শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে করণীয়

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে করণীয়

অর্থনীতির সব খাতের ক্ষতি পুষিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত মেরামত করে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়, এ নিয়ে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন সংস্থা তাদের বহুমুখী প্রস্তাব এবং উপদেশ দিয়েছেন। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধার করে স্বাভাবিক (Normal) অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আর তা করতে হলে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের মতো আরেকটি যুদ্ধে নামতে হবে। এ যুদ্ধ হবে দেশের মানুষ এবং অর্থনীতি বাঁচানোর যুদ্ধ। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হবে না, সহজও হবে না। আমাদের অর্থনীতি শুধু অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ক্ষমতার ওপর স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর দেশের অর্থনীতি বহুলাংশে নির্ভরশীল। তৈরি পোশাক রপ্তানির আয় এবং রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চাকা সচলে বিশাল ভূমিকা রাখে। আর এ দুই খাতের আয় নির্ভর করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মন্দাভাব বিরাজমান। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে মন্দা অবস্থা ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ‘বিশ্ব অর্থনীতির পূর্বাভাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হ্রাস পাবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বের উন্নত অর্থনীতিগুলোর প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ কমবে। আর উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি চলতি বছরে হ্রাস পাবে ৩ শতাংশ। পরে সংস্থাটি তাদের পূর্বাভাস সংশোধন করে। চলতি বছরে বৈশ্বিক জিডিপি ৪ দশমিক ৯ শতাংশ সংকুচিত হবে বলে উল্লেখ করে। এমনি পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বর্তমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মুক্ত গণমাধ্যম ও অবাধ গণআলোচনার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টির নীতি পরিবর্তন করে ভবিষ্যতে কম বৈষম্যপূর্ণ বিশ্ব গড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বে বিস্তর অসমতার বিষয়টি সামনে তুলে এনেছে।’ তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস হচ্ছে একটি এক্স-রে, যার মাধ্যমে আমাদের গড়ে ওঠা সমাজব্যবস্থার ভঙ্গুর কঙ্কাল প্রকাশ পেয়েছে।’ সবার জন্য সমান সুযোগ, মানবাধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নতুন বৈশ্বিক চুক্তি ও সামাজিক তত্ত্ব প্রয়োগ জরুরি। এর মাধ্যমে একটি ‘নতুন মডেলে’ এ মহামারী মোকাবিলা করার পরামর্শ দেন। বাংলাদেশের গর্ব নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট উত্তরণের জন্য বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ‘পুনরুদ্ধারের’ পরিবর্তে ‘পুনর্গঠনের’ প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স সৃষ্ট ব্যাপক বেকারত্ব সমাজকে ভয়ংকর হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। পৃথিবীজুড়ে সব সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে মাত্র গোটা কয়েকজনের হাতে চলে গেছে। ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই তিনি কিছুতেই আবার পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চান না।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবিকা নির্বাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মানুষ। ২৬ মার্চ থেকে একটানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির পর অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, শপিং মল এবং সব ধরনের দোকানপাট পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়া হয়। লকডাউন ক্রমান্বয়ে শিথিল করে দেওয়া হয়। ফলে ঘুরতে শুরু করে শিল্পের চাকা, স্বাভাবিক হয়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বাড়তে থাকে উৎপাদন ও রপ্তানি। আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিপর্যস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর অগ্রগতি দৃশ্যমান। তৈরি পোশাক খাতের স্থগিত ক্রয়াদেশগুলো আবার ফিরে আসতে শুরু করে। রেমিট্যান্স প্রবাহ অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি পায়। যদিও রেমিট্যান্স প্রবাহকে অনেকে সাময়িক মনে করেন। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ১৩ আগস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট উদ্বৃত্ত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স উচ্চ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। আগস্টের প্রথম থেকে করোনাভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় অর্থনীতি প্রায় সচল। করোনাকে সঙ্গী করেই মানুষ কাজকর্ম শুরু করেছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর এ গতি ধরে রেখে তা স্থিতিশীল করতে হবে। তাহলেই দেশের কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক উত্তরণ সম্ভব হবে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ৪০ জন অর্থনীতিবিদের কাছে করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি ও পুনরুদ্ধারে তাদের মতামত নিয়ে ‘চিফ ইকোনমিস্ট আউটলুক’ প্রকাশ করেছে। তারা বিভিন্ন দেশের জন্য তিনটি প্রধান উদীয়মান চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো- ক. বৈষম্য হ্রাস ও সামাজিক গতিশীলতা বাড়াতে অর্থনৈতিক নীতিগুলো পুনর্বিবেচনা খ. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন উৎস চিহ্নিত এবং গ. অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা বাড়াতে নতুন লক্ষ্যের ওপর মনোযোগ দেওয়া। এসব চ্যালেঞ্জ ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি এবং ব্যাংকগুলোর অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থা বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বর্তমানে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতাকে আরও গতিশীল করা অপরিহার্য। বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য দেশের সরকার ও জনগণকে বেশ কিছু বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।

সর্বপ্রথম দেশে বিরাজমান করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অতিদ্রুত প্রতিরোধ করতে হবে। দেশ সম্পূর্ণভাবে সংক্রমণমুক্ত না হলে অর্থনীতির চাকার গতি বাড়বে না। দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় কভিড-১৯ রোগীর পরীক্ষা বৃদ্ধি, রোগীর সুচিকিৎসা ও মৃতের সংখ্যা হ্রাস করে জনমনের আতঙ্ক দূরীভূত করতে হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সরকার দেশের অবস্থা স্বাভাবিক দেখানোর লক্ষ্যে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা সীমিত করে দিয়েছে। ১২ আগস্ট থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতর করোনা পরিস্থিতি জানানোর জন্য দৈনিক যে ব্রিফিং করত তা বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারি পরামর্শক কমিটির করোনাভাইরাস পরীক্ষা বৃদ্ধির তাগিদকেও সরকার আমলে নেয়নি। মৃত্যুর হার কমে যাওয়ায় ব্রিফিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন। পরদিন (১৩ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রদত্ত প্রেস রিলিজ অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা ৪৪ ও আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৬১৭ জন। অর্থাৎ ব্রিফিং বন্ধ করে দিলেই যে সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা হ্রাস পাবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সংক্রমণ ও মৃতের প্রকৃত সংখ্যা দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব না হলে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না।

অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ-পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারকে গতানুগতিক নীতি পরিবর্তন করে বিনিয়োগবান্ধব নতুন নীতি অনুসরণ করতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ওয়ান-স্টপ সার্ভিস’ প্রদান, ব্যাংক ঋণ ব্যবস্থা সহজীকরণ ও পর্যাপ্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক বেড়াজাল থেকে এ খাতকে মুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের মতে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কৌশল হিসেবে তিনটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রথমত, মানুষের (জনশক্তি) ওপর বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। যারা পিরামিডের মতো নিচের দিকে আছে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে, টিকিয়ে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হতে হবে আরও সবুজ ও স্থিতিস্থাপক। তৃতীয়ত, ডিজিটাল রূপান্তরে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে দেশে বিদেশি বিনিয়োগের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জাপান, চীনসহ বেশ কিছু দেশ থেকে বিনিয়োগ স্থানান্তর হচ্ছে। এসব বৈদেশিক বিনিয়োগে আকর্ষণ বাড়াতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ইতিমধ্যে সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে ব্যাংকব্যবস্থায় কিছু সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। সে সুবিধাসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কড়া নজরদারি প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বিনিয়োগ বাড়াতে করনীতিসহ জমি প্রাপ্তি সহজ করা অপরিহার্য।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের ফলে কাজ হারিয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৫৯ লাখ ২ হাজার ২৭১ জন। এ সময়ে ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের শ্রেণি পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে ২ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ হতদরিদ্র হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এ বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে দেশে ১ কোটি ৬৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে। সংখ্যা যাই হোক, দেশে বেকার ও দারিদ্র্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতির চাকা পুরোদমে চালু করতে হলে দেশে অতিদ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ, কর্মের নতুন নতুন ক্ষেত্র এবং পর্যাপ্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। বলা বাহুল্য, এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে না পারলে ‘এসডিপি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না।

বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংক বিশাল ভূমিকা রাখে। দেশে ব্যাংকব্যবস্থার দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ঋণ বিতরণে অস্বচ্ছতা, ঋণ খেলাপি কৃষ্টি, লুটপাটসহ (এমনকি রিজার্ভ লুট) বিভিন্ন অব্যবস্থা বিরাজমান। ফলে বর্তমানে ব্যাংক খাত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তার ওপর করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারি প্রণোদনা ও বাজেট ঘাটতি পূরণে অর্থ জোগান দিতে হবে বিপর্যস্ত এ ব্যাংকগুলোকে। যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে ব্যাংকব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, খাদ থেকে তুলে আনতে দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।

তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ অবদান রাখে। কভিড-১৯ মহামারীতে তৈরি পোশাক আমদানিকারক দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বৈশ্বিক মন্দার সৃষ্টি করেছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর এ খাতে ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হওয়ায় দেশ রপ্তানি আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জুলাই-আগস্টে বাতিল ও স্থগিত ক্রয়াদেশগুলো ফিরে আসায় দেশের তৈরি পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। কিন্তু বৈশ্বিক মন্দার ফলে আগের মতো ক্রয়াদেশ আসবে কিনা তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্বিধা রয়েছে। এ অবস্থায় পোশাক তৈরিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। রপ্তানি গন্তব্যের নতুন বিকল্প সন্ধান করতে হবে।

রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যেসব দেশে প্রবাসী অধিক সংখ্যায় কর্মরত ছিল, সেসব দেশে বাংলাদেশি অভিবাসীরা চাকরিচ্যুত হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেকার হয়ে দেশে ফিরতে শুরু করেছে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় ৭০ হাজার অভিবাসী দেশে ফেরত এসেছে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। এসব দেশেই বাংলাদেশের প্রবাসীরা বেশি কর্মরত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের (বিশেষ করে সৌদি আরব) থেকে বাংলাদেশিরা বেশি ফেরত আসতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে অতিদ্রুত বৈদেশিক কর্মসংস্থানে বিকল্প দেশের সন্ধান অতীব জরুরি। বিদেশে চাকরিপ্রার্থীদের প্রশিক্ষিত জনশক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির চিত্র দেশে-বিদেশে নগ্নভাবে প্রচারিত হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির খবর সব মিডিয়ায় বড় শিরোনাম লাভ করছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী অর্থের প্রবাহ দ্রুত বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার করোনার প্রভাব মোকাবিলায় দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা বাজেটে প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করে টাকার প্রবাহ বাড়াচ্ছে। এমনকি টাকা ছাপানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকসহ বৈদেশিক আর্থিক সংস্থা ও দেশ থেকে ঋণ পেতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে। এ ছাড়া বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এসব অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ১০০ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর বেশির ভাগ বিতরণ হবে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রণোদনার অর্থ বিতরণে ব্যাংকগুলোর অনীহা ও শৈথিল্য প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে ‘এসএমই’ খাতে নির্ধারিত প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ ছাড়ে ব্যাংকগুলোর তেমন উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। প্রণোদনা প্যাকেজে দরিদ্র-সহায়তা কার্যক্রমেও দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব ও সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকার-ঘোষিত প্রণোদনা ও দরিদ্র-সহায়তা কার্যক্রম যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হয়, তা বেহাত হয়ে যায় বা অনাকাক্সিক্ষত উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয় তাহলে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা খুবই কষ্টকর হবে।

করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যয়ে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করা অপরিহার্য। বিগত দিনে সরকারি খরচে স্বেচ্ছাচারিতা, বিলাসিতা ও দুর্নীতি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে হবে। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে ধীরগতির কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর ও নির্লোভ পদক্ষেপ গ্রহণ করে অর্থ সাশ্রয় অতীব জরুরি। সেই অর্থ দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। বৈষম্য হ্রাস ও সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালার পুনর্বিবেচনা এখন সময়ের দাবি। ব্যক্তি খাত, এনজিও এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে একটি কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন। সক্রিয় কর্মকৌশল দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস, সরকারের বক্তব্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, দেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি এবং অর্থনীতিবিদদের প্রদত্ত পরিসংখ্যানের মধ্যে অনেক পার্থক্য। বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতিতে জিডিপি নিম্নমুখী হয়েছে, তাতে কারও কোনো দ্বিমত নেই। বাংলাদেশেও যে জিডিপি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে তা অস্বীকার করারও কারও সুযোগ নেই। তাই শতাংশের বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক না করে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত করতে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব না হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধিও স্বপ্নই থেকে যাবে।

সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গৃহীত কর্মসূচি এবং কৌশল বাস্তবায়নে দেশের প্রশাসন বিশাল ভূমিকা পালন করে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যাবতীয় কার্যক্রম, নীতি ও কৌশল বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনের স্বচ্ছতা, আন্তরিকতা, কর্মদক্ষতা ও দায়বদ্ধতা একান্ত প্রয়োজন। করোনা-পরবর্তী দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সরকারের আত্মতুষ্টির প্রয়োজনে নয়, এটা প্রয়োজন জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। তাই এ বিষয়টিকে জাতীয় সংকট ও চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সংকট মোকাবিলায় জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি একান্ত জরুরি। এমন ঐক্য যা জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়। এ লক্ষ্যে একটি সামাজিক চার্টার প্রণয়ন করা যেতে পারে। যাতে থাকবে একদিকে অসমতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, নির্যাতন, নিপীড়ন, লোভ-লালসা, মিথ্যা ও অনৈতিকতা পরিহারের প্রতিশ্রুতি। অন্যদিকে থাকবে দেশে গণতন্ত্র, সাম্য, সমতা, মানবিকতা, মানবাধিকার ও সুবিচার। থাকবে সত্য, সুন্দর, নৈতিক, বৈষম্যহীন ও পরিচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী, সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি-বিএনপি।

 

সর্বশেষ খবর