বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সিডর ও আইলার বিরুদ্ধে রিট

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সিডর ও আইলার বিরুদ্ধে রিট

[মে এবং নভেম্বর এ দুটি মাস বাংলাদেশের উপকূলে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের হানা দেওয়ার মৌসুম। ১৯৬০ সালের ১৪ মে,  ’৭০ সালের ১২ নভেম্বর গোর্কি, ২০০৭  সালের ১৬ নভেম্বর সিডর, ২০০৯ সালের ১৫ মে আইলার আক্রমণ সবই এখনো দারুণ দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। সাম্প্রতিককালের সালতামামিতে সিডর ও আইলা বহুল উচ্চারিত। এ দুটি ঘূর্ণিঝড় নিয়ে সুন্দরবনে বসবাসকারী প্রাণী বৈচিত্র্যের পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে রসরচনায় তা তুলে ধরা হলো।]

ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার বিরুদ্ধে রিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুন্দরবনের বাবাহকু (বাংলাদেশ বাঘ হরিণ ও কুমির) ফেডারেশনের আইন ও নিবর্তন নিরোধসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। আজ সুন্দরবনের কচিখালিতে বাবাহকুর কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার মন্ত্রকের মুখপাত্র মলিশা মঞ্জিলা সাংবাদিকদের এ কথা জানান। মলিশার সংবাদ সম্মেলনের সূত্র ধরে বার্তা সংস্থা উবিসস ( উড়ো বিভ্রান্তকর সংশয় সন্দেহ) প্রেরিত বাতাস বার্তায় জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বাবাহকুর উচ্চ পরিষদ ‘বনে জঙ্গলে’ বিরোধীদলীয় সদস্যদের আনা এক মোশন প্রস্তাবের ওপর তীব্র ও প্রখর আলোচনার একপর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় সুন্দরবনের প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিতে এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশে ফেটে পড়েন পক্ষ-বিপক্ষের সবাই। সবার সম্মিলিত দাবির মুখে খোদ সিডর ও আইলার বিরুদ্ধেই শালিসি ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর সুবিদখালীর বর্ষীয়ান সদস্য, পাখি পাখালি গোত্রের নেতা শঙ্খশালিয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে গৃহীত হওয়ার পর উচ্চ পরিষদ অধ্যক্ষ শিয়ালেন্দু মামাইয়া তার রুলিংয়ে বলেন, শালিস বিভাগ নিজের উদ্যোগে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে না গেলে বাবাহকুর পক্ষে কোনো কমিটি রিট পিটিশনটি দাখিল করতে পারে। ফেডারেশনের পরিচালনায় থাকায় বাবাহকুর  নিজে এ-জাতীয় মামলা দায়েরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা এর সঙ্গে ঘরে বাইরের সম্পর্ক সংস্থাপনসংক্রান্ত স্পর্শকাতর বিষয়াদির যোগসূত্র রয়েছে।

সিডর ও আইলা এসেছে বাইরে থেকে, তাদের অভ্যন্তরীণ আইনের আওতায় শালিসে সোপর্দ করা যুক্তিযুক্ত হবে কিনা এ ব্যাপারে সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করেন বাবাহকুর আইন ও শালিস উপদেষ্টা বানরিয়া বাচাবন। অবশ্য বানরিয়া বাচাবনের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বিরোধী পক্ষের বিচার শালিস বিশেষজ্ঞ ময়নামন্দা। ময়নামন্দার মতে যেখান থেকেই আসুক না কেন বাতাস যেখানে যার ঘর ভেঙেছে সেখানেই তার হতে হবে বিচার। তিনি মেকং বনে বাঘ সম্প্রদায়ের সুখ্যাতির সর্বনাশ সাধনে দূর দ্বীপবাসী তক্ষক ও ভক্ষকদের বিরুদ্ধে দেওয়া একটি ঐতিহাসিক রায়ের কথা উল্লেখ করেন। উচ্চ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবটি আজ সকালে বাবাহকু প্রেসিডিয়ামের প্রেসিডেন্ট সুন্দরমিয়ার সানুগ্রহ সম্মতি লাভ করলে রিট দায়েরের জন্য বাবাহকুর আইন ও নিবর্তন নিরোধ কমিটিকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। আগামীকাল শালিসালয় বন্ধ থাকায় পরশু এটি দাখিল হতে পারে বলে মঞ্জিলা সংবাদ ব্রিফিংয়ে আভাস দেন।

এদিকে দুবলার চর থেকে শালিসালয়সূত্রে সাংবাদিকরা জানিয়েছেন সিডর ও আইলার বিরুদ্ধে শালিসালয় থেকে স্বউদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রাজ্ঞ প-িতপ্রবরেরা। তবে তাদের ধারণা, সব ব্যাপারে স্বউদ্যোগে অভিযোগ দায়েরে সংশ্লিষ্ট হতে গেলে শালিসে মনোযোগে সময় কমে যেতে পারে এবং শালিসজীবীরাও এর মধ্যে তাদের মনঃক্ষুণœ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করতে পারেন। পরশু শালিসজীবীদের পলিটব্যুরোয় এতদ্বিষয়ক এক আলোচনায় এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রাথমিক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে সংবাদসংস্থা ‘বৈরী বাতাস ডট কম’ পরিবেশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৭ সালের নভেম্বরের শুরুর দিনগুলোয় শ্রীলঙ্কার অদূরে ভারত সাগরে ‘সিডর’ ( সিংহলি ভাষায় যার অর্থ চোখ) নামক নি¤œচাপটি প্রথম নয়ন মেলে। জলবায়ু ও আবহাওয়া সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা সেবারকার সুকোমল মল্লিকাবনের নি¤œচাপটিকে কলি ফুটে  ঘূর্ণিঝড়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার সিডর নাম বরাদ্দ করে বসে। সিডর বংশে ও মেজাজে বড্ড একরোখা । লক্ষভেদী তার পদচারণ। হিংস্র তার চাউনি। কানকথা শোনা তার স্বভাব। অনেক আগে থেকেই সে যেন জানে বিশ্বের সেরা গহিন গরান বন অনেক লোকালয়কে নানান ঝড়ঝাপটা থেকে বাঁচাতে নিজে মাথা পেতে নেয় সব ধাক্কা। সিডরের রক্তে প্রতিশোধের আগুন। তার এজেন্ডায় এবার আসে সেই গহিন গরান বন। সঙ্গে সে সুবাদে গহিন গরান বনের দেশটির অর্থনীতিকে ধাক্কা দেওয়াটাও তার পরিকল্পনার ফ্রেমে ঢুকে পড়ে। সিডর জানতে পারে কৃষিপ্রধান দেশটির অন্যতম ফসল আমন ধান। সেবার পরপর দুটি বড় বন্যায় নাকি দেশটির প্রায় ৬৫ শতাংশ এলাকার আমন ধান উৎপাদনের সব প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত। সে দেশের এক টিভি চ্যানেল নাম তার ‘আই’ যার মানে আমি, কিন্ত লোগোতে দেখায় ‘চোখ’ (সিডরের প্রতিশব্দ হলেও এ ‘চোখ’ জ্ঞানের, দর্শনের, জানা  ও জানানোর প্রতীক), সে চ্যানেলে বড় বড় পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞ এক কৃষিবিশারদ সাহেব বন্যার পানিতে নিজে হেঁটে হেঁটে দেখিয়েছেন কীভাবে পুনরায় রোপিত ধান গাছগুলোর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে দ্বিতীয় বন্যায়। সিডরকে সেই ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়। মুচকি হাসে সিডর। জানতে চায়,

‘এ অবস্থা গোটা দেশে কিনা?’

তাকে বলা হয় , ‘এমন অবস্থা ৬৫ ভাগ অঞ্চলের যেখানে ছোট বড় মাঝারি নদ-নদীগুলোর দুই কূল ছাপিয়ে প্রায় বন্যা আসে যায়, কিন্তু দেশের বাদবাকি ৩৫ ভাগে মূলত সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাসমূহে এভাবে বন্যা হয় না।’

সুন্দরবন আর সাগরের তীরবর্তী জেলার চর ও সমতল ভূমিতে আমন ধান এখন পর্যন্ত অক্ষত আছে সিডর প্রতিবেদন দেখে বুঝতে পারে। তার মাথায় ভয়ানক দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়। ‘এসব এলাকার সেই ধানের বর্তমান অবস্থা কী?’

তাকে জানানো হয়, ‘আগামী দুই তিন সপ্তাহের মধ্যে ধান পেকে উঠবে।’

কূটবুদ্ধিসম্পন্ন পক্বকেশ পলিসিবাজদের মতো সিডর এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের স্বপ্ন দেখে। সে সিদ্ধান্ত নেয় তার উৎপত্তিস্থল থেকে দেশটির দূরত্ব যা তাতে ঘণ্টায় মোটামুটি  ৬০-৬৫ মাইল বেগে এগোলে ১৫ নভেম্বরের দিকে দেশটির গহিন গরান বনের পূর্ব প্রান্ত দিয়ে আক্রমণ শানালে বনটির বারো বাজানো এবং উপকূলবর্তী জেলাগুলোর কাঁচা-পাকা ধানের উচ্চমার্গের সর্বনাশ সাধনের সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হবে। সিডর উপলব্ধি করে  বনটির ওপর সরাসরি আক্রমণ করলে সে কিছুক্ষণের মধ্যে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে; তা ছাড়া বন ভেদ করে ধান খেত অবধি যাওয়া সহজ হবে না। তার ঘিলুতে ধরে যে এ কারণে বনের পূর্ব প্রান্ত দিয়ে গেলে বনও উজাড় হবে আবার বিস্তীর্ণ শষ্য খেতকে পাওয়া যাবে সামনে। ১৫ তারিখ মোক্ষম সময় এ জন্য যে ২০-২২ তারিখের মধ্যে পাকা ধান ঘরে তোলার সময় ও সুযোগ যাতে না আসে। ১৫ তারিখে কাঁচা-পাকা ধান গাছকে ধরাশায়ী করার জন্য উপযুক্ত অবস্থায় পাওয়া যাবে। আরজিতে উল্লেখ করা হয়েছে সিডর অত্যন্ত ঠা-া মাথায়, সুপরিকল্পিতভাবে গরান বন এবং সে দেশের প্রধান শস্যের অবশিষ্ট সম্বলকে শেষ করে ওই বছরটিতে গোটা অর্থনীতিকে খাদ্য সংকটে ফেলার ষড়যন্ত্র করে। এটি মানবতা ও প্রকৃতি বিরোধী অমার্জনীয় ও অনপনেয় অপরাধ এবং অন্যায়।

সিডরের পরিকল্পনা শানিত ও সপ্রতিভ তবে বেশ প্যাঁচানো এর গ্রন্থি। সিডরের চোখ ট্যারা, বোঝা যায় না সে কোন দিকে তাকাচ্ছে। তার চাউনি দেখে আবহাওয়া দফতর তার গতিবিধি আঁচ করতে গিয়ে রীতিমতো ফাঁপরে পড়ে যায়। বেশ সুকৌশলে সে এগোতে থাকে, কখনো একটু দ্রুত এগোয়, আবার কখনো ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এর ফলে ক্রিকেটে স্পিনারের মতো ঢেউ খেলানো বার্তা পৌঁছায় আবহাওয়া দফতরের ডিজিটাল পর্দায়। ভালো করে যেমন ঠাওর করতে পারে না পুষ্টিহীনতায় ভোগা ব্যাটসম্যান, আবহাওয়া দফতরের ভারপ্রাপ্তরা তেমন যেন  বিশেষভাবে অজ্ঞতার ভান করে থাকে, সব সময় ‘হতে পারে’ জাতীয় হেঁয়ালি ‘বার্তা’র ব্যাট করে। খোদ মার্কিন মুলুক থেকে বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরে বসে পিরোজপুরের পুখুরিয়া গ্রামের  বড় ভাই পিলু তার ভাই মিলুকে ফোন করেন রাত সাড়ে ৯টায়। বলেন, ‘ব্যাটা সিডর এখন কিন্তু হরিণঘাটা বলেশ্বরের মোহনা দিয়ে ওপরের দিকে এগোচ্ছে বেশ প্রচ- শক্তি নিয়ে’, তাদের বহুদিনের স্মৃতিঘেরা কাঠের দোতলা বাড়িটি ‘এখনো  ঠিক আছে তো?’ মিলু ঝড়ের ঝাপটায় ভালো শুনতে পারেন না, তবে আশ্চর্য হন হাজার হাজার মাইল দূর থেকে, বলতে গেলে সাত সমুদ্দুর আর তের নদীর ওপার থেকে তার বড় ভাই সিডরের গতিবিধি জানাতে পারছেন আর তাদের আবহাওয়া দফতর দেশব্যাপী ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষনা দিয়ে খালাস! সিডর এসব সীমাদ্ধতার কথা জানে তাই সে তার মতো অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাঁ পাশের সুন্দরবন দাবড়িয়ে মাড়িয়ে ডান পাশের সব দ্বীপ সমতল সবই তোলপাড় করে পিরোজপুরের সন্ধ্যা ও কচা নদী অবধি এসে পৌঁছায় রাত ১১টার দিকে, তার হিংস্র চোখ দিয়ে তখনো আগুনের গোলা বের হচ্ছে, যেখানে পড়ছে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, বড় বড় গাছ ধরাশায়ী করে, ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে সে তার ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। হুলারহাটের কাছে এসে সে তার নীলনকশায় চোখ রাখল, হ্যাঁ, তার পরিকল্পনামতো কাজ হচ্ছে। তবে সে একটু ভাবল এখন যে ডিরেকশনে আছে সে এভাবে এগোলে দেশের খোদ রাজধানী তার সরাসরি টার্গেটে পড়ে, যেখানে দেশের নিয়ন্ত্রকরা থাকেন সেখানে এভাবে আক্রমণ করাটা কেন জানি তার মনে হলো ঠিক হবে না, সেখানে মাত্র ১১ মাস বয়সী এক নির্দলীয় কর্তৃপক্ষ, তাদেরও বেসামাল করে ফেললে পরে উদ্ধারকাজ চালাবার বা নিয়ন্ত্রণ করার কেউ থাকবে না। এমনকি তার এ অভিযানের কাহিনি নিয়ে যারা নকশা গল্প সচিত্র প্রতিবেদন ইতিহাস নির্মাণ করবেন তারাও যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন তাহলে সেটা শোভনীয় ও সমীচীন হবে না। সিডর ভাবল তার গতিপথ একটু পরিবর্তন করে রাজধানীকে পাশ কাটিয়ে গেলে কেমন হয়। রাত পৌনে ১২টার সময় কাউখালী স্টিমারঘাটের কাছে থাকা তার সেকেন্ড লেফটেন্যান্টকে সে ডিরেকশন ১ ডিগ্রি পূর্বমুখী হেলাতে নির্দেশ দিল।  ইতিমধ্যে মূল ভূখ-ে এসে তার আক্রমণের তীব্রতা একটু কমে এসেছে। নতুন ডিরেকশন অনুযায়ী বরিশালের উজিরপুর, মুলাদী, শরীয়তপুরের গোসাইরহাট হয়ে চাঁদপুরের দিকে সে ছুটে চলে সেখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ পার হয়ে আসাম অবধি গিয়ে তার অভিযান শেষ হয়। সুন্দরবনের লাখ লাখ গাছ, লোকালয়ের শত সহস্র ঘরবাড়ি গাছগাছালি সব শেষ করে লাখো কোটি মানুষকে পানিবন্দী করে, অসংখ্য প্রাণী ও পশু সম্পদের সর্বনাশ সাধন করে সিডর প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণিসম্পদের, ফলফসলের, জীবন ও জীবিকার যে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে আরজিতে তার প্রতিকার প্রার্থনা করা হয়েছে, সঙ্গে যেসব কারণে সিডরের সৃষ্টি সেসব অনুসন্ধান-উত্তর তা নিরোধকল্পে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

অন্য আসামি আইলার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিবরণীটি সিভিনিউজ ডট ৪৮ মিডিয়ার জন্য উন্মুক্ত করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের মে মাসে আইলা ঘাপটি মেরে থাকা আপসহীন মনোভাব নিয়ে অতর্কিত আক্রমণে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় অবর্ণনীয় দুর্যোগ এবং দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগের কারণ সৃষ্টি করে। আইলা দুই দেশের সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল কালিন্দির মোহনা দিয়ে উঠে এসে ব্যাপক জলোচ্ছ্বাস ঘটায়, ফলে উভয় পারের সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাতি হয় আর সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ের নি¤œাঞ্চল হঠাৎ প্লাবনের পানিতে তলিয়ে যায়। পরে সেখানে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি হয় জনবসতিতে, কৃষি খেতে, মাছ চাষে। মুহূর্তের মধ্যে সহায়সম্বল ও গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। সুন্দরবনের মধ্যে সৃষ্ট বীভৎসকর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বাবাহকুর তথ্য বিভাগের প্রধান হরিণা হাপানের সে সময়কার বিবৃতিটি এক্সিবিট আকারে আরজির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। হরিণা আইলায় সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের জন্য তাক্ষণাৎ বড় ক্ষতি সম্পর্কে সে সময় বলেছিল,

‘এবারের বানে [আইলায়]  আমরা বেশি সমস্যায় পড়েছি খাবার পানি নিয়ে। বাদার মধ্যে  যে কয়টা পুকুর আছে আমরা দলবেঁধে সেখানকার পানি খেতাম। নোনা পানি আমরা তেমন খেতে পারি না। এসব পুকুরে আমাদের জন্য মিষ্টি পানির ব্যবস্থা ছিল কিন্তু এবারের বানে এসব পুকুর তলিয়ে গিয়ে নোনা পানিতে ভরে গেছে। এখনকার ছিটেফোঁটা বৃষ্টির পানি এ নোনা পানিকে মিষ্টি করতে পারছে না। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। দুবলার চরে অনেক বন্দুকওয়ালা সেই লোকটা বড় পাড় বাঁধা পুকুর কেটে কি উপকারটা না করেছিলেন; এবার সে পুকুর ডোবেনি। ওখানে আমাদের যারা আছে তারা সে পানি পাচ্ছে। আমাদের এখান থেকে তা অনেক দূর। ও রকম পাড় বাঁধা পুকুর কাটলে খুব কাজে লাগত।  আর বর্তমানের  এসব পুকুরের নোনা পানি সেচে বের করে দিয়ে বৃষ্টির মিষ্টি পানি ধরবার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হতো।’

আইলায় সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হরিণা হাপান তখন জানিয়েছিলেন, ‘আমরা প্রকৃতির কোলেই আছি। এ-জাতীয় বান আমরা প্রায়ই মোকাবিলা করি। আমাদের নিজস্ব একটা নিয়ন্ত্রণ বা আত্মরক্ষার ব্যবস্থা আছে। তবে এবারের বানটা এসেছে হঠাৎ, আমরা বুঝে সারতে পারিনি। পানি এসেছে অচমকা ও অনেক পরিমাণে ফলে অনেকে সময়মতো উঁচু জায়গায় যাওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় আমাদের অনেকেই মারা পড়েছেন। জোয়ারের সময় জলোচ্ছ্বাস হওয়ায় এমনটি হয়েছে, সচরাচর ভাটার সময় বান আসে।’

আইলার বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ সে পূর্ণিমার ভরা জোয়ারের সময় আঘাত হানে। এর ফলে পানির পরিমাণ ও স্রোতের তোড় বেশি হওয়ায় বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে সবকিছু  ডুবে যায় হঠাৎই।

আরজিতে স্থানীয় জনগণের জীবনে নেমে আসা দুর্গতির বর্ণনায় বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আইলায় পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, শমসেরনগর আর বাংলাদেশের সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি আর খুলনার দাকোপ ও কয়রার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে আজ দারুণ অসহায় অবস্থায়। শ্যামনগরের  গাবুরা ইউনিয়নের হরিচরণ মন্ডল মোটামুটি অবস্থাপন্ন। তার দুটো ১০ একরি মাছের ঘের, ৫০ বিঘে ভালো ধানি জমি, গোলাভরা ধান আর আটচালা ঘর উঠোন দহলিজ সবই এখন থইথই পানির নিচে। মেয়েটা শ্যামনগর কলেজে পড়ে, এবার  আইএ পরীক্ষা দেবে, টুংগী পুর শ্বশুরবাড়িতে পরিবার পাঠিয়ে দিয়ে সে আর তার বড় ছেলে নিবারণ বেড়িবাঁধের ওপর পলিথিনের চোঙায় থাকে। এ যেন সকালবেলার আমির ফকির সন্ধ্যাবেলা। ৩০০ বিঘা জমির মালিক কয়রার নাংলার নাসের সরদার সেদিন লাইনে দাঁড়িয়ে রিলিফ নিতে গিয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। টিভির বাক্সে সে ছবি দেখে জায়গিরমহলে বাড়ি তার এক আত্মীয় ঢাকা থেকে ফোন করে তাকে আর কী সান্ত্বনা দেবে? মাসের পর মাস গেল পানি তো কমেইনি তাদের বুকের ভিতর এ পানি কালাপানির স্রোত হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাদের আশা-ভরসা আর সব স্বপ্ন। আজকাল সাগরে, নদীতে এমনিতে প্রায়ই জোয়ার বড় বাড়ন্ত। রাজধানী ঢাকায় বসে বিশেষজ্ঞরা বলাবলি করছেন এ পানি নাকি সহজে সরবে না, সমুদ্রের তলা উঁচু হয়ে গেছে পানি টানবে কীভাবে? আইলার আক্রমণের প্রতি ইঙ্গিত করে আরজিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নিচু এলাকাগুলো এ ধরনের আক্রমণে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যেতে পারে, সুন্দরবন ডুবে যেতে পারে, মালদ্বীপের মতো দেশও হয়তো তলিয়ে গেলে আর জাগবে না। সমুদ্রের তলা উঁচু হচ্ছে কেন? কার কারসাজি কিংবা দোষে? যার জন্য হোক কিংবা যেভাবে হোক দেশের উপকূল অঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষ আর সুন্দরবনের তাবৎ প্রাণিসম্পদ, গাছগাছালি তার ভোগান্তির শিকার, কত অসহায় আজ তারা। আইলার সময় বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে কিংবা ছাপিয়ে নোনা পানি সেই যে ঢুকল বর্গির মতো, মাছের ঘের, ধান-চালের খামার, বনের সব প্রাণী ও গরু-ছাগলের খাবার সবই তো পয়মাল। আইলার বিরুদ্ধে মানবতা, প্রাণিসম্পদ, প্রকৃতি ও  পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগ এনে আর যাতে এ ধরনের বিপর্যয় না আসে তার প্রতিবিধান বা প্রতিরোধাত্মক নির্দেশনা কামনা করা  হয়েছে।

[সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।]

সর্বশেষ খবর