সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মহীয়সী বেগম ফজিলতুন্নেসা

সৌরেন চক্রবর্তী

অসম্ভব মেধার অধিকারী বেগম ফজিলতুন্নেসা ১৮৯৯ সালে টাঙ্গাইল জেলার (তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা) নামদার কুমল্লী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম ওয়াহেদ আলী খাঁ, মাতা হালিমা খাতুন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ফজিলতুন্নেসা সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম কতটুকুইবা অবগত- সে প্রশ্ন মনে জাগা স্বাভাবিক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী। বাবা মাইনর স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, একই সঙ্গে করটিয়ার জমিদারের সেরেস্তায় চাকরি করতেন। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে নিজ গ্রামে। সেখানকার স্কুলেই শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ছয় বছর বয়সে তিনি করটিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষায় মেয়ের ভালো ফলাফল দেখে পারিবারিক অসচ্ছলতা আর সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ফজিলতুন্নেসাকে শিক্ষার পথে এগিয়ে দেন তাঁর বাবা। মাইনর পাস শেষে সামাজিক ও পারিবারিক বাধা অতিক্রম করে ১৯১৭ সালে ফজিলতুন্নেসাকে ঢাকায় এনে ইডেন স্কুলে ভর্তি করেন। কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের পুরস্কারও পান তিনি। ফজিলতুন্নেসা ১৯২১ সালে ঢাকার ইডেন স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ১৯২৩ সালে ইডেন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯২৫ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে (ডিস্টিংশনসহ) বিএ পাস করেন। তিনি প্রথম মুসলিম ছাত্রী যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২৭ সালে গণিতে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম (গোল্ড মেডালিস্ট) হন। সে কালে গণিতকে বিবেচনা করা হতো ছাত্রীদের জন্য আতঙ্ক হিসেবে। কিন্তু তিনি প্রমাণ করেন যে, মেয়েরা ছেলেদের মতোই গণিতে পারদর্শিতা দেখাতে পারে। কাজেই শিক্ষা কীভাবে নারীদের জীবনকে বদলে দিতে পারে, তিনি ছিলেন তার একটি ব্যতিক্রমধর্মী নজির। উল্লেখ্য তিনি, তাঁর ছোট বোন শফিকুন্নেসাকে নিয়ে ঢাকার দেওয়ানবাজারস্থ ‘হাসিনা মঞ্জিলে’ থেকে পড়াশোনা করতেন। যেকালে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে স্ত্রীশিক্ষা বলতে গেলে প্রচলিত হয়নি, সেইকালে ময়মনসিংহ অঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের, একজন সাধারণ শিক্ষকের কন্যা ফজিলতুন্নেসা শিক্ষাক্ষেত্রে শুধু এগিয়ে আসেননি বরং শিক্ষার স্বাদ নারীদের জীবনকে কীভাবে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিতে পারে তিনি তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

১৯২৮ সালে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক সম্মেলনে ‘নারীজীবনে আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ’ প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন সেকালের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত নারী- ফজিলতুন্নেসা। তাঁর বক্তব্য শুনে এবং তাঁকে দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হন ওই সম্মেলনে উপস্থিত স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। সম্মেলনের পরে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের বাড়িতে, বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত একটি চৌচালা বাংলোতে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে কাছ থেকে দেখতে পান এবং আলাপ-পরিচয় হয়। এ আলাপ-পরিচয় থেকে কবির মনে গভীর অনুরাগ জন্মে, কিন্তু তা খুব বেশিদূর এগোয়নি। কাজী মোতাহার হোসেন এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে ফজিলতুন্নেসার রীতিমতো ঘনিষ্ঠতা ছিল। মোতাহার হোসেনকে তিনি ভাই বলে সম্বে^াধন করতেন, শ্রদ্ধা করতেন। তিনিও ফজিলতুন্নেসাকে খুব স্নেহ করতেন। ফজিলতুন্নেসা সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায়  কাজী মোতাহার  হোসেনের  লেখা থেকে- “ফজিলতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরীও ছিলেন না অথবা বীণানিন্দিত মঞ্জুভাষিণীও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম এ এবং একজন উচুঁদরের বাকপটু মেয়ে।” ১৯২৮ সালে ফজিলতুন্নেসা স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে বিলেতে যান। বিলেত থাকাকালীন খুলনা নিবাসী আহসান উল্লাহর পুত্র শামসুজ্জোহার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৩০ সালে লন্ডন থেকে ফিরে তিনি কলকাতায় প্রথমে স্কুল ইনসেপ্টরের চাকরিতে যোগদান করেন। একই সালের আগস্টে কলকাতার এলবার্ট হলে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলিম সমাজসেবক সংঘের’ বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তাঁর বক্তব্যটি নারীজাগরণের মাইলফলক হয়ে আছে। এ অধিবেশনে তিনি বলেন, ‘নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্ব^ন্ধে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন ও বলেন। নারী সমাজের অর্ধাঙ্গ, সমাজের পূর্ণতা লাভ কোনোদিনই নারীকে বাদ দিয়ে সম্ভব হতে পারে না। সে জন্যই আজ এ সমাজ এতটা পঙ্গু হয়ে পড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘The highest form of society is one in which every man and woman is free to develop his or her individuality and to enrich the society what is more characteristic of himself or herself.’ তিনি ১৯৩৫ সালে বেথুন কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে দীর্ঘদিন সেখানে অধ্যাপনায় রত ছিলেন। দেশবিভাগের পর তিনি ঢাকায় এসে ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ১৯৪৮ সালে। বেগম ফজিলতুন্নেসা ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এর আগেই কোনো মুসলিম নারী অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি- তাই তাঁকে এদেশের প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অধ্যক্ষ হিসেবে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক বিভাগসহ ইডেন কলেজ ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়। ১৯৫২ সালে ইডেন কলেজের ছাত্রীরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কলেজের অভ্যন্তর থেকে মিছিল বের করার প্রস্তুতি নিলে উর্দুভাষী এক দারোগা হোস্টেলে প্রবেশ করে মেয়েদের ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেন। একপর্যায়ে খবর পেয়ে বেগম ফজিলতুন্নেসা কলেজে এসে তাঁর বিনা অনুমতিতে কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশের জন্য দারোগাকে ভর্ৎসনা করে নিজের দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে হোস্টেল ত্যাগ করতে বাধ্য করেন।

তিনি দেখতে ছিলেন সুশ্রী এবং সপ্রতিভ। মনোভাবের দিক দিয়েও তিনি ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক। সেকালেই পর্দা প্রথাকে অগ্রাহ্য করে তিনি পুরুষ সহপাঠীদের সঙ্গেই লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি যে অত্যন্ত আধুনিক ছিলেন তা বোঝা যায় ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে পঠিত তাঁর প্রবন্ধ থেকে। ওই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল তাঁর নিজ অভিজ্ঞতালব্ধ একটি প্রসঙ্গ। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থাকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে অসম সাহস ও উচ্চশিক্ষা লাভের প্রবল আকাক্সক্ষায়, বহুবিধ প্রতিকূলতা সহ্য করে উত্তরসূরি মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করেন তিনি। এ অসামান্য নারী ফজিলতুন্নেসা তাঁর একটি প্রবন্ধে বলেন, ‘যেখানে স্নেহ নেই, মমতা নেই, সম্মান নেই, আছে কেবল পরাধীনতা, অন্যায়-অবিচার, আধুনিক শিক্ষা সেখানে স্বাধীনতা ও পূর্ণ অধিকার জোর করে আদায় করার সাহস দিয়েছে। নারীকে আজ প্রাণ খুলে বলতে শিখিয়েছে, ‘স্বাধীনতা চাই, আত্মার মুক্তি চাই।’ তিনি নিজ উদ্যোগ, কঠোর পরিশ্রম, মুক্তবুদ্ধি ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে তাঁর সমসাময়িক পারিপার্শ্বিকতাকে পরাস্ত করে নিজেকে অনেক ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিলেন। নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি বিষয়ে সওগাতসহ অনেক পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হয়। এ বিদুষী নারী ১৯৭৭ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।   

লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব।

সর্বশেষ খবর