রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

জিয়ার বিএনপি বনাম আজকের বিএনপি

মহিউদ্দিন খান মোহন

জিয়ার বিএনপি বনাম আজকের বিএনপি

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের ফলে দেশে যে বিশাল রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা কীভাবে পূরণ হবে কিংবা আদৌ হবে কি না এবং বাংলাদেশ পুনরায় গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে পারবে কি না, তা নিয়ে সে সময় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল সংশয়ে ছিল। কেননা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেরই বছরের পর বছর সামরিক শাসনের নিগড়ে বন্দী থাকার নজির ছিল। এমনকি আমাদের দেশেও স্বাধীনতা-পূর্বকালে ১০ বছর সামরিক শাসন বহাল ছিল। ফলে রাজনৈতিক মহলে ১৫ আগস্ট-পরবর্তী যারা ক্ষমতা পেয়েছেন তারা গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে যাবেন কি না এ সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। ঘটনা পরম্পরায় তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার পরই ঘোষণা করেন, দেশে অচিরেই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু করা হবে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, ওই সময় বিচারপতি এ এস এম সায়েম রাষ্ট্রপতি থাকলেও ক্ষমতা অনুশীলন করছিলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর কিছু ধারা ‘পরবর্তী জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে অনুমোদন সাপেক্ষে’ স্থগিত করে পুনরায় বহুদলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পথ উন্মুক্ত করা হয়। তারই ফলে বাকশাল প্রতিষ্ঠাকালীন বিলুপ্ত দলগুলো পুনর্জীবিত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরই সবাই বুঝতে পারেন জিয়াউর রহমানের রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার অভিপ্রায় রয়েছে। ওই বছরই জুন-জুলাইয়ে দেশে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দেওয়া হয়।

১৯৭৭ সালের এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি এ এস এম সায়েম ‘স্বাস্থ্যগত কারণে’ পদত্যাগ করলে জিয়াউর রহমান তার স্থলাভিষিক্ত হন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান দেশে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালুর অভিপ্রায় পুনর্ব্যক্ত করেন। একই বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষনেতাদের সঙ্গে বঙ্গভবনে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠান করেন। সেখানে তিনি পরিষ্কার করেই বলেন যে, সামরিক শাসন কখনো স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি পুনরায় চালু করতে তিনি রাজনীতিকদের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন, শিগগিরই জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আয়োজন করা হবে এবং নির্বাচিত সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে। পরে জিয়া নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে মনোনিবেশ করেন। তারপর তিনি নেপথ্যে থেকে প্রথমে জাগদল গঠন করেন। পরে ওই দল এবং আরও পাঁচটি দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দেশের রাষ্ট্রপতি হন। একই বছরের ১ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি গঠন করেন। নবগঠিত দলের চেয়ারম্যান হন জিয়াউর রহমান। সেই শুরু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে বিএনপির পদচারণ। তারপর কেটে গেছে ৪২ বছর। এ চার দশকের বেশি সময়ে জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিকে নানা চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে, মোকাবিলা করতে হয়েছে নানামুখী প্রতিকূল পরিস্থিতি। তার পরও দলটি এখনো টিকে আছে এবং আছে জনসমর্থনও। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আগামীতে দলটি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না। বর্তমানে দলটি নানাবিধ সমস্যায় এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যে, অনেকেই ভেবে কিনারা পাচ্ছেন না এ পরিস্থিতি থেকে তারা বেরিয়ে আসবে কীভাবে।

এ কথা স্বীকার করতেই হবে, চার দশকের মধ্যে বর্তমানে বিএনপি সবচাইতে সংকটময় সময় পার করছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আদালত কর্তৃক দন্ডিত হয়ে রাজনীতি থেকে দূরে আছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে যাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে সেই তারেক রহমানও আদালতের দন্ড মাথায় নিয়ে বিদেশে ফেরার-জীবন যাপন করছেন। সহসা তিনি দেশে ফিরে আসতে পারবেন, এমন সম্ভাবনা দেখছে না রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল। অবশ্য দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে তিনি নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থেকে দলকে কতটা ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবেন বা শক্তিশালী করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় আছে পর্যবেক্ষক মহলে। কেননা দুই শীর্ষনেতার কার্যত অনুপস্থিতিতে দলের নেতাদের মধ্যে একে অন্যকে না মানার এক ধরনের প্রবণতা বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা ও সিরাজগঞ্জের দুটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় দলটির দীনতাকে প্রকটভাবেই প্রকাশ করে দিয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে যতই বলা হোক- ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের দমননীতির কারণে তাদের দলের নেতা-কর্মীরা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেননি, যুক্তির খাতিরেই তা সর্বাংশে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য এটা সত্য, এ ধরনের উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পেশিশক্তি প্রয়োগের এক ধরনের প্রবণতা আমাদের দেশে রয়েছে। তেমনি ওই দুটি উপনির্বাচনে সরকারি দলের কর্মী-ক্যাডারদের বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেনি তা হলফ করে বলা যাবে না। কোথাও কোথাও জোরজবরদস্তি প্রকাশ্যেই ঘটেছে। কিন্তু তার বিপরীতে বিরোধী দলের কর্মীরা ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করবেন না এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটেছে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা নির্বিবাদে মাঠ ছেড়ে চলে গেছেন। না হলে সাবেক এমপি এ কে এম সেলিম রেজা হাবিব মাত্র ৪৬৮ ভোট পাবেন এ কি বিশ্বাসযোগ্য? ওই আসনটিতে কি মাত্র ৪৬৮ জন বিএনপি সমর্থক? একটি সংসদীয় আসনে ভোট কেন্দ্রগুলোয় অনেক পোলিং বুথ থাকে। আর প্রতিটি বুথে একজন করে এজেন্ট থাকেন। সে হিসাব করলে সেলিম রেজা হাবিবের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা পোলিং এজেন্ট সংখ্যার চেয়েও কম হবে বলে আমার ধারণা। তাহলে কি তার দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রে যাননি? ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে পেশিশক্তি ব্যবহার করলে বিরোধী প্রার্থীর সমর্থক-কর্মীদের তা প্রতিহত করার কথা। কিন্তু ঢাকা-৫, ১৮ ও সিরাজগঞ্জ-২ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপিকে সে ভূমিকায় নামতে দেখা যায়নি। আর সে জন্যই ফলাফলের এ দশা।

প্রশ্ন হলো, কর্মীরা কেন এমন মাঠ ছেড়ে ‘ভাগলপুরের’ দিকে দৌড় দিলেন। এখানেই বিএনপির সাম্প্রতিক সাংগঠনিক দৌর্বল্যের কারণটি নিহিত। দলটির সাংগঠনিক অবস্থা এখন দীর্ঘদিন মেরামত না করা ‘বাঁশ-খুঁটির ছনের ঘরে’র মতো। কালবৈশাখী তো ছার! সামান্য দমকা হাওয়াতেই তা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার দশা। দলটির নেতারা কর্মীদের সাহস জোগাতে পারছেন না। আর তা জোগাবেনই বা কীভাবে? তারা নিজেরাই তো সাহস নামের রক্তশূন্যতায় ভুগছেন। ফলে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা নিপীড়ন-নির্যাতনের কবলে পতিত হওয়ার আশঙ্কায় কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি হন না। আর তারা কেন রাজি হবেন? বিএনপির অনেক কর্মী ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় হতাশা ব্যক্ত করে আমাকে বলেছেন, দলের জন্য, নেতাদের জন্য ঝুঁকি নিয়ে মামলার আসামি হই। কিন্তু নেতারা পরে আর কোনো খোঁজখবর নেন না। বাপের অর্থ ব্যয় করে জামিন নিতে হয়। ফলে কেউই এখন আর নিজের নামটি আসামির খাতায় তুলতে চান না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ‘মোরাল স্ট্রেন্থ’ অর্থাৎ নৈতিক শক্তি দুর্বল হয়ে গেছে। এ জন্য দায়ী দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। সাম্প্রতিক সময়ে দলটি সম্পর্কে যেসব খবরাখবর সংবাদমাধ্যমে বেরিয়েছে, তাতে বিষয়টি আরও স্পষ্ট। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে অবস্থান করে যেসব নির্দেশনা দেন তা অনেকেরই নাকি মনঃপূত হয় না। বিশেষ করে দলের সিনিয়র নেতারা তার অনেক নির্দেশনাই মেনে নিতে চান না। তবে পদ হারিয়ে শেষ বয়সে বেইজ্জতি হওয়ার ভয়ে মুখও খুলতে পারছেন না। তাদের অবস্থা অনেকটা গলায় কই মাছ আটকে যাওয়া বকপাখির মতো- না পারছেন গিলতে না পারছেন ফেলতে। সম্প্রতি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে শেষ পর্যন্ত ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে লন্ডনে চিঠি পাঠিয়ে এ যাত্রায় নিজেকে রক্ষা করেছেন ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। বাজারে গুঞ্জন- স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিনিয়র নেতারা কোনো অভিমত ব্যক্ত করতে পারেন না, করলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তা আমলে নেন না। ফলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কথাকেই তারা শিরোধার্য বলে সম্মতি দেন। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বিএনপির নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক স্ট্র্যাটেজি নিয়ে মা খালেদা জিয়া ও ছেলে তারেক রহমানের মধ্যকার মতানৈক্য ও দ্বন্দ্বের কথা বলা হয়েছে। মা সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ আমলে নিয়ে দল পরিচালনার পরামর্শ দিলেও ছেলে তা মানতে নারাজ। তিনি তার নিজস্ব মত ও স্টাইলে বিএনপিকে পরিচালনা করতে চান। তারেক রহমান দলে সিনিয়র নেতাদের চাইতে অপেক্ষাকৃত জুনিয়রদের যে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন, নানা ঘটনায় তা স্পষ্ট। ফলে সিনিয়ররা, যার অনেকেই জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, তারা অস্বস্তিতে ভুগছেন এবং নিজেদের এখন দলে অবাঞ্ছিত মনে করছেন। আর এ ধারণা থেকে অনেকেই দল ও রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছানির্বাসনে গেছেন, অনেকে সে পথ অনুসরণের চিন্তাভাবনা করছেন।

এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএনপি বর্তমানে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়। এটি এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। দলটিকে চাঙ্গা করার নানা উদ্যোগের কথা বিভিন্ন সময়ে শোনা গেলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটতে দেখা যাচ্ছে না। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোয় সেসব নিয়মিতই উঠে আসছে। সম্প্রতি একটি দৈনিকের ‘নানা উদ্যোগেও কোন্দল পিছু ছাড়ছে না’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপিকে শক্তিশালী করতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোন্দল দূর করতে পারছে না দলটি। তৃণমূল বিএনপিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ, সঠিক মূল্যায়ন না করা, কমিটি গঠনে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার মাধ্যমে কোন্দল জিইয়ে রাখা হচ্ছে। এতে দলের অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করেন নেতা-কর্মীরা। তৃণমূলের অভিযোগ, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলকে শক্তিশালী করতে নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সারা দেশে কমিটি গঠনের উদ্যোগের ঘোষণার পর পৌনে দুই বছর অতিবাহিত হলেও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সিকিভাগও শেষ হয়নি। কোন্দল আগের মতোই রয়ে গেছে।

একটি বিষয় দৃষ্টে অনেকে অবাক হচ্ছেন, বিপৎসংকুল সময়ে ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা ভুলে গিয়ে যেখানে সবার একতাবদ্ধ থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কথা, সেখানে বিএনপিতে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। নেতা-কর্মীর বড় একটি অংশের মধ্যে আদর্শগত চেতনার প্রকট অভাবের কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। মুখে তারা ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’ আপ্তবাক্য আওড়ালেও কাজে তার প্রতিফলন নেই। বরং ‘দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়’ নীতিরই যেন চর্চা হচ্ছে দলটিতে। ফলে সাধারণ কর্মীরা ক্রমে হতাশ হয়ে পড়ছেন। আর এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় দলটি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেই সম্ভবত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি ‘বিএনপির রাজনীতি এখন লাইফ সাপোর্টে’ বলে কটাক্ষ করেছেন। (সূত্র : ৮ নভেম্বরের পত্রিকা)।

লাইফ সাপোর্টে না গেলেও বিএনপি যে এখন কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত তা অস্বীকার করা যাবে না। অনেকটা ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা?’ প্রবাদের মতো। নেতা-কর্মীদের আদর্শচর্চার পরিবর্তে ব্যক্তিপূজা, দলীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া, অনৈক্য, সমন্বয়হীনতা, সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা এবং নেতাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ দলটিকে রোগব্যাধির ‘ডিপো’য় পরিণত করেছে। সে জন্যই রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, বিএনপি এ মুহূর্তে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত এবং এর সুচিকিৎসা জরুরি। কিন্তু সে চিকিৎসা কোন পদ্ধতিতে হবে কিংবা কোন চিকিৎসক তা করবেন, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে এও সত্য, কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও বিএনপি এখনো একেবারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে চলে যায়নি। রাজনৈতিক দলের সুস্থ থাকার প্রধান যে অবলম্বন, সে জনসমর্থন এখনো বেশ ভালোই আছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের সমর্থকদের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে দলটির একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি এখনো আছে। কিন্তু সে সমর্থন ও সহানুভূতি কাজে লাগিয়ে দলটিকে পুনরায় উজ্জীবিত করার উদ্যোগের অভাব প্রচ-।

রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল বলে থাকে, জিয়াউর রহমানের বিএনপি এবং বর্তমান বিএনপির মধ্যে রয়েছে বিস্তর তফাত। এ ফারাক নীতি-আদর্শ ও কর্মকৌশলের। জিয়া-উত্তর বিএনপিতে আদর্শের চর্চা ক্রমে কমেছে। বর্তমানে তা একেবারে তলানিতে। খোদ দলটির নেতা-কর্মীর একাংশ মনে করেন, বিএনপি বর্তমানে এর প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নীতি-আদর্শ থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। জিয়া রাজনীতিবিদ না হয়েও যেভাবে দলকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে পেরেছিলেন, এখন তা একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না। জিয়াউর রহমানের জীবিতাবস্থায় টাকা দিয়ে দলের পদ কেনার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। এখন তা আর কল্পনার বিষয় নয়, চরম বাস্তবতা। এটা এখন প্রবাদবাক্যের মতো হয়ে গেছে যে, বিএনপিতে টাকা দিলেই পদ পাওয়া যায়। আর এ বিকিকিনির প্রসেসটা অনেকটা ‘এমএলএম কোম্পানি’ স্টাইলে। কেউ একজন কেন্দ্র থেকে টাকার বিনিময়ে দলের জেলা বা অঙ্গসংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি বাগিয়ে নেন। তারপর তিনি সেটা বিক্রি করেন উপজেলা ও পৌর পর্যায়ে। তারা অবার বেচেন ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে। আর অঙ্গসংগঠনের নেতারা বেচেন কেন্দ্রসহ নানা পর্যায়ের পদ। এটা আমার বানানো কথা নয়। বিএনপি নেতা-কর্মীদের অভিযোগ থেকেই এসব তথ্য উঠে এসেছে। অনেকের জিজ্ঞাস্য, এই যে এত সমালোচনা, এত কটাক্ষ, তার পরও কেন বিএনপি নেতৃত্বের চেতনা ফিরছে না, হুঁশ হচ্ছে না। কী এমন চেতনানাশক দাওয়াই তারা গিলেছেন যে, কানের কাছে ‘কাড়া-নাকাড়া’ বাজিয়েও তাদের ঘুম ভাঙানো যাচ্ছে না? সচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থেই বিএনপির উঠে দাঁড়ানো দরকার। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণের সামনে বিকল্প থাকতে হয়। এখন পর্যন্ত বিএনপিই সে বিকল্প। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সচেতন মানুষ এটা বুঝলেও বিএনপি নেতৃত্ব বুঝতে সক্ষম কি না?

                লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর