মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোড, ১৯৬৫

মাকিদ হায়দার

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোড, ১৯৬৫

চোখের দুটি পাতা বন্ধ করলে আজও যেন সবকিছু দেখতে পাই। এবং দূরের মানুষগুলো আমার চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। গত শতকের ৬০ দশকের গোড়ার দিকে পাবনা শহরের লাহিড়ীপাড়ায় থাকতেন অ্যাডভোকেট আবদুস সবুর। হলুদ দোতলা বাড়ি। সবুর সাহেবের বাড়িতে এসেছিলেন মওলানা ভাসানী। সবুর সাহেব ছিলেন মওলানা ভাসানীর জামাতা। তাঁর উপস্থিতি উপলক্ষে এবং একটি জনসভা হবে আগামীকাল সে পরিপ্রেক্ষিতে দিনভর হয়েছিল শহরময় মাইকিং। সবাই জানলেন পাবনা শহরের কেন্দ্রস্থল টাউন হল ময়দানে মওলানা ভাসানী জনগণের উদ্দেশে আগামীকাল জনসভা করবেন। আপনারা জনসভায় দলে দলে যোগদান করুন। বক্তৃতা করবেন আরও কয়েকজন তাদের নাম শোনা গেল মাইকিংয়ে।

আমাদের নিচের ক্লাসেই পড়ত ভাসানী সাহেবের নাতি মতিউর রহমান মতি। যদিও সেদিন স্কুল খোলা ছিল এবং আমরা সাত-আট জন মতিকে সঙ্গে নিয়ে দেখতে গেলাম তার নানা মওলানা ভাসানীকে। মতিদের দোতলা বাড়ির নিচতলায় বিশাল কক্ষেই তিনি ও তাঁর সফরসঙ্গীরা অবস্থান করছিলেন। অনুরাগী, অনুসারী ছাড়াও বোধহয় আরও জনাকয়েক ছিলেন। আমরা গিয়ে দেখলাম লাহিড়ীপাড়ার পূর্ব-পশ্চিমের রাস্তার ওপরে সাকল্যে ২০০০ থেকে ২৫০০ ফুট রাস্তার ওপরে লোকারণ্য। আমাদের মতির নানার কাছে যেতে অসুবিধা হলো না। যেহেতু মতি নিজেই আমাদের সঙ্গে নিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়ল অন্য একটি মাঝারি সাইজের ঘরে। যে ঘরটিতে বসে অ্যাডভোকেট সবুর তাঁর মক্কেলদের সঙ্গে মামলা নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। সে ঘরে ঢুকেই দেখি মওলানা সাহেব বসে আছেন একটি চকির ওপর। নিচেই বসে আছেন অনেক মানুষ। এবং চকির ওপরে একটি লোক তালপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। তিনি পান মুখে দেওয়ার আগে মোশাররফ হোসেন নামের এক যুবককে ডেকে বললেন, টাউন হল ময়দানে ঠিক সময়েই যেন সভা শুরু হয়। ঢাকা নাকি রংপুর থেকে যাদু মিয়ার আসার কথা আছে ট্রেনে। ঈশ্বরদী ইস্টিশনে আমাদের লোকজন যেন যাদুকে ঠিকমতো ঈশ্বরদী থেকে সভা শুরুর আগেই নিয়ে আসে। কে যেন বলল হুজুর, ঈশ্বরদীর মোশাররফ সেসব ঠিকঠাক করেই এসেছেন। সেই মোশাররফ হোসেন পাতলা এবং শুকনো হলেও তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই জানালেন সব ব্যবস্থা করেই তিনি এসেছেন। এমন সময় পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ১০-১২ জন ছাত্র এলেন, সঙ্গে ছিলেন নেতা, দন্ত চিকিৎসক ডা. দাক্ষী। আমি ডা. দাক্ষীকে চিনতাম। মাসখানেক আগে তাঁকে দিয়ে আমার ডান চোয়ালের বাঁ মাড়ির একটি পোকা খাওয়া দাঁত তুলেছিলাম। পিতা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দন্ত চিকিৎসালয়ে। আমার দাঁত তোলার আগে একটি ব্যথাহীন ইনজেকশন দিলেন, আমি কিছু একটা বুঝে ওঠার আগেই দাঁতটি তুলে দিয়ে কয়েকটি ল্যাবটেলের নাম লেখা শেষ হলে পিতা জানতে চাইলেন, ডাক্তার সাহেবের ফি কত? ডা. দাক্ষী বললেন, মাত্র পাঁচ টাকা দিলেই হবে। এবং আমাকে বললেন, খোকা, তোমার যদি ব্যথা করে কালকেই চলে আসবে। যেহেতু আমার ব্যথা করেনি, আমি আর তাঁর দাক্ষী দন্ত চিকিৎসালয়ে যাইনি। পাবনা শহরের নতুন ব্রিজের পুব দিকে অনেক মাড়োয়ারির গদিঘর ছিল এবং আলহাজ আকতারুজ্জামান সাহেবের গেঞ্জির একটি বিশাল বিক্রয় কেন্দ্রের পাশেই ছিল ডা. দাক্ষীর চিকিৎসালয়। সেই ডা. দাক্ষী যখন তাঁর দলবল নিয়ে সরাসরি হুজুরের চকির কাছে পৌঁছেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম শুরু করলেন তখন জনসমাগম আগের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় স্থানসংকুলান কঠিন হয়ে দাঁড়াল। অ্যাডভোকেট সবুর সাহেবের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকেই ছিল পাবনা গার্লস হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক অর্চনা গোস্বামীদের লাল দোতলা বাড়িটি। যেটি ‘পুষ্পালয়’ নামেই পরিচিত ছিল শহরের লোকদের কাছে। সে বাড়ির সামনেও ভিড়। লাহিড়ীপাড়ার অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং তাদের অনেকেই পাবনা জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট ছিলেন। তবে লাহিড়ীপাড়ার পশ্চিম প্রান্তে থাকতেন বাণী সিনেমা হলের মালিক মোহাম্মদ ইউনুস। ইউনুস সাহেবকে সবাই ইউনুস বিহারি নামেই চিনতেন। ঠিক সেই বাড়িসংলগ্ন ছিল অ্যাডভোকেট আমজাদ সাহেবের বাড়ি। লাহিড়ীপাড়ার প্রণবেশ সেন এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষে আকাশবাণী কলকাতার কর্মকর্তা হয়েছিলেন। তাঁর অনুজ অধ্যাপক টুনা সেন এখনো লাহিড়ীপাড়াতেই আছেন, অবিবাহিত। লাহিড়ীপাড়ার উল্টো দিকেই গোপালপুর। প্রখ্যাত তবলাটি শৈলেশ সান্যালের বাড়ি, রাজশাহী বেতারের গায়িকা অণিমা রায়দের বাড়ি। গোপালপুর এবং লাহিড়ীপাড়ার মাঝামাঝি রাস্তায় হাজারো মানুষের অধিক ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়েছেন, শুধু মওলানা ভাসানীকে একনজর দেখার জন্য। যেমন আমরা গিয়েছিলাম মতির সঙ্গে। সেদিন স্কুল ছুটির পর আমার দোহারপাড়ায় ফেরা হয়নি। বড় আপার বাড়ি শহরের ফায়ার ব্রিগেড অফিসের উল্টো দিকে হওয়ার সুবাদে আপার বাড়িতে বইখাতা রেখে ভাতমাছ খেয়ে জীবনে প্রথম শুনতে গেলাম মওলানা ভাসানীর ভাষণ। লোকারণ্য এমনকি শহরের সদর হাসপাতালের দোতলায় পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির দোতলায় মানুষ আর মানুষ। তাঁর ভাষণের আগে জনাকয়েক কথা বললেন,  এবং সেই ডা. দাক্ষীও কিছু বললেন। একসময় দেখলাম প্রখ্যাত নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা ও রণেশ মৈত্রকে। এঁরা মঞ্চে উঠেছিলেন কিনা আজ দীর্ঘদিন পরে সে কথা মনে নেই।

মওলানা ভাসানী বক্তৃতা শুরু করতেই জনাকয়েক লোক গোলমাল করার চেষ্টা করেও সফল হলেন না, কেননা এডওয়ার্ড কলেজের প্রচুর ছাত্র উপস্থিত থাকায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় নিমেষেই উধাও হয়ে গেলেন। বক্তৃতার প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মাঝখানে হুজুরের এক অনুসারী তাঁর কানে কী যেন বলায় তিনি উত্তেজিত কণ্ঠেই বললেন, ‘এআইবি সি, আইডি, ডিআইবি পুলিশ আমার ইয়ে করবে। বেচারাদের চাকরিটাই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের পেছনে লেগে থাকা, আমার বিরুদ্ধে যা খুশি রিপোর্ট দিক তাতে আমার ইয়ে হবে।’ উপস্থিত শ্রোতারা প্রবল উৎসাহে হাততালি দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই আর একজন অনুসারী ভাসানী সাহেবকে গিয়ে বললেন, ‘হুজুর পাবনার ম্যাজিস্ট্রেট, ডিসি সাহেব এবং আরও অনেকে জজ কোর্টের দক্ষিণের ইস্টিশন ক্লাবে প্রতিদিন জুয়া খেলে।’ ‘কী বললে!’ হুঙ্কার দিয়ে ‘জুয়া খেলাচ্ছি’ বলেই তাঁর ভাষণ শেষ করে সমবেত উপস্থিত জনতাকে বললেন, ‘চল সবাই আমার সঙ্গে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের জুয়া খেলা আজ আমি ... দেব।’

সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই পাবনা টাউন হল থেকে সামান্য দক্ষিণে জজ কোর্টসংলগ্ন সেই ইস্টিশন ক্লাবের দিকে যাওয়ার আগেই কে বা কারা দৌড়ে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের খবরটা জানাতেই  তাড়াহুড়া কেউ দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামতেই কারও ভাঙল পা এবং দোতলার সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে গিয়ে কারও ভাঙল হাত।

সেই মিটিংয়ে ভাসানী সাহেব সেদিন বলেছিলেন, যত দূর মনে পড়ে, আইয়ুব খান দেশের প্রেসিডেন্ট, যেখানে পাকিস্তানের রাজধানীর নাম করাচি। ঢাকা থেকে করাচির দূরত্ব ১২০০-১৩০০ মাইল, মাঝখানে ভারত। পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তানকে শাসন-শোষণ দুটোই করছে। আরও কিছু বলেছিলেন, মনে নেই আজ। সেই আমার হুজুরকে স্বচক্ষে দেখা। তবে এর কয়েক বছর পরে সম্ভবত ১৯৬৪ সালে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছোট বোন মিস ফাতিমা জিন্নাহ ভোট চাইতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে তাঁকে ঈশ্বরদীতে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন ঈশ্বরদী পাকশী, পার্বতীপুর, সৈয়দপুর ও পাবনা শহরে বসবাসরত উর্দু ভাষাভাষীরা। এবং বিনা বাস ভাড়ার স্কুল, কলেজ ও জনসাধারণকে নিয়ে গিয়েছিল মিস জিন্নাহর সভা উপলক্ষে।

আমরা জনাকয়েক বন্ধু বিনা ভাড়ার যাতায়াতের বাসে ঈশ্বরদীতে গেলেও ওভারব্রিজ অতিক্রম করতে পারিনি। শুধু বিহারি আর বিহারি। বাঙালিও ছিলেন হয়তো কিছু। ফাতিমা জিন্নাহর প্রতীক কী ছিল না জানলেও মাত্র দিন কয়েক আগে বাংলাদেশ প্রতিদিনে সাংবাদিক সুমন পালিতের লেখায় জানতে পারলেম ফাতিমা জিন্নাহ ছিলেন দন্ত চিকিৎসক। এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর বাপ-দাদারা ছিলেন হিন্দু (বাংলাদেশ প্রতিদিন ০৫/১০/২০২০ সোমবার)। ইতিপূর্বে সুমন পালিত জানিয়েছিলেন জিন্নাহর রাজনীতি, প্রেম, যেটি ছিল অসম, বন্ধুর কন্যা রতিবাঈকে জিন্নাহ বিয়ে করেছিলেন বেশ অনেক বয়সে। রতির বয়স ছিল ১৬ বছর মাত্র। এসব তথ্য মি. পালিত না জানালে হয়তো আমি জীবনেও জানতাম না। শুধু জানতাম ফাতিমা জিন্নাহর বোন। মিস জিন্নাহ ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে। স্বভাবতই মিস জিন্নাহকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল করাচি।

আর সেই ১৯৬৪ সালে আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও বাড়ির পেছনের বিশাল পুকুরে চৈত্র-বৈশাখে একাধিকবার গোসল করার ফলে আমাকে ‘টাইফয়েডে’ পেয়ে বসায় সে বছর আর মাধ্যমিক দিতে না পারলেও ’৬৫ সালে যথারীতি মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় এসে আমরা কয় ভাই-বোন থাকতাম ১৪/২ মালিবাগের একটি টিনের বাড়িতে।

অগ্রজ জিয়া হায়দার, রশীদ হায়দার আমাদের দুই ভাই অনুজ দাউদ, জাহিদ, দুই বোন ফরিদা এবং আফরোজাকে পাবনার দোহারপাড়ার গ্রাম থেকে ঢাকায় এনে দাউদ, জাহিদকে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলে এবং ফরিদা, আফরোজাকে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। পরবর্তী বছর ’৬৫ সালে আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই ঢাকায় এসে রেজাল্ট বেরোনোর আগেই থিতু হয়েছিলাম, সেই ১৪/২ মালিবাগের বাসাটিতে মা, পাঁচ ভাই, দুই বোন। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দুই অগ্রজ। পাবনা থেকে পিতা প্রতি মাসেই চাল পাঠাতেন লঞ্চে। নিয়ে আসতাম সদরঘাট থেকে। তখনকার দিনে সমগ্র ঢাকা শহরে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষের বসবাস থাকায় পরিবেশ, গাছপালা, পুরো ঢাকা শহরটাই ছিল সবুজাভ একটি দৃষ্টিনন্দন শহর। ’৬৫ সালেই জগন্নাথ কলেজে অগ্রজ জিয়া হায়দার আমাকে মালিবাগ থেকে ‘মুড়ির টিন’ নামের বাসে মাত্র ৪০ পয়সা ভাড়া দিয়ে সদরঘাটে নামতেই, জগন্নাথ কলেজের ডাকসাইটে অধ্যাপক অজিত গুহর সঙ্গে দেখা হওয়ার সুবাদে তিনিই আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের কাছে নিয়ে গেলেন এবং ওইদিনই ভর্তি হলাম। যখন বের হচ্ছি ঠিক তখনই জিয়া ভাইয়ের পূর্বপরিচিত গল্পকার ঔপন্যাসিক অধ্যাপক শওকত আলীর সঙ্গে দেখা। তিনি শিক্ষার্থীদের কক্ষে নিয়ে গিয়ে চা-বিস্কুট খাইয়েছিলেন, মাসটা ছিল জুলাই, ১৯৬৫।

মালিবাগ মোড় থেকে টিনের বাক্স নামে প্রতি উর্দুভাষী ড্রাইভার, কন্ডাক্টর কলেজ ছাত্রদের কাছ থেকে ২০ নয়া পয়সা ভাড়া নিত সদরঘাট পর্যন্ত। তবে ছাত্রদের ঈঅজউ বা পরিচয়পত্র দেখাতে হতো। বাসস্ট্যান্ড থেকে জনসন স্ট্রিট পার হলেই জগন্নাথ, দূরত্ব ৪০০-৫০০ গজ। সেই ৪০০-৫০০ গজ পেরিয়ে সবে কলেজ গেটে পা দিয়েছি, ঠিক তক্ষুনি বিশাল দেহী এক ছাত্রনেতা (এম এ রেজা) আমাকেসহ আরও দু-তিন জন ছাত্রকে আটকে বললেন, দুই আনা পয়সা দিতে হবে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই নেতা ছাত্রলীগের সদস্য হওয়ার একটি বই বের করে নাম এবং কোন বিভাগের ছাত্র (আর্টস, সায়েন্স, কমার্স) জেনে নিয়ে কাজী আরেফ নামে একজনকে ডেকে বললেন, এই তিনজন ছাত্রলীগের কর্মী। বলতে বলতেই ঈশ্বরদীর কালো চুনু, সম্পর্কে আমাদের আত্মীয়, তাকেও ছাত্রলীগের সদস্য করা হলো। দুই আনা পয়সার বিনিময়ে আমরা সবাই নতুন সদস্য হিসেবে দিন কয়েক পরে শপথ গ্রহণ করলাম- শিক্ষা শান্তি প্রগতি। শপথ পাঠ করালেন রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু নামের ছাত্রলীগের নেতা এবং কলেজ ছাত্র সংসদের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। সভাটি হয়েছিল অবকাশ নামের কলেজ ক্যান্টিনে। আমরা প্রচুর ছাত্রছাত্রী সে সভায় উপস্থিত থাকার প্রধান কারণ ছিল বিনা পয়সায় শিঙ্গাড়া ও চা।

প্রতিদিন বাসে কুড়ি (২০) নয়া পয়সা দেব না ভেবে পিতাকে চিঠি লিখলাম আমাকে একটি সাইকেল কিনে দিতে হবে। তিনি পাবনা থেকে যথারীতি ২০০ টাকা পাঠালেন। ওই টাকা থেকে ১৮০ টাকায় একটি এশিয়া বাইক কিনলাম, নবাবপুরের এক বিহারির দোকান থেকে। তখনকার দিনে ঢাকা শহরে যানজট না থাকায় সেই সাইকেল চালিয়ে শহরের এ প্রান্ত ও প্রান্ত ঘুরে বেড়াতাম। ইতিমধ্যে কলেজে পরিচিতি পেয়েছিলাম দৈনিক সংবাদে ও দৈনিক আজাদে কবিতা লেখার সুবাদে। সহপাঠী কালো চুনু একদিন বলল, আমি আমার সাইকেল নিয়ে, তুই তোর সাইকেলে মাঝে মাঝে ইকবাল হলের ক্যান্টিনে যাব, কলেজ খোলা থাক আর নাই থাক। চুনু থাকত তার বড় ভাই ড. নজরুলের নয়াটোলার একটি বাড়িতে। আমার বাসা আর ওদের বাসার দূরত্ব খুব বেশি না হওয়ায় সুযোগ-সুবিধে পেলেই চলে যেতাম ইকবাল হলের ক্যান্টিনে। সেখানে ছাত্রলীগের বড় বড় নেতা প্রতিদিন সন্ধ্যার আগেই বসতেন। তাঁরা সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শুধু আমি আর চুনু ছিলাম কলেজের ছাত্র। একদিন দেখলাম সেই রেজা ভাই আরেফ, সৈয়দ বাকীকে আমাদের দুজনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং ইকবাল হলের ক্যান্টিনে চা-বিস্কুট খাওয়ালেন রেজা ভাই। ইতিমধ্যে শেখ শহীদুল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা ছোট ভাই, বড় ভাই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছানোর বেশ মাস দুই-তিনেক চারেক পরে নভেম্বরের কোনো এক বিকালে শেখ শহীদ ভাই আমাকে একদিন বললেন, সাইকেলটা থাক। এখানে এক বেয়ারাকে ডেকে বললেন সাইকেলটা দেখে রেখ, একটু পরই আমরা ফিরে আসব। তিনি আমাকে শুধু বললেন, ধানমন্ডি যাব একটি বিশেষ ব্যাপারে। ক্যাম্পাসের সামনেই দাঁড়ানো রিকশায় দুজন উঠতেই শহীদ ভাই বললেন, ধানমন্ডি চল। কেন যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাব, না বলে শুধু বললাম, ধানমন্ডিতে নাকি খুব নামিদামি লোক থাকেন বলে শুনেছি। তিনি আমার দুই অগ্রজ জিয়া হায়দার এবং রশীদ হায়দারের নাম জানলেও অন্য ভাই-বোন সম্পর্কে জানতে চাইলেন। বলতে বলতেই মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি লেকের কোনায় আসতেই শহীদ ভাই বললেন, বামে যেতে হবে, এটি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোড। রিকশাচালক জানালেন আমি ঢাকা শহরে নতুন এসেছি। চালকের কথা শেষ হতে না হতেই শেখ শহীদ একটি দোতলা বাড়ির গেটের সামনে চালককে থামিয়ে দিয়ে আমাকে বললেন, নেমে এসো এবং তিনি চালকের হাতে একটি টাকা দিয়ে বিদায় দিতেই হঠাৎ দেখি দোতলার মূল বারান্দায় একজন ভদ্রলোক গেঞ্জি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি শহীদ ভাইকে দেখে দোতলা থেকে জানালেন, ‘তোরা নিচের রুমে গিয়ে বস, আমি আসছি।’ তখন আমি শহীদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম ওই ভদ্রলোক আপনার কে হন। তিনি জানালেন মামা। দোতলা থেকে অল্পক্ষণ পরই তিনি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে নেমে এলেন, দেখলাম হাতে একটি ধূমপানের পাইপ এবং ভীষণ লম্বা ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। আমি প্রায় ৬ ফুট হলেও তাঁকে মনে হলো অধিক লম্বা। গায়ের রং উজ্জ্বল। শহীদ ভাই আমাকে বাইরে বসার কথা জানান। বারান্দার লম্বা বেঞ্চে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আমাকে সেই সুন্দর সুপুরুষ ডেকে বললেন, ‘বাড়ি কোথায়?’ যথারীতি জানালাম পাবনা শহরে। তিনি তখন বললেন, ‘ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে চিনিস নাকি?’ বললাম মনসুর চাচার ছেলে নাসিম আমার বন্ধু। পরে জানতে চাইলেন, ‘পড়ালেখা কোথায় করিস।’ জানালাম ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘তোদের ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি কে?’ বললাম, ‘রাজিউদ্দিন আহমদ রাজু ভাই।’ তিনি কিছু বলার আগেই শহীদ ভাই জানালেন, ও ছাত্রলীগের কর্মী। কথা শেষ না হতেই দরাজ কণ্ঠের অধিকারী সেই সুপুরুষ আমার বাঁ কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘লেখাপড়া ভালো করে করিস, নয় তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’ তখনো আমি জানি না কার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে বা ভদ্রলোক কে।

তিনি পাইপ হাতে নিয়ে ধরাবার আগে হঠাৎ আমরা শুনতে পেলাম একজন ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর। ভদ্রমহিলা যেন বলছেন, বোধহয় বাড়ির কোনো কাজের মেয়েকেই- ‘এই কবুতর আর মুরগির খাবারগুলো ঠিকমতো দিস।’ ঠিক তখনই শহীদ ভাইয়ের মামা সেই ভদ্রমহিলাকে ডেকে বললেন, ‘রেণু, শহীদ আর এই ছেলেটিকে গোপালগঞ্জ থেকে মা যে পাটালি গুড় আর মুড়ি পাঠিয়েছেন খেতে দাও।’ খাওয়া শেষে যখন তাঁর বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছি তখনই তিনি পুনরায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই যুবকের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘লেখাপড়া ভালো করে করবি।’

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সেই বাড়ির বাইরে এসেই শহীদ ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার মামার নাম তো আমার জানা হলো না।

শহীদ ভাই হেসে জানালেন, ‘কেন! তুমি শোনো নাই শেখ মুজিবুর রহমানের নাম, উনিই তো আমার মামা।’ বললাম শুনেছিলাম, কিন্তু চোখে তো দেখি নাই। আগে জানলে পা দুটি ছুঁয়ে সালাম করতাম। রিকশায় ফেরার পথে আমাদের জাতির জনক সম্পর্কে অনেক কথা হয়েছিল সেদিনের শীতের সন্ধ্যায়।

ইকবাল হলের ক্যান্টিনে ফিরে এসে দেখি আমার এশিয়া বাইক সাইকেলটি ঠিক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে, আমার অপেক্ষায়।

চারিত্র্যপূজা প্রবন্ধে মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে রবিঠাকুরের মন্তব্য- ‘একটি লোক যিনি সত্যকে সকল অবস্থায় মেনেছেন, তাতে আপাতত সুবিধে হোক বা না হোক তার দৃষ্টান্ত আমাদের কাছে মহৎ দৃষ্টান্ত।’ আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মহৎ দৃষ্টান্ত, সমগ্র পৃথিবীর মানুষের কাছে।

 

                           লেখক : কবি।

 

 

সর্বশেষ খবর