শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সমাজ হোক মাদকমুক্ত

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

সমাজ হোক মাদকমুক্ত

মাদক এখন সব অপরাধ ও সন্ত্রাসের জনক, একজন যখন অপরাধের জগতে পা বাড়ায় তখন পা রাখে ড্রাগ বা মাদকের নেশায়। কয়েক বছর ধরে পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে একটির পর একটি অমানবিক ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে আমাদের দেশ। কারণ একটিই তা হলো মাদকাসক্তি। পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, দিন দিন ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে এবং আসক্ত তরুণ-তরুণীরা অধিকাংশ উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মাদকাসক্ত ছেলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ছেলেকে পুলিশে দিয়েছেন মা-বাবা। তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ছয় মাস কারাদন্ড দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে। মাদকাসক্ত ছেলেটি দীর্ঘদিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ এলাকায় নানা অপকর্ম করে আসছিল। ছেলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মাদকাসক্তের বাবা থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। এর পরপরই তাকে আটক করে পুলিশে দেয় পরিবারের লোকজন।

দেশের কয়েক হাজার তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্রের খপ্পরে পড়েছে। বাড়িতে বাবা, মা বা অভিভাবকদের অজান্তে তারা স্বেচ্ছায় আসক্ত হয়ে পড়েছে পর্নোগ্রাফিতে। অনেকেই পর্নোগ্রাফিতে জড়িয়ে পড়ার সময় লিঙ্গ পরিচয় গোপন করছে। লিঙ্গ পরিচয় গোপন করে কেউবা সমকামী, আবার কেউ বিপরীত লিঙ্গকে টার্গেট করে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। পরে একে অনের নগ্ন ছবি শেয়ার করে, এভাবেই আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।

মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ধর্ষককে গ্রেফতার করা হয়। তথ্য থেকে জানা যায়, পুরোপুরি মাদকাসক্ত। সে হেরোইন ও ইয়াবার মতো মাদক নিয়মিত গ্রহণ করত এবং মাদক সেবন করেই বহু নারীকে ধর্ষণ করেছে। সম্প্রতি সিলেটে স্বামীর সামনে থেকে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে এমসি কলেজ ধর্ষণের ঘটনা কে না জানে? এ ঘটনায় আটজন গ্রেফতার হয়েছেন এবং আদালতে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। পুলিশ বলেছে জড়িত সবাই মাদকসেবী। আরেকটি ঘটনা। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বামীর জন্য রক্ত আনতে গিয়ে ধর্ষণের ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গ্রেফতারকালে ধর্ষকরা মাদক সেবন করছিল। রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরে মাদকাসক্ত স্বামী তার স্ত্রীকে বাবার কাছ থেকে বারবার ইয়াবা সেবনের জন্য টাকা এনে দেবার জন্য চাপ প্রয়োগ করত। শেষ পর্যন্ত স্বামীর ছুরিকাঘাতে খুন হন এই গৃহবধূ। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় সন্দেহভাজন মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের তালিকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই তালিকা ধরে ডোপ টেস্টের পর ৬৮ জন মাদকসেবী শনাক্ত হন। এর মধ্যে ১০ জন চাকরি থেকে চূড়ান্ত বরখাস্ত হন। মাদকাসক্তির পাশাপাশি মাদকসংশ্লিষ্ট অন্যান্য অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আরও ২৯ জনকে শনাক্ত করা হয়। তার মধ্যে মাদক বিক্রিতে ১০ জন, সেবনে পাঁচজন, মাদক দিয়ে ফাঁসানোর ১০ জন ও উদ্ধারকৃত মাদকের চেয়ে কম দেখানোর অভিযোগ আনা হয়েছে চারজনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ছয়জনের শাস্তি হয়েছে। পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে মাদকাসক্ত রয়েছে- এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসূত্র বলছেন, মাদক আইনে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে মূলত শিক্ষার্থী ও গাড়িচালকদের কথা চিন্তা করেই। এখন বিধিমালা অনুমোদন পেলে ডোপ টেস্ট করার কাজ সহজ হবে। এমনকি সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান, দফতর বা সংস্থার কোনো ব্যক্তির আচরণ নিয়ে সন্দেহ হলে ওই দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ডোপ টেস্ট করানোর জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে অনুরোধ করতে পারবেন। এর বাইরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় চাইলে বিদেশগামী শ্রমিকদের ডোপ টেস্টও বাধ্যতামূলক করতে পারবে। তারা যে কোনো সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে দিয়ে এ টেস্ট করাতে পারবে। মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, নতুন প্রজন্মকে বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাদক থেকে রক্ষা এবং সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টানতে সরকার ডোপ টেস্টের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। শুধু চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নয়, মাদক আইন অনুযায়ী সব জায়গায় ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা গেলে মাদক প্রতিরোধে সফলতা আসবে। সম্প্রতি খুলনায় মাদক মামলায় মাত্র তিন কার্যদিবসে রায় ঘোষণা করেছে আদালত। গাঁজা রাখার অপরাধে ছয় মাস ও ইয়াবা রাখায় আরও ছয় মাস সশ্রম কারাদন্ড দিয়েছে আদালত, এ ছাড়া ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাসের সশ্রম কারাদন্ড। দ্রুত রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে এটি একটি দৃষ্টান্ত, এভাবে যদি অন্য বাকি সব মাদক মামলার রায় ঘোষণা করা হতো তবে মাদকাসক্তির এ অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করা যেত। প্রতিটি এলাকায় পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় যদি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সহায়তায় এ ধরনের কিশোর গ্যাং ও বড় ভাইদের চিহ্নিত করা যায় এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় সেই সঙ্গে তাদের যথাযথ কাউন্সেলিং বা চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় তবে সমাজ থেকে মাদকাসক্ত ও বিভিন্ন অপরাধ কমানো কঠিন কোনো বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবারের পিতা-মাতার যেমন ভূমিকা আছে তেমনি প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও ভূমিকা আছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ভরসা করে বসে থাকলে সমাজ থেকে এ ধর্ষণ, খুন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও মাদকাসক্তি বন্ধ হবে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা এবং মাদকবিরোধী অভিযানটি শুধু মাদকের অভিযান নয়। এ অভিযান সমাজের সব ধরনের অপরাধ খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, সন্ত্রাসী, কার্যক্রমের বিরুদ্ধে। মাদকাসক্তির নাটের গুরুই হচ্ছে ধূমপান বা সিগারেট তাই, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

লেখক : সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর