শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ট্রাম্প কি একনায়ক হওয়ার জন্য মরিয়া

তুষার কণা খোন্দকার

ট্রাম্প কি একনায়ক হওয়ার জন্য মরিয়া

২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর আমেরিকায় নির্বাচনে ভোট গণনা শেষে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেন জিতে গেছেন। আমেরিকার নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে ফোন করে অভিনন্দিত করবেন। আমেরিকার জনগণের সিদ্ধান্তের প্রতি, আমেরিকার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানানোর এটিই রীতি।  কিন্তু আমেরিকার কপালে এবার এসব কিছুই জুটছে না, কারণ পরাজিত প্রার্থী আর কেউ নন, স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নন বরং তিনি তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রবিহীন কোনো দেশের রাষ্ট্রপধান, যেখানে নির্বাচনের নামে হামেশা প্রহসন হয়ে থাকে। গণতন্ত্রবিহীন দেশগুলোর রাজনীতিবিদদের ভাষায় তিনি ক্রমাগত দাবি করে আসছেন, আমার ভোট চুরি হয়ে গেছে। জালিয়াতি করে আমার বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে পরাজিত ট্রাম্পের সঙ্গে কিছু সুযোগসন্ধানী জুটে গেছে, যারা ট্রাম্পের চেয়েও বেজায় জোরে আমেরিকায় ভোট চুরির ফাটা ঢাক বাজিয়ে চলেছেন। ট্রাম্পের চাটুকাররা বলছেন, ‘আমাদের নেতা ভোটে হেরেছেন তো কী হয়েছে, আগামী জানুয়ারিতে উনিই ফেরবার প্রেসিডেন্ট হবেন।’ ভাব দেখে মনে হচ্ছে, আমেরিকার গণতন্ত্রের মরণঘণ্টা বোধ হয় বেজে গেছে। দুনিয়া জানে, আমেরিকার নির্বাচনের আগের দিন তুমুল তর্কাতর্কি চলবে কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর জনগণের রায় যেদিকে যাবে দেশটির জনগণ তাকেই সসম্মানে মেনে নেবে। পুরো পৃথিবী এবার আমেরিকার নির্বাচনী ফলাফল দেখার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করেছে। আমেরিকার নির্বাচনের সঙ্গে কারও কোনো ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত ছিল না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের খেলো আচার-আচরণের কারণে তার প্রতি বিশ্ববাসীর এক ধরনের অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। আমেরিকার মতো শক্তিধর দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের স্বভাব ও আচরণে যতটা ভারভারিক্কি আমরা আশা করি তা ট্রাম্পের স্বভাব-চরিত্রে অনুপস্থিত ছিল। ফলে আমরা সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ ভেবেছি চটুল স্বভাবের ট্রাম্প রাগ কিংবা আবেগের বশে কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসবে না তো। বাগাড়ম্বরবশে ভয়ানক কোনো যুদ্ধের সূচনা করলে আমরা যাব কোথায়। আজকের দুনিয়ায় অনেক দেশের হাতেই পারমাণবিক অস্ত্র। ট্রাম্প সারা দুনিয়ায় লাগামহীন বাণিজ্যিক যুদ্ধ শুরু করেছেন। তার পরিণামে দুনিয়ার ওপর মারণাস্ত্রের ঝনঝনানি যে শুরু হবে না সে কথা কে কতটা নিশ্চিত করে বলতে পারে।

২০১৬ সালে নির্বাচনে জিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন তখন বাংলাদেশ প্রতিদিনের এ কলামে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ট্রাম্প কি হিটলারের আমেরিকান সংস্করণ? ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারে কিংবা তার আগে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থিতার প্রতিযোগিতায় তিনি যেসব বাণী-বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল তিনি মানুষটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ধারেকাছেও নন। রাজনৈতিক আঙিনা থেকে দূরে বসবাসকারী ব্যবসায়ী ট্রাম্প রাজনীতির আঙিনায় ঢুকে বেতালা কিছু করে ফেলবেন সেটি স্বাভাবিক। আবার এও আমি বলেছিলাম, ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউসে অধিষ্ঠান নিয়ে বসলেও আমি অবাক হব না। দুনিয়াজুড়ে গত দুই দশকের অস্থিরতা মাথায় রেখে আমি ভেবেছিলাম আমেরিকার রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের সস্তা জনপ্রিয়তার চটুল স্লোগান হয়তো ট্রাম্পের ভাগ্য খুলে দেবে। ২০১৬ সালে আমার আশঙ্কা সত্য পরিণত করে ভোটে জিতে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের দখল নেন। নির্বাচনী প্রচার-প্রপাগান্ডা নিয়ে আমেরিকায় আগেও অনেক নাটক হয়েছে কিন্তু  নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি নিয়ে আমেরিকার রাজনীতি এবারের মতো এমন কঠিন গাড্ডায় আর পড়েনি। আমেরিকায় মোট ইলেকটোরাল কলেজ ৫৩৮টি। এর অর্ধেক ২৬৯। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজ যে প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষে যায় সে-ই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। সাধারণত নির্বাচনের রাতে আমেরিকার নির্বাচনের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যায়। করোনার কারণে এবারের নির্বাচনের পরিস্থিতি ছিল একটু ভিন্ন। ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ভোটারদের আগাম ভোট দিতে উৎসাহিত করেছেন। আগাম ভোটের বিশাল অংশ এবার ডাকযোগে এসেছে। করোনা সংক্রমণের ভয়ে অনেক ভোটার এ বছর কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে ভয় পেয়েছেন। সে কারণে ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব ঘটেছে। এটি একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। আমেরিকার জনগণ এমন বাস্তবতা মানতে দ্বিধান্বিত ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু পরাজিত প্রার্থী ট্রাম্প ৭ কোটি ভোট পেয়ে হেরেছেন বলে তিনি ভোটের চূড়ান্ত ফলাফলকে অগ্রাহ্য করার প্ররোচনা দিচ্ছেন। ও দেশটির রাজনীতিতে এটি সত্যিই বিস্ময়কর।

নির্বাচনের দৌড়ে ট্রাম্প প্রায় ৭ কোটি ভোট পেয়ে ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হয়েছেন। নির্বাচনী জনসভায় ট্রাম্প লাগামহীন যেসব কথা বলেছেন সেসব নিয়ে লোকে এত দিন হাসাহাসি করেছে। কিন্তু নির্বাচনে পরাজিত হয়ে কোনো প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউস জবরদখল করে বসে থাকার আবদার করতে পারেন এমন আজগুবি কথা বোধ হয় ট্রাম্পের গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি অর্থাৎ রিপাবলিকান শিবির কখনো কল্পনাও করেনি। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলীয় যারা নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা বলছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প ফাটা ঢোলের মতো ক্রমাগত বলছেন, ‘আমার বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি কোর্টে যাব।’ কোর্টে যাব বলে তিনি বসে থাকেননি। ইতিমধ্যে কয়েকটি কোর্টে গেছেন এবং প্রতিটি কোর্ট বলেছে, ট্রাম্পের মামলার পক্ষে কোনো উপযুক্ত প্রমাণ নেই। কোর্টের কথায় ট্রাম্প শান্ত হওয়ার বান্দা নন। আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সমর্থনে একদল উচ্ছৃঙ্খল মানুষ মিছিল করে বলেছে, ‘আমরা ট্রাম্পকে ভালোবাসি’। কোনো দল নয়, দলীয় নীতি-আদর্শ নয়, শুধু একজন মানুষ ট্রাম্পকে তারা ভালোবাসে বলে তাকে প্রেসিডেন্ট পদে বহাল রাখতে হবে- এ কেমন আবদার! ওয়াশিংটনে ট্রাম্প সমর্থকদের মিছিলে একজন মানুষ ছুরিকাহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। নির্বাচনোত্তর ওই মিছিল থেকে ২০ জন গ্রেফতার হয়েছেন। আমেরিকার জন্য বিষয়গুলো অস্বাভাবিক। দেশটির সুপ্রতিষ্ঠিত নির্বাচন পদ্ধতি ও নির্বাচন পরিচালনার প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে ট্রাম্প যে ভাষায় কথা বলছেন তা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।

রিপাবলিকানরা নির্বাচনোত্তর ডামাডোলে নিশ্চুপ বসে আছে- বিষয়টি সত্যি বিস্ময়কর। ট্রাম্প পেশাদার রাজনীতিক নন। বয়সে প্রবীণ হলেও রাজনীতিতে তিনি নতুন মুখ। ব্যবসায়ী ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার পরে অনেক পোড় খাওয়া রিপাবলিকান মুখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। জো বাইডেনের কাছে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে ট্রাম্প যে গোঁয়ার্তুমি করছেন তাতে রিপাবলিকান পার্টির নেতৃবৃন্দ আর চুপ থাকবেন না বলেই সবাই আশা করেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। আমার মনে হচ্ছে, ট্রাম্পের ঝুলিতে ৭ কোটি ভোট দেখে রিপাবলিকান দলের নেতারা ভাবছেন দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে কিছু বলতে গেলে রগচটা স্বভাবের ট্রাম্প বেঁকে বসবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। ৭ কোটি ভোটারের সমর্থন পুঁজি করে ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টি ভেঙে তাঁর নিজের খেয়ালমাফিক একটি রাজনৈতিক সংগঠন সৃষ্টি করে ফেলতে পারেন বলে কি রিপাবলিকান নেতারা আতঙ্কে আছেন? সে জন্য কি ট্রাম্পের মনে আঘাত লাগে এমন কথা বলা থেকে তারা বিরত রয়েছেন? ভাবছেন ট্রাম্প একের পর এক বিচারিক আদালত থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে একসময় নিজেই থেমে যাবেন। বিচারিক আদালতে দৌড়াদৌড়ি শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা নিশ্চুপ থাকার নীতি নিয়েছেন। সিনেটের রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাক্কনেলের ভূমিকা মানুষকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে আত্মম্ভরি এবং অহংকারী। এমন স্বভাবের মানুষ নির্বাচনের ফলাফলকে জনগণের সিদ্ধান্ত এমন আদলে গ্রহণ করতে জানে না। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ নির্বাচনের ফলাফল নিজের ব্যক্তিগত জয়-পরাজয়ের নিরিখে বিচার করে। আত্মম্ভরি মানুষ নির্বাচনের ফলাফলকে জনগণের সিদ্ধান্ত বলে গ্রহণ না করে নিজের ব্যক্তিগত পরাজয় বলে বিশ্বাস করে বলে তা মানতে টালবাহানা করে। এমন স্বভাবের মানুষ যে কোনো সমাজ কিংবা দেশের জন্য যে কোনো সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা এ বিষয়ে তার দেশবাসীকে সাবধান করেছেন। নির্বাচনের ফলাফল উপেক্ষা করে ট্রাম্প যেসব আচরণ করছেন তা পৃথিবীবাসীকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা তার আচরণে মোটেও অবাক হচ্ছেন না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের লেখা একখানি বই ‘দি আর্ট অব দ্য ডিল’ বাজারে আছে। বইটি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে লেখেননি, তার হয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে লিখেছেন টনি সোয়ার্জ নামের এক ভদ্রলোক। ট্রাম্পের নামে ছাপা হওয়া দি আর্ট অব দ্য ডিল বইটি টনি সাহেব কীভাবে লিখেছেন ২০১৬ সালে নির্বাচনের আগে তার বিশদ বিবরণ টনি নিজেই লোকজনকে বলেছেন। বইটি লিখতে গিয়ে টনি সোয়ার্জ পাক্কা দেড় বছর ট্রাম্পের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে ছিলেন। তার সেই দেড় বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, ট্রাম্প আদ্যোপান্ত একজন খেলো স্বভাবের মানুষ। অস্থির স্বভাবের ট্রাম্পের বই পড়ার অভ্যাস শূন্যের কোঠায়। তার প্রথম স্ত্রী ইভানা বলেছেন, ট্রাম্পের শোবার ঘরে খাটের পাশে শেলফে একখানি বই আছে। বইটি হিটলারের নির্বাচিত বক্তৃতা সংকলন ‘মাই নিউ অর্ডার’। ট্রাম্পের এক বন্ধু ট্রাম্পকে ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ বইটি উপহার দিয়েছিলেন। কিছু দিন পর সেই বন্ধু ট্রাম্পকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন বইটি তার কেমন লেগেছে। জবাবে ট্রাম্প বললেন, কোন বইটির কথা বলছেন, ‘মাইন কাম্ফ’? আসলে মাইন কাম্ফ (আমার যুদ্ধ) হিটলারের আত্মজীবনী। ট্রাম্পের প্রথম স্ত্রীর অভিজ্ঞতা এবং টনির বর্ণনা পড়ে মনে হয়, ট্রাম্পের মনের ওপর হিটলারের একনায়কতন্ত্রের প্রভাব অস্বীকার করা কঠিন। একনায়কতন্ত্রের প্রতি ট্রাম্পের ঝোঁক দুনিয়াবাসীর জন্য কোনো সুখবর নয়। আমেরিকাবাসী এবং দুনিয়াবাসী সবার জন্য এটি আশঙ্কার কথা। আমেরিকার গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি অর্থাৎ রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের চোখ বুজে দিন পার করার নীতি থেকে সরে আসার সময় হয়েছে। দুনিয়ার চোখে আমেরিকার গণতন্ত্রকে আরও খেলো করার আগে রিপাবলিকান নেতারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বাধ্য করবেন বলে আমরা আশায় আছি।

                লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর