শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
ইতিহাস

আর্যসমাজ

আজিম উদ্দিন আহমেদ

আর্যসমাজ

আর্যসমাজ ছিল পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, পরিবার ছিল এর ভিত্তি। পরিবার প্রথার প্রতি এ সমাজের সদস্যরা ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। পরিবারপ্রধান বা গৃহপ্রধানকে বলা হতো গৃহপতি। আর্যদের মধ্যে যৌথ পরিবারের প্রচলন ছিল বেশি। পিতৃতান্ত্রিক আর্যসমাজে পুত্রসন্তানের জন্য লালায়িত থাকতেন প্রত্যেক বাবা-মা। তবে আর্যসমাজে কন্যাসন্তানও উপেক্ষিত ছিল না। তাদেরও মর্যাদা দেওয়া হতো। পুত্রসন্তানের মতো কন্যাসন্তানের সুশিক্ষার দিকে দেওয়া হতো নজর। যৌবনে পদার্পণের পরপরই কন্যাসন্তানের বিয়ে দেওয়া হতো। প্রাচীন আর্যসমাজে পণপ্রথা চালু ছিল। মেয়েদের পিতৃগৃহেই তাদের বিয়ের আয়োজন করা হতো। বিধবা বিয়ের প্রচলন ছিল এ সমাজে। সামাজিক বিধি ও প্রচলিত আইনে নারীকে স্বামীর সহধর্মিণী ভাবা হতো। নারী স্বাধীনতা স্বীকৃত ছিল না এ সমাজে, তবে অনেক নারী আপন গুণে মহিমান্বিত হয়ে উঠেছিল সে যুগে। গোপা, আপালা, মমতা, লোপামুদ্রার মতো বিদুষী নারী সে যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

ফলমূল ও দুধের তৈরি খাবার আর্যদের প্রধান খাদ্য ছিল। যাযাবর জীবনে আর্যরা ঘোড়ার মাংসেই রসনা তৃপ্তি মেটাত। ভারতে এসে তারা গোমাংসের সঙ্গে পরিচিত হয়। গোমাংসে আর্যরা এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ে যে কৃষিকাজে বলদের সংকট সৃষ্টি হয়। যে কারণে আর্যসমাজে গোমাংসের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য। আর্যদের মধ্যে লবণের ব্যবহার ছিল না। আর্যরা মদপান করত তবে তা ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোয় সীমাবদ্ধ থাকত।

আর্যসমাজ বর্ণগত ও বৃত্তিগতভাবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র- এ চার ভাগে বিভক্ত ছিল। শূদ্র ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে জাতিভেদ প্রথা ছিল না। বৃত্তি পরিবর্তনের সুযোগ মিলত আদি আর্যসমাজে। বিয়ে ও মেলামেশার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের বালাই ছিল না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যকে ব্রহ্মচর্য, গার্হ্যস্থ, বাণপ্রস্থ, সন্ন্যাস- এ চারটি আশ্রমের বিধিনিষেধ মেনে চলতে হতো। আর্যসমাজ ছিল সুশৃঙ্খল ও উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন। সমাজে হিংসা, শঠতা, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি অপরাধ থাকলেও এগুলোকে দেখা হতো ঘৃণার চোখে। ভারতবর্ষে আগমনের আগে আর্যরা ছিল যাযাবর জাতি। স্বভাবতই তাদের মধ্যে নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটেনি। ভারতবর্ষে এসে তারা গ্রামীণ জীবনেই অভ্যস্ত ছিল। আর্যদের যে সভ্যতা দক্ষিণ এশিয়ায় গড়ে ওঠে তা ছিল একান্তভাবেই গ্রামীণ সভ্যতা।

বৈদিক মন্ত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তাতে কোনো নগরের উল্লেখ নেই। আর্যরা গ্রামীণ সভ্যতার প্রতি মোহাবিষ্ট হলেও সামরিক প্রস্তুতির ব্যাপারে ছিল এগিয়ে। যে কারণে সামরিক নগর ও দুর্গের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে সে সমাজব্যবস্থায়। গ্রামীণ সভ্যতার কারণে আর্যরা ছিল কৃষিনির্ভর। পশু পালনও ছিল আর্যসমাজের অনুষঙ্গ।

আর্যসমাজের অর্থনৈতিক লেনদেন ঘটত মূলত বিনিময় প্রথার মাধ্যমে। তবে সে যুগে ‘নিষ্ক’ ও ‘মনা’ নামের ধাতব মুদ্রার অস্তিত্ব ছিল। আর্যরা যাতায়াতের ক্ষেত্রে ঘোড়া ও বলদ চালিত গাড়ির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ঘোড়ায় চালিত রথ ব্যবহার করত অবস্থাপন্নরা। প্রাচীনকালে তাদের মধ্যে সমুদ্রপথে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে ইতিহাসবিদদের মধ্যে।

 আর্যসমাজ ছিল একেশ্বরবাদী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তারা ছিল প্রকৃতির উপাসক ও বিভিন্ন দেবতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে এ সমাজের সদস্যরা মূর্তিপূজা করত না। আর্যরা বহু দেবদেবীতে

 বিশ্বাসী হলেও তাদের বিশ্বাস ছিল সব দেবদেবী অভিন্ন মহাশক্তির বিভিন্ন প্রকাশ। আর্যধর্মের ধর্মাচারের মধ্যে ছিল যাগযজ্ঞ ও অঞ্জলি প্রদান। আর্যসমাজের শুরুতে রাজাদের ক্ষমতা অপরিসীম ছিল না। তবে কালক্রমে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। একপর্যায়ে ব্রাহ্মণদের ওপরও রাজাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এমনকি তারা ব্রাহ্মণদের বিতাড়িত করে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে পারত। তবে সাধারণভাবে রাজা প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। ব্রাহ্মণদের সুরক্ষাকে কর্তব্য বলে

ভাবত। আর্যসমাজে প্রথম দিকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের মধ্যে তেমন পার্থক্য ছিল না। কিন্তু কালক্রমে কঠোর হতে থাকে বর্ণপ্রথা। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের ক্ষমতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ক্ষত্রিয়দের মর্যাদা হ্রাস পায় ক্রমান্বয়ে। আর শূদ্রদের অপবিত্র ভাবা শুরু করে আর্যরা। আর্যদের মধ্যে নারীদের সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হলেও কালক্রমে তাদের অবস্থারও অবনতি ঘটে। শুরু হয় বাল্যবিয়ের কুপ্রথা। সতীদাহের ঘৃণ্য প্রথাও চালু হয়।

যাযাবর আর্যরা ভারতবর্ষে এসে তাদের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটালেও কতটা সভ্য হয়ে উঠেছিল তা একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। ঋগ্বেদে নগরকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ নগরবাসীরা ছিল সুসভ্য। তবে তাদের গায়ের রং কালো, নাক চ্যাপ্টা। যারা ছিল ভারতবর্ষের আদিবাসী দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর