শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মাটি বলে, ‘ধানটা তুমি নাও, খড়টা আমায় দাও’

শাইখ সিরাজ

মাটি বলে, ‘ধানটা তুমি নাও, খড়টা আমায় দাও’

আজ বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। এবার এ দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে মাটিকে জীবিত রাখি, জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখি (Keep soil alive, Protect soil biodiversity) সময়ের প্রয়োজনে সারা বিশ্বেই মাটির স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার তাগিদ জোরালো হচ্ছে। কারণ আমরা বুঝতে শুরু করেছি অধিক ফসল ফলাতে গিয়ে দিন দিন আমরা মাটির কী ক্ষতিই না সাধন করে এসেছি! জনসংখ্যার বিস্ফোরণে বর্ধিত মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দেওয়ার চ্যালেঞ্জটাকেই আমাদের আগে মোকাবিলা করতে হয়েছে। খাদ্যের তাগিদে মাটির বুক থেকে ফলিয়ে নিয়েছি অধিক ফলন। মাটিও নিঃশেষ করে দিয়ে ফসল ফলিয়েছে। অধিক রাসায়নিক প্রয়োগ করে, ইচ্ছামতো কীটনাশক ছিটিয়ে মাটির গুণ নষ্ট করে দিয়েছি। যার বিরূপ প্রভাব আমরা নিজেরাই অনুভব করতে পারছি। অনেক আগে থেকেই আমি বলছি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাটিকে বাঁচাতে হবে। ২০১০ সালে নীলফামারীর অন্নপূর্ণা জৈবসার কারখানার স্বত্বাধিকারী রামনিবাস আগরওয়ালা এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন, ‘মাটি হচ্ছে মা। মাটি বলছে তুমি আমাকে ১০ কেজি বীজ দিলা, ১ মণ সার দিলা, তোমাকে বিনিময়ে কী দিলাম! ৫০ মণ ধান দিলাম, ৫০ মণ নাড়া দিলাম। তুমি কি কখনো চিন্তা করে দেখেছ এটা কোথা থেকে এলো? আমার শরীরের গচ্ছিত সম্পদ থেকে তোমাকে দিয়েছি। তুমি এক কাজ কর- ধানটা তুমি নাও নাড়াটা আমাকে দাও। তুমি তো আমার সন্তান, তোমাকে বাঁচানো আমার কর্তব্য। চিন্তা করছি আমি মরে গেলে তোমার কী হবে! কাজেই তুমি তোমার স্বার্থে আমাকে বাঁচিয়ে রাখ।’      

কবি বলেছেন, ‘খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি আমার দেশের মাটি’। সত্যি, আমার দেশের মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি। স্বাধীনতার সময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি। আর এখন ১৭ কোটি ছাড়িয়ে। এ মাটিতেই উৎপাদিত হয়ে আসছে আমাদের সবার খাদ্য। তবে এ অধিক ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে মাটির ওপর আমরা মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার করে এসেছি। জমিতে প্রয়োগ করতে হচ্ছে রাসায়নিক সার। অধিক কর্ষণে মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতা, নষ্ট হচ্ছে জৈবগুণ। আবার সময়ের সঙ্গে বেড়েছে আমাদের ফসল বৈচিত্র্যও। কিন্তু কোন জমিতে কোন ফসল চাষ করলে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে সে সম্পর্কে কৃষকের কি তেমন জানা বোঝা আছে? কয়েক বছর ধরেই ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর অনুষ্ঠানগুলোয় আমি কৃষকের কাছে জানতে চেয়েছি তারা মাটি পরীক্ষা করেন কিনা। ১ শতাংশের কম কৃষক বলেছেন তারা মাটি পরীক্ষা করেন। সবচেয়ে হতাশার বিষয়, মাটি পরীক্ষা সম্পর্কে ধারণা রাখেন এমন কৃষক শতকরা পাঁচজনও পাইনি। অথচ এ মানুষগুলোরই জানা দরকার ছিল জৈব পদার্থই হলো মাটির প্রাণ। শস্য উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা রক্ষায় প্রয়োজন মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব সার থাকা। এ না জানার ফলে তারা বছরের পর বছর ধরে অতিরিক্ত সার আর কীটনাশক ব্যবহার করেছেন। এতে অধিকাংশ এলাকার মাটির জৈব পদার্থ নেমে এসেছে শতকরা ১ ভাগের নিচে, যা ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বিরাট হুমকিস্বরূপ। এই কিছুদিন হলো বেশ কিছু বিষয়ে কাজ করেছি হবিগঞ্জে। এখানে আমাদের দীর্ঘদিনের কাজের ফলোআপ বলা যেতে পারে। গত ২০ বছরে এ এলাকার কৃষিবৈচিত্র্যের পরিবর্তন আর কৃষকের সচেতনতা দৃষ্টান্তমূলক। গত সপ্তাহেই কথা হচ্ছিল হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার মুড়াগাঁও গ্রামের কৃষকের সঙ্গে। মুড়াগাঁও গ্রামটি ছবির মতো সুন্দর। এক পাশে উঁচু টিলায় সুদৃশ্য চা বাগান, অন্য পাশের সমতলে সবজি ফসল। এখানকার ফসলের বৈচিত্র্য দেখে অনেকটাই অনুমান করা যায় কৃষক এখানে বেশ সমৃদ্ধ। একদল কৃষিশ্রমিক কাজ করছিলেন বেগুন খেতে। ফসল তোলায় ব্যস্ত তারা। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম এদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন খেতের মালিক তোফায়েল আকুঞ্জিও। তোফায়েল উদ্যমী তরুণ। চাষাবাদ নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী। জানালেন খুব অঙ্ক কষে চাষাবাদ করেন তিনি। বেগুনের আবাদ এবারই প্রথম করছেন। কিন্তু মিশ্র সার ব্যবহার করায় ফলন ভালো হয়েছে। জানতে চেয়েছিলাম সার ব্যবহারের আগে মাটি পরীক্ষা করিয়েছিলেন কিনা। জানালেন মাটি পরীক্ষা করাননি। গ্রামের আরও কয়েক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম কেউই মাটি পরীক্ষা করে চাষ উপযোগী ফসল চাষ করেন না। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও অনুমাননির্ভর। বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির মিশ্র সার পাওয়া যায়। অনেকেই মিশ্র সার ব্যবহার করছেন। তাদের মাটি পরীক্ষা করে, মাটির স্বাস্থ্যের অবস্থা বুঝে জৈব সার ব্যবহারের কথা বললাম। মুড়াগাঁওয়ের সৌন্দর্য আর খেতে খেতে ফসলের বৈচিত্র্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এক লাউ খেতে দেখলাম শত শত লাউ ঝুলে আছে। এর উদ্যোক্তা আরেক শিক্ষিত তরুণ মনসুর আহমেদ। চার বছর আগে আত্মনির্ভরশীল হতে বেছে নিয়েছেন লাউ চাষ। বর্তমানে ২ বিঘা লাউ খেত জোগান দিচ্ছে সচ্ছল জীবনযাপনের সব ব্যয়। তিনিও ফলন বেশি পেতে ব্যবহার করছেন নানা রাসায়নিক সার। শুধু মনসুরই নন, শিম চাষি মফিজুর, সবজি চাষি নবী হুসেন, ধান চাষি রবিউল প্রত্যেকেই বললেন রাসায়নিক সারের ওপরই নির্ভরশীলতার কথা। ফসল পেতে হলে সার প্রয়োগ করতেই হবে। কিন্তু বেশি ফলন পেতে বেশি বেশি রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে আমরা কি মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারছি? এখন হয়তো ফসল ভালো হচ্ছে কিন্তু রাসায়নিক সার ব্যবহার করে করে অধিক ফলন দিতে দিতে মাটি যখন জৈবগুণ সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলবে তখন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কেউ। প্রশ্ন হচ্ছে- এ নিয়ে কেউ কি ভাবছেন? মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ফসলের বেশি ফলনের প্রশ্নে সার প্রয়োগের আধুনিক অনুশীলনগুলো নিয়ে কথা বলেছি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সোহেলা আখতারের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, একটি গাছ বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে ফল দেওয়া পর্যন্ত জীবনচক্রে মাটি থেকে ১৭টি উপাদান গ্রহণ করে। এর কোনো উপাদান কম হলেই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আবার কোনো উপাদান বেশি হলেও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি।

আমি প্রায়ই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকের কাছে জানতে চেয়েছি মাটি পরীক্ষার বিষয়টি। দেখেছি অনেক কৃষকই এ ব্যাপারে অবগত নন। আবার যারা মাটি পরীক্ষা করাতে চান তারাও সহজে পরীক্ষা করাতে পারছেন না। অনেকের অভিযোগ, মাটি পরীক্ষার ফল হাতে পেতে পেতে ফসলের মৌসুম চলে যায়। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। মাটির সুস্থতাই নিশ্চিত করে সুস্থ ফসলের তথা নিরাপদ খাদ্যের। আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে টেকসই কৃষির তাগিদে আমাদের এখন থেকেই মাটির সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি কৃষকের দায়িত্ব রয়েছে মাটির স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করার। টেকসই ব্যবস্থাপনার আলোকে ফসলের বেশি ফলন নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে মাটির স্বাস্থ্যও টিকিয়ে রাখা জরুরি। ভারসাম্যপূর্ণ সারের ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আরও বেশি কৃষক সচেতনতার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে মাত্রাতিরিক্ত সারের প্রয়োগ, সুষম মাত্রা ও ব্যবস্থাপনা অনুসরণ না করায় যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের সচেতন করে তোলাটা অনেক বেশি জরুরি। অন্যদিকে মাটিদূষণের অকৃষিজ কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নিরোধের পদক্ষেপ নিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর পৃথিবীর অপরূপ এক দেশ গড়ে তোলাই আমাদের কর্তব্য।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর