবেলা থেকে এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, এখন বরং একসঙ্গে না খেলেই খারাপ লাগে।’ জিজ্ঞেস করেছিলাম ছোট পুত্রবধূ রুমানা আখতারকে, ‘এইপরিবেশ কেমন লাগে?’ বললেন, ‘আমার গর্ববোধ হয় যে আমি এ বাড়ির বউ হয়ে আসতে পেরেছি।’ পরিবারের প্রতিটি সদস্যেরই সেবার মানসিকতা। যা সহজে দেখা যায় না। সবাই যেন সমেস ডাক্তার এবং তাঁর স্ত্রীর আদর্শে অনুপ্রাণিত।

আজকাল অনেকেই নিজের পরিবারের সদস্যদের জন্যও রান্না করেন না, গৃহপরিচারিকা কিংবা বাবুর্চির ওপর নির্ভরশীল। সেখানে মেহেরুন্নেসা বছরের পর বছর এতগুলো মানুষের জন্য রান্না করে যাচ্ছেন। জানতে চেয়েছিলাম তাঁর কাছে, ‘এই বয়সে এত কাজ করতে কষ্ট হয় না?’ মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, ‘না, কষ্ট হয় না। বরং নিজের হাতে রান্না করে আমার সন্তানদের মতো ওদের মুখেও যখন খাবার তুলে দিতে পারি তখন অনেক আনন্দ হয়। কারণ আমার নিজের ব্যাটাবেটিই শুধু আমার নয়, ওরাও আমার নিজের ব্যাটাবেটির মতো’। ধরা গলায় বললেন, ‘আমি চার বছর এই এতিমখানা নিয়ে খুব কষ্ট করেছি বাবা। মধ্যে এক বছর আমি মানুষের কাছে ভিক্ষেও করেছি। মানুষ যাতে কিছু জানতে না পারে সেজন্য আমি অন্য গ্রামে গিয়ে ভিক্ষে করতাম।’ বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে মেহেরুন্নেসার। আসলে মানবতার সেবায় যাদের মন কাঁদে তারাই তো প্রকৃত মানুষ। মেহেরুন্নেসা আর সমেস ডাক্তার তেমনি দুজন মানুষ। যতই তাঁদের দেখেছি অবাক হয়েছি।

শিশুসদনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার শিশু এসেছে এখানে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদান্যতায় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দিয়ে পাস করে বেরও হয়ে গেছে।

সমেস ডাক্তারের এ শিশুসদনের মধ্যে লুকিয়ে আছে তাঁর অনেক শ্রম ও কীর্তিগাথা। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে কে এ প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরবে? জিজ্ঞেস করেছিলাম সমেস ডাক্তারকে। বললেন তাঁর সন্তানরাই এর হাল ধরবে।

বর্তমানে সরকারিভাবে ৫০ জন শিশুর জন্য প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে পান, আর বাকিটা নির্ভর করতে হয় বিভিন্নজনের দানের ওপর। তবু এখানে কারও কোনো কষ্ট নেই, আছে একসঙ্গে এক পরিবারে বসবাসের অবিরাম আনন্দ। সমেস ডাক্তার আর মেহেরুন্নেসা দম্পতির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সেবার ব্রত নিয়ে আরও অনেকেই এগিয়ে আসবেন- এ প্রত্যাশা থাকল।

লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর