মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্য সুরক্ষার দায়িত্ব নিজের

ডা. অভিষেক ভদ্র

স্বাস্থ্য সুরক্ষার দায়িত্ব নিজের

গত কয়েক দিন ধরে দেশের করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। শীতের প্রকোপ শুরু হওয়া,

স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে জনগণের উদাসীনতা- এ রকম নানাবিধ কারণে করোনা সংক্রমণের গতি বাড়ছে এবং ফল হিসেবে মৃত্যুর হার বাড়বে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদ ধারণা করছেন। বিশ্বের অনেক দেশেই করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ বা ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ শুরু হয়েছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন করে সংক্রমণের গতি বৃদ্ধি হওয়াকে দ্বিতীয় ঢেউ বলা যাবে কিনা তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। তবে করোনার প্রথম এর ধারাবাহিকতা হোক কিংবা নতুন করে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হোক, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাথা না ঘামিয়ে নিজের করণীয় কাজগুলোর প্রতি যত্নশীল হওয়াই সবার প্রধান দায়িত্ব। কারণ একবার সংক্রমিত হয়ে গেলে প্রশাসন কিংবা অন্য কারোর ওপর দোষ চাপিয়ে কোনো লাভ নেই, যা ক্ষতি হওয়ার তা কিন্তু নিজেরই হবে।

করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন গবেষণা ও হাসপাতালের প্রকৃত চিত্রে দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তি আগে থেকেই বিভিন্ন রোগ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি, লিভার, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত তাদের করোনাজনিত জটিলতা হওয়ার হার এবং মৃত্যুর হার অনেক। সুতরাং আমাদের পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের প্রতি বেশি যত্নশীল হতে হবে, এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না।

করোনায় একজন মানুষ দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হতে পারেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে বিশদ বৈজ্ঞানিক বিতর্ক। তবে আমাদের দেশের অনেকে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছেন (যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক) এমন তথ্য চিকিৎসকদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। তবে আশঙ্কার বিষয়, যারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছেন তাদের অবস্থা প্রথমবারের চেয়ে জটিলতর হয়েছে। সুতরাং একবার করোনা জয় করেছেন যারা তাদেরও স্বাস্থ্যবিধি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ইতিমধ্যে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও মানুষের হাতে তা পৌঁছে দেওয়ার বেশ কয়েকটি আশাপ্রদ খবর আমরা পেতে শুরু করেছি। আমাদের দেশও টিকা সংগ্রহে নানা দেনদরবার শুরু করছে। কিন্তু কথা হলো এ টিকা এখনো পুরোপুরিভাবে মানুষের হাতে পৌঁছতে বেশ সময় লাগবে। তা ছাড়া সাধারণ মানুষ শুরুতেই কিন্তু টিকা পাবে না। কারণ যারা স্বাস্থ্যকর্মী, ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা, বয়স্ক, যাদের করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি তাদেরই গুরুত্বের ভিত্তিতে এ টিকা প্রথম পর্যায়ে নিশ্চিত করা হবে। সুতরাং সাধারণ মানুষের জন্য কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই একমাত্র পন্থা এবং জীবনের রক্ষাকবচ।

করোনা প্রতিরোধে মাস্ক পরার কোনো বিকল্প নেই। মাস্ককে বলা হচ্ছে করোনার ‘বিকল্প ভ্যাকসিন’। শুধু মাস্ক পরে প্রায় ৮০ শতাংশের ওপর সংক্রমণ কমানো সম্ভব। তবে সঠিকভাবে মাস্ক পরার ব্যাপারে যথাযথ দৃষ্টি দিতে হবে। অবশ্যই ভালোভাবে নাক-মুখ ঢাকতে হবে। শুধু মুখে-নাকে কিংবা থুতনিতে মাস্ক পরলে কোনো লাভ হবে না।

নিয়মিত বারবার সাবান-পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড হাত জীবাণুমুক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বারবার হাত ধোয়া সম্ভব না হলে অন্তত নাকে, মুখে ও চোখে হাত দেওয়ার আগে হাত ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।

পারতপক্ষে এখন আবার ঘরের বাইরে বের হওয়া বন্ধ করতে হবে। যদি বাইরে যেতেই হয় তাহলে ঘরের বাইরে অন্য মানুষের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব (অন্তত ৩ ফুট) বজায় রাখতে হবে।

করোনার সময় বয়স্ক ব্যক্তি এবং যারা অন্যান্য রোগ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, শ্বাসতন্ত্র, কিডনি বা লিভারের রোগ, স্ট্রোক বা অন্যান্য জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত তারা সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন। তাই এসব মানুষের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বাইরে না যেতে দেওয়াই ভালো। পরিবারের বাকিদের এসব প্রবীণের স্বাস্থ্যের হতে হবে সর্বোচ্চ সতর্ক।

শীতে আমাদের দেশে এমনিতে ঘোরাঘুরি, নানা উৎসব, অনুষ্ঠান যেমন বিয়েশাদি, সাংস্কৃতিক কাজকর্মসহ গণজমায়েত বেড়ে যায়। কিন্তু এবার শীতে যে কোনো রকম জনসমাগম, উৎসব, অনুষ্ঠান, ভিড় এড়িয়ে চলুন। উৎসব অনুষ্ঠান যদি করতেই হয়, তবে সীমিত পরিসরে অল্পসংখ্যক মানুষ নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে করুন।

অসুস্থ বোধ করলে জ্বর, কাশি বা গলা ব্যথা, স্বাদহীনতা দেখা দিলে উপসর্গ যত মৃদুই হোক, নিজেকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলুন। পরীক্ষা না করা বা চিকিৎসকের পরামর্শ না নেওয়া পর্যন্ত বের হবেন না। এ সময় বাড়ির সবার কাছ থেকেও দূরে থাকুন। অনেকেরই মৃদু উপসর্গ হচ্ছে, আর তা নিয়েই সবাই বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যা অন্যদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

শিশুদের নিয়ে অকারণে বাইরে যাবেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ। সেটা শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেই করা। তাই বলে তাদের নিয়ে সমুদ্রসৈকত, রিসোর্ট বা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ঘুরে বেড়ানো উচিত নয়। শিশুরা নীরব বাহক হিসেবে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়াতে পারে। তাই সতর্ক থাকতে হবে।

অধিক তথ্যে বিভ্রান্ত হবেন না, করোনা নিয়ে অনেক বেশি দুশ্চিন্তা বা বিচার-বিশ্লেষণেরও দরকার নেই। যত কষ্টই হোক শুধু তিনটি স্বাস্থ্যবিধি মানুন (মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা), নিজেকে বাঁচান, পরিবারকে বাঁচান, দেশের মানুষকে করোনা থেকে রক্ষা করুন।

প্রভাষক, পপুলার মেডিকেল

কলেজ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর