শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর সেবা

আসিফ হাসান

মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর সেবা

‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ হচ্ছে এমন একটি বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা-ব্যবস্থা, যা অনারোগ্য একজন মৃত্যুপথযাত্রীর অবশিষ্ট দিনগুলোর জন্য সর্বশেষ সেবা ও সহায়তা। দুরারোগ্য এমন কোনো অসুখ, যা আর কখনো ভালো হওয়ার নয় কিন্তু সংশ্লিষ্ট শারীরিক ব্যথার উপশমের ব্যবস্থা করা সম্ভব- সেসব রোগীর শেষ দিনগুলো সহনীয় করে তোলার প্রচেষ্টা ও সেবার ধারণাটি বর্তমান পৃথিবীতে ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ নামে পরিচিত। করোনাকালীন বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর মিছিলে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কভিড-১৯-এর নিষ্ঠুর বাস্তবতায় আমরা মাঝেমধ্যে বিভ্রান্ত হচ্ছি এই ভেবে যে, আমাদের মধ্যে মানবিকতা বাড়ছে, না কমছে? আমাদের কাছে মৃত্যু এখন শুধু একটি সংখ্যামাত্র।

আরোগ্যাতীত একজন অসুস্থ ব্যক্তি এবং তার পরিবারের সংকট শুধু শারীরিক নয়, এ হতে পারে মানসিক, সামাজিক, আর্থিক, আধ্যাত্মিক; যা শারীরিক অসুস্থতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। একজন রোগীকে শারীরিক অসুস্থতাসহ সব কটি ক্ষেত্রে যখন সাহায্য করা যায় কেবল তখনই তাকে ‘সম্পূর্ণ সেবা’ বলা যায়। এ ক্ষেত্রে সব বিষয় সমন্বয় করে দুরারোগ্য অসুস্থ মানুষকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সেবা প্রদানের প্রচেষ্টাই প্যালিয়েটিভ কেয়ার।

মৃত্যু অনিবার্য, তবে তা হতে হবে যত দূর সম্ভব ভোগান্তিহীন ও শান্তিময়। বিষয়টি সম্পর্কে সবার স্বচ্ছ ধারণা এবং সচেতনতা তৈরিতে জাতীয় স্বাস্থ্য -ব্যবস্থায় প্যালিয়েটিভ সেবার অন্তর্ভুক্তি পূর্বশর্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালের মে মাসে গৃহীত একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে স্বীকৃতি দিয়ে সব সদস্য রাষ্ট্রকে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে তা অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্যালিয়েটিভ কেয়ার এখন আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি। অসুখ-বিসুখ, রোগবালাই যেন কখনো না হয় আর হলেও যেন দ্রুত ভালো হয়ে যায়- লক্ষ্যটা প্রায় সবারই সেদিকে। স্বাস্থ্যকর্মীরাও সাধারণত রোগ ও তার প্রতিকারের প্রতি বেশি মনোযোগ দেন। গত ১০০ বছরে চিকিৎসাবিজ্ঞান এ দুই ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্যও অর্জন করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখনো অনেক রোগ আছে যা ভালো হয় না। তাদের প্রান্তিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই প্যালিয়েটিভ কেয়ারের কর্মপরিধি। এসব মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনেক সময়ই চিকিৎসকরা বলেন, ‘আর কিছু করার নেই, বাড়ি নিয়ে যান’। এ ধরনের কথা বলা ভুল। প্যালিয়েটিভ কেয়ারের দৃষ্টিতে ‘কিছুই করার নেই’ একটি ভুল ও পলায়নপর মনোবৃত্তি। মানবিক দায়িত্ব হিসেবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কিছু না কিছু নিশ্চয়ই করার থাকে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে এমন রোগীদের সেবা দিচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। এখানে ২০১১ সালে ‘সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অন্তর্বিভাগ, বহির্বিভাগে পরামর্শ গ্রহণ এবং ভর্তি রোগীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা প্রমাণ করে, এ ধরনের রোগী ও আক্রান্ত পরিবারের সংখ্যা কত বেশি। প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন চিকিৎসাসেবা নামে এ কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ‘ভালো হওয়ার নয়’ এমন রোগী এবং তার পরিবারকে চিকিৎসাসেবা ও সহযোগিতা দেওয়ার মাধ্যমে তাকে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসা।

বিএসএমএমইউতে সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ ২০১৬ সালে নিপোর্ট ও বিএসএমএমইউর এক যৌথ জরিপের প্রতিবেদন উল্লেখ করে জানান, ‘দেশে সে সময় এ রকম রোগী ছিল প্রায় ৬ লাখ। বর্তমানে এ হার প্রতি বছর বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত, এসব রোগীর শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ আরোগ্যাতীত অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে আসে। তাদের জন্য আমাদের দেশে কোনো সংগঠিত চিকিৎসাব্যবস্থা নেই। দক্ষিণ ভারতের কেরালা, আফ্রিকার উগান্ডা, তানজানিয়া ও সাউথ আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল দেশে সমাজের সবাই মিলে ‘সমাজভিত্তিক প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ নামে এক নতুন মাত্রার সংযোজন করেছে। আশার কথা হলো, আমাদের দেশেও কেরালা মডেল অনুসরণ করে বস্তি এলাকায় কিছু সেবা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের মতো দেশে এ চিকিৎসাসেবা তখনই সফলতা পাবে যখন এটি বাড়ি বাড়ি পর্যায়ে অর্থাৎ কমিউনিটিভিত্তিক ব্যবস্থার আওতায় চলে আসবে। এ জন্য দরকার সমন্বয়ভিত্তিক সামাজিক সচেতনতা ও কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর মোট মৃত্যুর প্রায় ৭১ শতাংশ মারা যায় ‘নন কমিউনিক্যাবল ডিজিজ বা অসংক্রমণ রোগে’। এ রোগে আক্রান্তের শতকরা ৭০ জন মৃত্যুর আগে তীব্র শারীরিক ব্যথা সহ্য করে। ২০১৬ সালে আইসিডিডিআরবি পরিচালিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৫৯ শতাংশরেই মৃত্যু হয় অসংক্রমণ রোগে। জীবনের শেষ প্রান্তে এ ধরনের রোগে আক্রান্তের এক বিশাল সংখ্যার প্রয়োজন হয়ে পড়ে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের। এত বিপুলসংখ্যক প্যালিয়েটিভ রোগীকে সেবা দেওয়ার জনকাঠামো দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। অথচ খুব অল্প প্রশিক্ষণে দেশের স্বাস্থ্যকর্মী বা স্বেচ্ছাসেবী সমন্বয়ে একটি প্রশিক্ষিত ‘সেবা দেওয়ার জনসম্পদ’ তৈরি করা সম্ভব। যারা আরোগ্যাতীত রোগীদের ব্যথাহীন মৃত্যু নিশ্চিত করা, শ্বাসকষ্টে আরাম দেওয়া, দুর্গন্ধযুক্ত ক্ষতস্থান পরিষ্কার করাসহ সাধারণ সেবা দিতে সক্ষম হবে।

পরিসংখ্যানগত ধারণা যে, ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি বছর নতুন ক্যানসার রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ। এসব রোগীর দুই-তৃতীয়াংশই থাকবে উন্নয়নশীল দেশগুলোয়, যারা মোট বিশ্বস্বাস্থ্য ব্যয় খাতের মাত্র ১০ শতাংশ অর্থ ব্যবহার করে। তাহলে এসব মানুষ কি জীবনের প্রান্তিক সময়টুকু কোনো চিকিৎসাই পাবে না? অথচ সবাই চায়, নিজের ও প্রিয়জনের জীবনের পরিসমাপ্তি যেন শান্তিতে আর স্বস্তিতে হতে পারে। সহজ, স্বাভাবিক ও প্রশান্তির মৃত্যু সবারই কাম্য।

লেখক : সাংবাদিক।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর