মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বিনা খরচে যদি আরেকটি সেতু পাওয়া যায় ক্ষতি কী

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বিনা খরচে যদি আরেকটি সেতু পাওয়া যায় ক্ষতি কী

আমার এক অতিপ্রিয় প্রতিরোধ যোদ্ধা জগলুল পাশা সেদিন ইহলোক ত্যাগ করেছে। রাজা দীপঙ্কর, শাহ আজিজ, হাশমী মাসুদ জামিল যুগল, সুলতান মনসুর, নাসিম ওসমান, মঞ্জু, বাবুল হক, আবদুল হালিম, কবির বেগ, দেলোয়ার, শরীফ, মাহবুব, গৌর, বৌদ্ধ, গোপাল, শ্রীমঙ্গলের মান্নান, তরুণ, দুলাল, ডা. শরিফুল, লুৎফর, গিয়াস, আসাদ বিন স্বপন, আমানউল্যাহ এমনি আরও শত যোদ্ধার প্রতিরোধে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে নিষ্ঠাবান এক বীর চলে গেল। জগলুল পাশার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তার পরিবার-পরিজনকে যেন আল্লাহ এ শোক সইবার শক্তি দেন।

আজ বিজয়ের মাসের আট দিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম জামালপুরের পথে দিগপাইতে। মিত্রবাহিনী ব্রহ্মপুত্র পার হতে পারছিল না। তারা চরম বাধা পাচ্ছিল জামালপুরের কামালপুরে। বেশ কয়েকদিন প্রচন্ড গোলাবর্ষণের পরও কামালপুর ঘাঁটির পতন না হওয়ায় কামালপুরকে পাশ কাটিয়ে মিত্রবাহিনী শেরপুর ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত এসে গিয়েছিল। কিন্তু জামালপুরের পাড়ে আসতে পারছিল না। মিত্রবাহিনী জামালপুরে হাজার পাউন্ডের বোমা ফেলায় অনেক বাঙ্কার ধসে গিয়েছিল। তবু হানাদাররা হাত তোলেনি বা গুটিয়ে যায়নি। তাই আমাদের দক্ষিণ দিক থেকে জামালপুর চেপে ধরার অনুরোধ জানিয়েছিল। অনুরোধটিতে কোনো গোপনীয়তা ছিল না। সরাসরি ওয়্যারলেসে আমাদের জামালপুর চেপে ধরার অনুরোধ করা হয়। প্রায় ১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি ধনবাড়ীর দিগপাইত পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে মনে হয় আমরা জামালপুর গেলে টাঙ্গাইল পেছনে পড়ে থাকবে। পায়ে হেঁটে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে এঁটে উঠব না। তাই রাতের মধ্যেই গোপালপুর ফিরে এসে ঘাটাইল-কালিহাতী থানা দখলের পরিকল্পনা করি। সে পরিকল্পনামতই ১০ ডিসেম্বর নিরাপদে ছত্রীবাহিনী নামতে পেরেছিল। ১১ তারিখ টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত এবং ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন- এ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বাঙালি জাতি কখনো এমন নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেনি।

পুরো সপ্তাহই ভেবেছি যমুনার রেলসেতু নিয়ে দুই কলম লিখব। যেখানে বঙ্গবন্ধু সেতু তার বড়জোর ১ কিলোমিটার উজানে ১১ আগস্ট, ১৯৭১ হানাদার বাহিনীর বিশাল দুই জাহাজ ধ্বংস করেছিলাম। অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার করেছিলাম বেশুমার। যে অস্ত্রশস্ত্র পরে আমাদের কাজে লেগেছিল। বাঙালি মাছের তেলে মাছ ভাজে, আমরা হানাদার পাকিস্তানিদের অস্ত্র গোলাবারুদ তাদের ওপরই ব্যবহার করেছি। হানাদারদের জাহাজ দখলের পর আমাদের আর অস্ত্রের কোনো অভাব ছিল না। আরও দু-এক বছর যুদ্ধ চললে অস্ত্র গোলাবারুদের টান পড়ত না। তাই সেই মাটিকাটা জাহাজমারা ঘাটের এক-দেড় কিলোমিটার ভাটিতে বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ায় আমরা খুবই খুশি। বর্তমানে যেখানে বঙ্গবন্ধু সেতু, এ সেতুর কথা একসময় হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ভেবেছিলেন। তারও আগে ভেবেছিলেন অলি-এ-কামেল এনায়েতপুরের পীর। শেষ পর্যন্ত মহান দুই অলি-এ-কামেলের ইচ্ছামতো জায়গায় যমুনা সেতু হওয়ায় দুই পারের মানুষই খুশি। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যমুনা সেতুর জন্য খুবই চেষ্টা করেছিলেন। হাতে টাকা ছিল না তবু জাপানি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেছিলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর ভাই যোগাযোগমন্ত্রী হলে সেতুর কাজ তরতরিয়ে এগিয়ে চলে। ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু আর তেমন কিছু করতে পারেননি। সেতুর সব কার্যক্রম বস্তাবন্দী পড়ে থাকে। একসময় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যমুনা সেতুর জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং তার উৎসাহ-উদ্দীপনায় সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়। এটা এশিয়ার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। এটাকে মাঝেমধ্যে বাঁশের সাঁকো ভাবতে কষ্ট হয়। সেতুতে প্রথম অবস্থায় রেললাইনের কথা ছিল না। পরে যুক্ত করা হয়। কিন্তু খুব একটা সুবিধাজনক হয়নি। সেতুর উত্তর পাশ দিয়ে রেললাইনে কচ্ছপের গতিতে ট্রেন চলে। ৫ কিলোমিটার পার হতে ৩০ মিনিট লাগে। মানে ঘণ্টায় ১০ মাইল। মুক্তিযুদ্ধের সময় কখনোসখনো আমরাও ঘণ্টায় ৫-৬ মাইল পাড়ি দিতাম। বুলেট ট্রেনের জমানায় এও এক আশ্চার্য ঘটনা। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে সেতুর কাজ চলাকালে একবার গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টারে গিয়ে স্পিডবোটে ঘুরে যমুনা সেতু দেখেছিলাম। তখনই আমার মনে হয়েছিল সেতু নির্মাণে যে কলাকৌশল তাতে রোড স্ল্যাবের ভিতর দিয়ে অনায়াসে আরেকটা সেতু করা যেত। শুধু প্রয়োজন হতো একটু আলো-বাতাস যাওয়ার ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু সেতুর পেটে প্রায় ৪০ ফুট পাশে এপার-ওপার একটি রাস্তা রয়েছে যা একেবারে অকেজো পড়ে আছে। অন্যদিকে রেললাইন উত্তর পাশ দিয়ে না নিয়ে মাঝামাঝি নিলে ট্রেনের গতি স্বাভাবিক রাখতে কোনো অসুবিধা হতো না। উত্তর পাশে মাচার ওপর দিয়ে যেভাবে ট্রেন চলে সেখান দিয়ে বাস-ট্রাক অনায়াসে চলতে পারত। মাঝ দিয়ে রেললাইনের দুই পাশে আড়াই-তিন ফুট দেয়াল তুলে দিলে কোনো অসুবিধা হতো না। কে শোনে কার কথা। আমরা তো আর ইঞ্জিনিয়ার নই। পৃথিবীর নানা দেশের প্রকৌশল জ্ঞান অর্জনের সার্টিফিকেট নেই। তাই আমাদের কথায় কী হবে। বাঁশের সাঁকো বলেছি এ জন্য, বঙ্গবন্ধু সেতুর এপাশ-ওপাশের কান্ডকারখানা দেখলে ভিরমি খেতে হয়। সারা দেশে শোলার পুলের ওপর দিয়ে যেসব গাড়ি আসে তা যমুনা সেতু পার হতে পারে না। বাংলাদেশের সব থেকে শক্তিশালী স্থাপনা সবচাইতে উল্লেখযোগ্য সেতু ৯-১০ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও যে সেতুর কোনো ক্ষতি হবে না, সে সেতুর ওপর দিয়ে নির্ধারিত ওজনের ১ টন বেশি হলেও নিতে পারে না। রাজশাহী-পাবনা-দিনাজপুর-রংপুর-বগুড়া, এদিকে চট্টগ্রাম যেখান থেকেই মালবোঝাই ট্রাক আসুক বঙ্গবন্ধু সেতুর পাড়ে এসে স্কেলে উঠিয়ে মাপতে হয়। সেখানে ৫০০ কেজি বেশি হলেও নামিয়ে রেখে অন্য গাড়িতে পার করতে হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুর দুই পাড়ে এজন্য বিড়ম্বনার শেষ নেই। কেউ কাঠ, ইট, বালু, রড, সিমেন্ট, পাথর যা কিছুই হোক বেশি হলে অন্য গাড়িতে পারাপার করতে হয়। অথচ যমুনা সেতুর এপার-ওপার শত শত ব্রিজ-কালভার্টের ওপর দিয়ে সে ভারী যানবাহন অনায়াসে ছোটাছুটি করে কোনো ক্ষতি হয় না। সব ক্ষতি যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর। এই খোঁড়া যুক্তি মানা যায়? আবার যখন ট্রেন যায় পাঁচটি ট্রাকের সমান লোড ট্রেনের প্রতিটি বগির, তার ২০-২৫টি বগি একসঙ্গে যায়। তখন সেতু ভেঙে পড়ে না। রেলে তেলের ট্যাংকার, প্রতিটি ৫০ টন তেল বহন করে। ট্যাংকারের ওজনও ১৫-২০ টন। এর অন্তত ২০-২৫-৩০টি ট্যাংকার একসঙ্গে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়, ভেঙে পড়ে না। ভেঙে পড়ে যদি ট্রাকে ১০ টনের জায়গায় ১১ টন থাকে তাহলে। দিনরাত জিনিসপত্র নামাতে-ওঠাতে গিয়ে পেরেশানির শেষ নেই। মালপত্র হারিয়ে যায়। ভুক্তভোগীরা রাতদিন চিৎকার করে, কোনো প্রতিকার নেই।

এবার আসি রেলসেতু বিষয়ে। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর ৫০০- ৬০০ গজ উজানে ৩০ নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রেলসেতুর কাজ উদ্বোধন করেছেন। শুনলাম ১০০-১৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে পারবে- এটা খুবই আনন্দের কথা। বর্তমানে বুলেট ট্রেনের আমলে শত মাইল গতি কোনো গতিই না। এখন বুলেট ট্রেন ৬০০-৭০০ কিলোমিটার গতিতে চলে। আকাশে বিমানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অনেক বিমান ৪০০-৪৫০ কিলোমিটার বেগে চলে। সাধারণত বড় বড় প্লেনগুলো ৮০০ কিলোমিটারের বেশি গতি নেয় না, সেখানে ট্রেনের গতি ৬০০-৭০০ কিলোমিটার অবিশ্বাস্য, অভাবনীয়। তাই যে সেতুর ওপর দিয়ে এ রকম দ্রুতগতির ট্রেন চলবে তার কম্পন সইবার ক্ষমতা থাকবে অনেক বেশি। আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু শেষ হওয়ার পথে। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে মুখ ফিরিয়ে ছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা নেত্রী শেখ হাসিনা সাহস করে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের পদক্ষেপ নেন। এখন বিশ্বব্যাংক আমাদের টাকা দিতে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। তাই যমুনা রেলসেতু একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই বলি কারণ তাঁকে ছাড়া অন্য কারও কিছু করার নেই। বঙ্গবন্ধু সেতুর পেটের ভিতর দিয়ে যেমন আরেকটি পথ করা যেত সেটা সড়কপথই হোক আর রেলপথ। শুধু কিছু ভেনটিলেশনের ব্যবস্থা করলেই হতো। ঠিক তেমনি যমুনা রেলসেতুতে নিচ দিয়ে ট্রেন চলবে। ওপর ফাঁকা পরিত্যক্ত, কোনো কাজে লাগবে না। একই রকম স্ট্রাকচার পদ্মায়- ওপর দিয়ে গাড়ি-ঘোড়া, নিচ দিয়ে রেল। এখানে শুধু রেল কেন? ওপর দিয়েও তো আরেকটি সড়কপথ প্রায় একই খরচে করা যেতে পারে। ওপরে সড়কপথ করতে যদি স্টিল স্ট্রাকচারগুলোয় সামান্য রদবদল আনতে হয় আনা হবে। আমার তো মনে হয় যে টাকায় রেলসেতু হবে তার থেকে ২০ শতাংশও অতিরিক্ত খরচ করতে হবে না। স্টিল স্ট্রাকচারে ‘ভি’র মতো ওপর নিচে যে জয়েন্ট দেওয়া হয়েছে সেগুলোর মাঝে আরেকটা ‘আই’ বসিয়ে দিলে ওপরে নিচে ওয়েট বেয়ারিং ক্ষমতা বেড়ে যাবে শতগুণ। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আন্তরিক অনুরোধ একটু ভেবে দেখবেন, এক খরচেই যদি দুটি পথ পাওয়া যায় তাহলে কেন দেশের অর্থ নষ্ট করা হবে।

তাই সনির্বন্ধ অনুরোধ, রক্ত দিয়ে যে দেশ স্বাধীন করেছি সেই স্বাধীন দেশে বিজয়ের মাসে সরকারপ্রধান প্রিয় ভগ্নির কাছে বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখার আন্তরিক অনুরোধ জানাচ্ছি। একই খরচে যদি আরেকটি সেতু পাওয়া যায় তাহলে আপত্তি কোথায়? পদ্মা-যমুনার ওপর দেশের উন্নয়নে আমাদের আরও সেতুর প্রয়োজন হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! গত দুটি খুশির ঈদের সময় বঙ্গবন্ধু সেতুতে যে যানজট দেখেছি তা বলার মতো নয়। একবার আমি যানজটের সময় টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা গিয়েছিলাম। ফেরার পথে মির্জাপুর থেকে উল্টো পথে এসেছিলাম। উল্টো পথে এসেছিলাম বলে বাড়ি ফিরে ইফতার করতে পেরেছিলাম। সকাল ৮টায় যাওয়ার পথে যাদের নাটিয়াপাড়া-জামুর্কীর কাছে দেখে গিয়েছিলাম, সেই তাদের বিকাল সাড়ে ৪টা-৫টায় করটিয়ার কাছে পেয়েছিলাম। ৮টা থেকে সাড়ে ৪টা-৫টা, সাড়ে ৮-৯ ঘণ্টায় তারা ৩-৪ কিলোমিটার এগোতে পেরেছিল। তাই বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো আরেকটি সেতু হলে কারও কোনো ক্ষতি হবে না।

বরং দেশের জন্য লাভই হবে। সর্বোপরি কোনো কাজেই যদি না লাগে কোনো জরুরি অবস্থায় শুধু সামরিক বাহিনীর পারাপারের জন্যও যমুনা রেলসেতুর ওপর দিয়ে একই খরচে আরেকটি সড়ক যোগাযোগ হলে হয়তো তখন কাজে লাগবে। তাই প্রস্তাবটি ভেবে দেখবেন।

যমুনা রেলসেতু নির্মাণের সময় বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তা একটি প্রশংসার কাজ হয়ে থাকবে।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর