বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

খাঁটি সোনা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’

হোসেন আবদুল মান্নান

খাঁটি সোনা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’

লেখা মানে শুরু। শুরুটাই আসল। বড় বড় লেখক ও গল্পকার একটি জুতসই বাক্যের জন্য নাকি দিনের পর দিন অপেক্ষা করেন। যেন গল্পের মুখটি পেয়ে গেলেই হলো। এটি বোঝা যায় বিখ্যাত লেখকদের কালজয়ী উপন্যাসের শুরু দেখলে। ১৮৬৫ সালে রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম মৌলিক বা সার্থক উপন্যাস বলে খ্যাত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’র শুরু- ‘৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারনের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন।’

আমাদের সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর বিখ্যাত ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ শুরু করেন... ‘নীলগন্জ হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরী কমলাপুর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন।’ অদ্বৈত মল্লবর্মণের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি শুরু করেছেন, ‘তিতাস একটি নদীর নাম। তার কুলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস।’ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ৩৫০ পৃষ্ঠার বই। প্রথম প্রকাশ ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ। ১৪০৪ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত এর একাদশ সংস্করণ বের হয়। পুঁথিঘর, ২০৬ বিধান সরণি, কলকাতা-৬ থেকে প্রকাশিত।

এই লেখক সম্পর্কে অনেক আগে আমি নিজেই লিখেছিলাম, ‘অদ্বৈত : জন্মের ঋণশোধ মৃত্যু দিয়ে’ শিরোনাম ব্যবহার করে। লেখাটি আমার প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ ‘অন্তরালে দৃশ্যপট’-এ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মাত্র ৩৭ বছরের আয়ুষ্কালে সমাজের নিম্ন শ্রেণির মানুষের জীবন-জীবিকা, শোষণ-বঞ্চনা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, প্রেম-প্রীতি, জীবনমৃত্যু, বিশ্বপ্রকৃতি, সমাজ-সংস্কৃতির অবিরাম পরিবর্তনের সূক্ষ্ম ও নিবিড়তম বিষয়গুলোকে তাঁর লেখায় অভূতপূর্ব ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন এই জীবনশিল্পী। বলা হয়, ব্রাত্যজীবনের মহাকাব্য ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। উপন্যাসটি প্রথম কলকাতার মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার একপর্যায়ে মূল পান্ডুলিপি হারিয়ে গেলে প্রকাশিতব্য পর্ব বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৫৬ সালে পুঁথিঘর নামে প্রকাশনা সংস্থা উপন্যাসটির পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ করে। এতে কয়েকটি পর্বে উপন্যাসটি সাজানো হয়- প্রবাস খন্ড, নয়া বসত, জন্ম মৃত্যু বিবাহ, রামধনু, রাঙা নাও, দুরঙা প্রজাপতি ইত্যাদি। যদিও তাঁর আরও অনেক গল্প, উপন্যাস, কবিতা সে সময়কার একাধিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন, ‘আজাদ’, ‘নবশক্তি’, ‘মোহাম্মদী’ ও ‘দেশ’ পত্রিকায়। ১৯৩৪ সালে Irving Stone-এর বিখ্যাত Lust for Life   উপন্যাসের ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘জীবন তৃষ্ণা’ নামে অনুবাদ প্রকাশ করে কলকাতায় সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। যদিও ১৯৫১ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে বই আকারে প্রকাশিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ই তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলে। কেবল বাংলা নয়, বিশ্বসাহিত্যের ভুবনে ধ্রুবতারার আসন করে দেয়। এই একটি মাত্র কাজই তাঁর মহৎ জীবন, তাঁর কর্ম এবং তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে মহিমান্বিত করে তোলে। অথচ ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করার পর বহু বিপর্যয় আর ত্যাগ স্বীকার করে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হয়েও কেবল আর্থিক দৈন্য তাঁকে সামনে এগোতে দেয়নি। ভাগ্যের অন্বেষণ, কঠিন দারিদ্র্য ও নিয়তিই তাঁকে নিয়ে আসে কলকাতা শহরে।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কেবল আমাদের সাহিত্যে নয়, পৃথিবীর যে কোনো ভাষার মহৎ সাহিত্যসম্ভারের সমতুল্য। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কল্পনা বর্ধন এর ইংরেজি অনুবাদ করেন A River Called Titas নামে। খ্যাতিমান প্রকাশনী সংস্থা Penguin ১৯৯২ সালে তা প্রকাশ করে। দুনিয়ার নানা ভাষায় এর অনুবাদ হয়েছে। নাট্যরূপ দিয়েছেন উৎপল দত্ত আর চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক। যা তাঁকে জনপ্রিয়তার উচ্চশিখরে ওঠায়। জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও নাটকের সংলাপ রচনা করে প্রদর্শন করা হয়েছে নানা সময়ে।

উপন্যাসে শুধু সার্থক চরিত্র রূপায়ণই করেননি, তিনি নিজের জীবনের অংশ থেকে নিয়ে নিখুঁত শব্দে গেঁথেছেন কারুকাজ-সংবলিত এক মুক্তোর মালা। তিতাস নদীর তীরে বসবাসকারী মৎস্যজীবী মালো সম্প্রদায়ের সুখ-দুঃখের গল্প তথা জীবন সংস্কৃতির বারমাস্যা তুলে ধরা হয়েছে এতে। অদ্বৈত তাঁর লেখায় অবলীলায় তুলে ধরেন, ‘জমিদার সত্য নয় বলিয়াই তারা সংখ্যায় কম। মানুষের মধ্যে তারা ব্যতিক্রম। রায়তরাই সত্য। তাই ঘুরিয়া ফিরিয়া মাটির মালিক হয় তারাই। কাগজপত্রে মালিক নয়, বাস করার মালিক। সেই রূপ তিতাসের মালিকও জেলেরা।’ তিনি গল্পে আরও বলেছেন, সুবলের বাবা গগন মালো, তার নিজের জাল নেই। সারাজীবন কেটেছে পরের জাল বেয়ে। তাতে সংসারের দারিদ্র্য ঘোচেনি।’

অদ্বৈত লিখেছেন, বড়লোক জগতবাবু আনন্দবাবুরা ‘মালোদের ঘরে নেয় না, মালোরা কোন জিনিস ছুঁইলে সে জিনিস তারা অপবিত্র মনে করে। পূজা-পার্বণে মালোরা তাদের বাড়ির প্রসাদ খাইলে এঁটো পাতা নিজে ফেলিয়া আসিতে হয়। সে পাতা ওরা ছোঁয় না, জাত যাইবে। এরা মালোদের কত ঘৃণা করে। মালোরা লেখাপড়া জানে না, কিন্তু তাই বলিয়া তারা ছোঁয়ারও অযোগ্য? মালোরা মালো বলিয়া কি মানুষ নহে?’ লেখকের এমন মর্মস্পর্শী বাণীতে স্বগোত্রীয় জ্ঞাতিগোষ্ঠীর আজন্ম বেদনার চিত্রই কেবল ফুটে ওঠে না এতে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের এক বাস্তব দৃশ্যও চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আজও ‘আনন্দ বাজার’ ও ‘জগৎ বাজার’ নামে দুটো বাজারের সরব অস্তিত্ব রয়েছে।

লেখক জীবদ্দশায় তাঁর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছড়িয়ে পড়া দেখে যেতে পারেননি। তবে তাঁর অকালপ্রয়াণের ৬৯ বছর পর আজও বাংলা ভাষা ও ভাষাতত্ত্বের গবেষণায় বা সাহিত্য-সংস্কৃতির নানাবিধ পর্যালোচনায় অদ্বৈতের সরব উপস্থিতি সবাইকে নিয়ত জানান দেয় যে, অমরত্বের জন্য দীর্ঘায়ু পাওয়া জরুরি নয়।

তাঁকে নিয়ে দুই বাংলায় অসংখ্য লেখক, গবেষক বিচিত্র সব শিরোনাম দিয়ে আলোকপাত করেছেন।

এমন কয়েকটি শিরোনাম উল্লেখ করা যায়- নদী ও মানুষের যুগলবন্দী, তিতাসের অদ্বৈত : শেকড়ের সন্ধান, অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস ও ব্রাত্যজীবন, জলজ সত্তা : অদ্বৈত ও তাঁর তিতাস, তিতাস একটি নদীর নাম : ব্রাত্য জীবনের মহাকাব্য, বিশ্বে নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস ও তিতাস একটি নদীর নাম, তিতাসের পাড় ধরে অদ্বৈতের সঙ্গে, অবদমিতের ভাষা ও অদ্বৈত মল্লবর্মণ, অদ্বৈতের তিতাস ও তিতাসের ঋত্বিক, তিতাস একটি নদীর নাম : সমাজ সংস্কৃতি অর্থনীতি ইত্যাদি। এমন লেখালেখি, আলোচনা, গবেষণা ও জীবনবোধের বিশুদ্ধ চর্চা সচরাচর হয় না। শতাব্দীতে দু-চার জন। তিরিশের দশকের ভাষাচর্চা, সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের ভুবনে তাঁর বিচরণ ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। দারিদ্র্যের কলঙ্কতিলক ললাটে ধারণ করে ক্রমাগত ক্ষয়ে যেতে যেতে একদিন কালের অতল গহ্বরে তলিয়ে যান বিস্ময়কর এ জাতশিল্পী।

তাঁর এমন অকালমৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়ে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর স্রষ্টা প্রখ্যাত বিমল মিত্রের তাৎক্ষণিক মন্তব্যটি তুলে দেওয়া হলো- ‘একটা মর্মান্তিক দুঃসংবাদ শুনে আমার নিজের দুর্ভাগ্যও তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল। শুনলাম অদ্বৈত মল্লবর্মণ আর নেই। সেই ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর লেখক। অনেক আর্থিক দুর্গতি আর অনুগত গলগ্রহদের বোঝা শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচতে দেয়নি।

বুঝলাম অদ্বৈতবাবু হয়তো গেলেন, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের একটি অক্ষয় স্বাক্ষর তিনি রেখে গেলেন তাঁর, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে। সাহিত্যের বিচারে কোনটা গিলটি আর কোনটা খাঁটি সোনা? তা বেশির ভাগ পাঠকের কাছেই লেখকের জীবদ্দশায় ধরা পড়ে না, ধরা পড়ে আখেরে, আজ এতকাল পরে ধরা পড়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সত্যিই ছিল খাঁটি সোনা।’

বিমল মিত্র, ১ নম্ব^র বর্মণ স্ট্রিট, ‘দেশ’ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৮১।

                লেখক : গবেষক ও গল্পকার।

সর্বশেষ খবর