শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

তিতবেগুনে টমেটো, পাল্টে গেছে তিনগাঁও

শাইখ সিরাজ

তিতবেগুনে টমেটো, পাল্টে গেছে তিনগাঁও

নভেম্বরের মিষ্টি রোদের সকাল। যাচ্ছি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তিনগাঁও গ্রামে। গ্রামের বুক ছুঁয়ে আঁকাবাঁকা পথ। পথের দুই ধারে ফসলের খেত। কোথাও আগাম রবিশস্য। আবার কোথাও মাঠের পর মাঠ ধান; আর কদিন পরই সোনালি হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের গ্রাম পাল্টে গেছে, পাল্টে যাচ্ছে।  আগে সাধারণত ভোরবেলাতেই কৃষক মাঠে চলে আসতেন। ভোরেই শুরু হতো খেত-খামারের কাজ। এখন সকাল ৯টা-১০টার আগে যেন কৃষক মাঠে নামেন না। প্রযুক্তির কল্যাণে কৃষকের জীবনে এসেছে স্বচ্ছন্দ। তবে সিলেট অঞ্চলের কৃষি ও কৃষক নিয়ে এ কথা প্রচলিত যে, এ অঞ্চলের পতিত জমির পরিমাণ বেশি। অর্থাৎ এ অঞ্চলের মানুষের কৃষির প্রতি টান ছিল কম। বিশেষ করে মনে পড়ছে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাহেব বেশ কবার সিলেটে অনুষ্ঠিত আমার ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সিলেটের কৃষক অলস। পরিবারের লোকজন বিদেশ থাকায় অভাব কম। তাই সিলেটের অনেক জমি পতিত।’ আশার কথা, এ আক্ষেপের দিন ক্রমে ফুরিয়ে আসছে। পাল্টে যাচ্ছে সিলেট অঞ্চলের কৃষিও। কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ছে। আগ্রহী হয়ে উঠছেন তরুণ কৃষক।

যাই হোক, দেখতে যাচ্ছি টমেটো কী করে একটা গ্রামকে পাল্টে দিতে পারে। আমার সঙ্গে টিমের বাইরেও রয়েছেন এ অঞ্চলের কৃষক সংগঠক কৃষক বদু মিয়া। বদু মিয়া ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় আমার অনেক আগে থেকেই। তিনি আমার জন্মদিনে প্রতিবার আমার শার্টের মতো শার্ট গায়ে দিয়ে নিজ খেতের তরমুজ, কখনো মিষ্টিকুমড়া, কখনো টমেটো নিয়ে হাজির হয়ে যান চ্যানেল আইতে, আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে। কৃষি ও কৃষকের প্রতি প্রগাঢ় মমতা রয়েছে এই মানুষটির। দেখলাম কৃষকও আপন মনে করেন বদু মিয়াকে। বাংলাদেশের পাল্টে যাওয়া কৃষিচিত্রের অন্যতম কারিগর বদু মিয়ার মতো এমন সব কৃষক। তাদের কল্যাণেই কৃষির বহুমুখী বৈচিত্র্য এখন দেশজুড়ে। উপজেলা শহর থেকে গ্রামের রাস্তা ধরে এগোলে দুই পাশ জুড়ে বাঁশের খুঁটিসমেত খেত চোখে পড়ে। একটু কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম টমেটো চাষ হচ্ছে এখানে। বাঁশের খুঁটিগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী চাষের সুবিধার্থে। এ পদ্ধতির চাষব্যবস্থা খেতের চেহারাই যেন বদলে দিয়েছে। যারা নিয়মিত ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ দেখেন তাদের মনে থাকতে পারে, এ অঞ্চলের টমেটো চাষ ও বাজারব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছিলাম বেশ কয়েকবার। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের একটি প্রতিবেদন চিত্র ধারণ করেছিলাম ২০০৪ সালে। তখন এ অঞ্চলে কেবলই উচ্চফলনশীল টমেটো চাষ শুরু হয়েছে। টমেটোর বাম্পার ফলন দেখে কৃষক খুশি হলেও উৎপাদন যখন বেড়ে গেল তখন কৃষক বাজারে গিয়ে মুখোমুখি হলো অন্যরকম সংকটের। দাম নেই। বাজারভর্তি টমেটো। ক্রেতা নেই। এক কৃষক বলছিলেন, পাইকারদের জামাই আদর করেও টমেটো কেনাতে পারছিলেন না। ২০ টাকা মণ দরেও টমেটো বিক্রি করতে না পেরে অনেক কৃষক রাগে-ক্ষোভে টমেটো নষ্ট করে ফেলে দিয়েছিলেন এমন দৃশ্যও দেখেছি। কুমিল্লার নিমসার বাজারেই এক সকালে আমরা এমন কঠিন এক দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছিলাম। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে যখন প্রথম গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ শুরু হলো, তখন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন হরমোন ব্যবহার করে টমেটো পাকানোর হিড়িক পড়ে গেল। মনে পড়ছে, কয়েক বছর আগে শরীয়তপুরে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত টমেটো চাষ এলাকায় দেখেছি প্রশাসনের কঠোর অভিযান। সেখানে গড়পড়তা অভিযানে কৃষককে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখেছি। তবে আশার কথা, আমাদের কৃষক সব সময় ঘুরে দাঁড়াতে শিখেছেন। এ টমেটোই এখন খেত থেকে কৃষক বিক্রি করছেন ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে। কৃষক এখন বাণিজ্যিক লাভের জন্য অন্য কোনো পথ নয়, প্রযুক্তিকেই স্বাগত জানিয়েছেন। তারা ফসল আবাদে নতুন নতুন প্রযুক্তির সংযোগ ঘটাচ্ছেন।

তিনগাঁও গ্রামের কৃষক দুলালের মাঠে যখন এসে দাঁড়ালাম রোদের তীব্রতা বেশ বেড়ে গেছে। টমেটোর খেতে রুপালি মালচিং পেপার চকচক করছে। বিস্তীর্ণ খেতে কাঁচাপাকা টমেটোয় ভরপুর এক একটি গাছ। জানা গেল এখানে সারা বছরই টমেটো উৎপাদন হচ্ছে। তিতবেগুনের গাছের গোড়ার সঙ্গে টমেটো গাছের চারার গ্রাফটিং করছেন কৃষক। এতে টমেটো গাছ একদিকে অধিক টেকসই হচ্ছে, অন্যদিকে ফলনও অধিক পাচ্ছেন তারা। গত কয়েক বছরে এ গ্রাফটিং পদ্ধতিতে টমেটো চাষে নেমে এলাকার শত শত কৃষকের ভাগ্য বদলে গেছে। কৃষি বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গোটা হবিগঞ্জ জেলায় টমেটো চাষ হয় ৪ হাজার ৫০০ বিঘা জমিতে। যার মধ্যে মাধবপুর উপজেলায় ১ হাজার ৮৭৫ বিঘা। এর মধ্যে প্রায় ২০০ বিঘায় চলছে গ্রাফটিং পদ্ধতির ব্যবহার। বলে রাখি, ১৯২০ সালের দিকে সবজি চাষে গ্রাফটিং পদ্ধতি শুরু হলেও এই সময়ে এসে এটি খুব জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত। বিশেষ করে জাপান ও কোরিয়ার কৃষিতে গ্রাফটিং পদ্ধতির ব্যবহার খুব বেশি। সবজি চাষে জাপান বর্তমানে ৮১% ও কোরিয়া ৫৪% গ্রাফটিং পদ্ধতি অনুসরণ করে। ২০০০ সালের দিকে ফ্রান্স ও ইতালিতে টমেটো চাষে গ্রাফটিং পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ তারা দেখল এ পদ্ধতিতে টমেটো গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি পায়, ফলনও বাড়ে। মনে পড়ে আশির দশকের শেষের দিকে গাজীপুরে অবস্থিত তৎকালীন ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন এগ্রিকালচার (ইপসা) যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, সেখানে গিয়েছিলাম তাদের গবেষণা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে। সেখানে দেখেছিলাম তিতবেগুনের সঙ্গে টমেটোর গ্রাফটিং নিয়ে গবেষণা চলছে। যেহেতু তিতবেগুন ও টমেটো উভয়ই সোলানেসি (Solanaceae) পরিবারের, তাদের মাঝে গ্রাফটিংটা ভালো হয়। যাই হোক, তিনগাঁও গ্রামের কৃষক দুলাল মিয়াও বলছেন, গ্রাফটিং করা গাছে রোগবালাই কম ধরে। বাড়তি ফলন তো রয়েছেই। এর আগে সাধারণ একটি গাছে যেখানে ৫ থেকে ১০ কেজি টমেটো পাওয়া যেত সেখানে এখন ২০-২৫ কেজি টমেটো মিলছে। গ্রাফটিং করা টমেটো গাছ পানিসহনীয়, ভারী বৃষ্টিতেও নষ্ট হয় না। চারার ব্যাপক চাহিদার কারণে কৃষক দুলাল নিজেই রপ্ত করেছেন গ্রাফটিং কৌশল।

বছরব্যাপী টমেটোর চাহিদা মাথায় রেখে কৃষক অনুশীলন করছেন গ্রাফটিং পদ্ধতিতে। আগে সাধারণত অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে টমেটোর চারা রোপণ করা হতো। চৈত্রে ফলত ফসল। এখন কৃষক মৌসুমের বাইরে নয় মাস যেন ফলন পাওয়া যায় সে চিন্তা মাথায় রেখে বীজতলা ও চারা তৈরি করেন। আর এ পদ্ধতিতে দ্বিগুণ বা তারও বেশি ফলন পাচ্ছেন। কথা হলো আরেক কৃষক বেলাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বললেন, তার জীবনটাই বদলে গেছে টমেটো চাষ করে। প্রযুক্তিনির্ভরতা ছাড়া এটি সম্ভব হতো না। কথা হলো আরেক টমেটো চাষি সৈয়দ মিয়ার সঙ্গেও। এখন শুধু টমেটো থেকে বছরে ২-৩ লাখ টাকা আয় করেন। অথচ আগেও টমেটো চাষ হতো। তখন আয় ছিল মাত্র ৫০-৬০ হাজার টাকা। আবার কখনোসখনো লোকসানও গুনতে হয়েছে। একেবারে দিনহীন অবস্থা ছিল ইউসুফ আলীর। সেখানে ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র পেয়েছেন টমেটো চাষ থেকেই। এখন আগের যে কোনো অবস্থা থেকে অনেক ভালো আছেন তিনি। সব কৃষকই বলছেন, এই গোটা এলাকার কৃষির বৈচিত্র্য ও উন্নয়নের পেছনে একজন কৃষকের অনেক বড় অবদান। তিনি হলেন কৃষক সংগঠক বদু মিয়া। শতভাগ কৃষিপ্রাণ মানুষ তিনি। নতুন নতুন ফসল আর প্রযুক্তির প্রতি দারুণ ঝোঁক অতি সাধারণ এ কৃষকের। স্থানীয়ভাবে গ্রাফটিং প্রযুক্তিতে টমেটো চাষিদের উদ্বুদ্ধ করতে সম্প্রসারকের ভূমিকা রেখেছেন তিনি। বিনয়ী বদু মিয়া বললেন, আরেক গল্প। কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটে উপস্থিত থেকে তিনি আমার মুখে শুনেছিলেন জৈবকৃষির কথা। সেই থেকে তিনি মাঠে আছেন জৈবকৃষির বিস্তারে। তিনি বুঝে গেছেন টেকসই কৃষি মানেই জৈবকৃষি। ভালো লাগল, এখানকার কৃষকও শুধু ফসল উৎপাদন আর নিজের লাভ নিয়েই মগ্ন নন, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের ভাবনাগুলোও তাদের মাথায় রয়েছে।

কথা হলো তিনগাঁও গ্রামের অনেকের সঙ্গে। সবার এক কথা, টমেটোই পাল্টে দিয়েছে এ গ্রামের অর্থনীতি, কৃষকের দিন। এক ট্রাক টমেটো বিক্রি করে ৫ ট্রাক ইট কিনতে পারে কৃষক। দেখলাম সত্যি সত্যি কৃষকের বাড়িগুলো পাকা হয়ে যাচ্ছে। দালান উঠছে বাড়ি বাড়ি। এই তো সমৃদ্ধি! এই তো উন্নতি!

আগেই বলেছি, আমাদের কৃষক ভাইয়েরা এখন প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক বেশি আগ্রহী ও সচেতন। বাণিজ্যিক চাষাবাদের সুফল বুঝে যাওয়ার কারণে কৃষক এখন বেশি ফলনের দিকে ঝুঁকছেন। তাদের বিশ্বাস, প্রযুক্তিনির্ভর ও পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে লাভ রয়েছে বহুমুখী এবং লাভের হিসাবটিও চুলচেরা। হবিগঞ্জ ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলোয় টমেটো চাষে এ প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়েছে। তবে বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতি আমার সবিনয় অনুরোধ থাকবে টমেটোর জাত উন্নয়নে তাদের গবেষণা অব্যাহত রাখার। আমার জানা মতে, বারি-৮ জাতের টমেটো কৃষকের কাছে বিপুল জনপ্রিয়। এটা শীত মৌসুম ছাড়াও অন্য মৌসুমে ভালো ফলন দেয়। কৃষক বারি-৮-এর সঙ্গে তিতবেগুনের গ্রাফটিং করে যে চারা তৈরি করছেন, সে চারার জাত তৈরি করা গেলে কৃষকের চারা তৈরি করতে যে সময় ও জমি অতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে, সে সময় ও জমি ব্যবহারে অন্য ফসল উৎপাদন করে কৃষক লাভবান হতে পারতেন। আমি আশা করি কৃষি গবেষণা সংস্থাগুলো বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দেবে এবং শিগগিরই বৃষ্টিসহনশীল ও অধিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন টমেটোর জাত কৃষককে উপহার দিতে সক্ষম হবে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর