বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

নবীজি বলেছেন পাখি হত্যা কোরো না

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

নবীজি বলেছেন পাখি হত্যা কোরো না

দিন যত যাচ্ছে, ততই ঘন কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে শীত বাড়ছে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অতিথি পাখির আনাগোনা। আর অতিথি পাখি মানেই কিচিরমিচির কলকাকলিতে ভরে ওঠা রূপসী বাংলার প্রাণবন্ত প্রকৃতি। প্রতি বছরই শীত এলে হিমালয় পেরিয়ে আমাদের দেশে উড়ে আসে সোনাজঙ্গ, কুনচুষি,  বাতারণ, শাবাবজ, জলপিপি, বালিহাঁস, হরিয়াল, রাজশকুন, তিলে ময়না, রামঘুঘু, খঞ্জনা, চকাচকি, বুনোহাঁস, সারস, হেরন, কাদাখোঁচাসহ নানা নামের নানা রঙের অতিথি পাখি। ওদেরই আশপাশে ভিড় জমায় বিচিত্র সব দেশি পাখি। পাখির কলরবে মুখরিত হয় নদীর পাড়, বিলঝিল, বন-বাদাড় সব। এসব অতিথি পাখির কারুকার্য খচিত ডানায় ভর করে আকাশের নীল সীমানায় ওড়াউড়ি মানুষের মনকে যতটা মুগ্ধ করে, ঠিক ততটাই বিস্মিত করে দৃষ্টিকে। মানুষের সঙ্গে পাখি জড়িয়ে আছে সেই আদিকাল থেকেই। ইতিহাসের পাতায় অতিথি পাখি নিয়ে সবচেয়ে প্রাচীন যে তথ্য পাওয়া যায় তা ৩ হাজার বছর আগের। এসব তথ্যে দেখা যায় গ্রিসের হিসিয়াড, বিখ্যাত কবি হোমার, ইতিহাসবিদ হিরোডোটাস, দার্শনিক অ্যারিস্টটলসহ আরও অনেকেই পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে অনেক কিছু লিখে গেছেন। অ্যারিস্টটল তাঁর এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘সারস পাখি স্কাথিয়ার বৃক্ষহীন প্রান্তর থেকে নীল নদের জলাভূমিতে ভ্রমণ করত।’ একটা সময় ছিল যখন পাখি ছিল মানুষের নিত্যসহচর। রাজা-বাদশাহ থেকে শুরু করে সাধারণ প্রজারাও পাখি পুষত। পাখির পায়ে চিঠি বেঁধে দূরদূরান্তে খবর পাঠাত। সৈয়দ আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ কাব্যেও আমরা দেখতে পাই বিরহিণী রাজকুমারী তার স্বামীর কাছে দুঃখের বার্তা পৌঁছাতে একটি পাখি নিযুক্ত করেছিলেন। আলাওলের বর্ণনায়, ‘উড়তে নাড়িল পাখ শূন্যের উপর উল্কাপাত হয় হেন বরে তার নর। সমুদ্র উপর দিয়া করিল গমন জলনিধি হৈল তাই পূর্ণিত লবণ।’ রাজা-বাদশাহ এমনকি নবী-রসুলদের সংবাদ আদান-প্রদানেও পাখি ছিল বিশ্বস্ত বার্তাবাহক। পবিত্র কোরআনে সুলাইমান (আ.)-এর হুদহুদ পাখির কথা কত চমৎকারভাবেই না বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সুলাইমান বিহঙ্গ দলের সন্ধান নিয়ে বলল, ব্যাপার কী! হুদহুদকে দেখছি না যে! সে অনুপস্থিত নাকি? সে উপযুক্ত কারণ না দর্শালে আমি অবশ্যই তাকে কঠিন শাস্তি দেব অথবা জবাই করব। এরপর হুদহুদ এসে পড়ল এবং বলল, আপনি যা অবগত নন আমি তা অবগত হয়েছি। সাবা থেকে সুনিশ্চিত খবর নিয়ে এসেছি। সেখানে আমি এক নারীকে দেখলাম তাদের ওপর রাজত্ব করছে। তাকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে এবং তার রয়েছে এক বিরাট সিংহাসন।’ সুরা নামল, আয়াত ২০-২৩। পাখিদের ওড়ার দৃশ্য দেখেই রাইট ভ্রাতৃদ্বয় উড়োজাহাজ আবিষ্কারে অনুপ্রাণিত হন। সত্যি! এ এক আশ্চর্য বিষয় বটে। কীভাবে পাখি তার ডানায় ভর করে শূন্যের ওপর স্থির থাকে? এ প্রশ্নের জবাব মেলে আল কোরআনে। ইরাশাদ হয়েছে, ‘তারা কি উড়ন্ত পাখিকে দেখে না? এগুলো আকাশের অন্তরিক্ষে আজ্ঞাধীন রয়েছে। আল্লাহতায়ালাই তাদের স্থির রাখেন। নিশ্চয় এতে বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ সুরা আন নাহল, আয়াত ৭৯। অতিথি পাখিকে ইংরেজিতে বলে ‘মাইগ্রেটরি বার্ড’। এর বাংলা অর্থ পরিযায়ী পাখি। অর্থাৎ যেসব পাখি বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় নিজের দেশ বা এলাকা ছেড়ে বিশেষ প্রয়োজনে অন্য কোনো দেশে বা অন্য কোনো এলাকায় চলে যায় এবং কিছু দিন পর আবার নিজ দেশে ফিরে আসে, তারাই পরিযায়ী পাখি। পৃথিবীতে এমন পরিযায়ী পাখি আছে ৫ লাখের মতো। শুধু ইউরোপ আর এশিয়াতেই আছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। এসব পাখির মধ্যে ১৫০ প্রজাতির পাখি প্রতি বছর শীত নেমে এলে আমাদের দেশে বেড়াতে আসে। কয়েক মাস আমাদের সঙ্গ দিয়ে মার্চ-এপ্রিলের দিকে নিজেদের দেশে ফিরে যায়। প্রশ্ন হতে পারে, ওরা তাহলে আসে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা নিজেদের দিকে তাকালেই পেয়ে যাব। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য আমরা কত রকমের পোশাক পরিধান করি। পাখিদের ওরকম কোনো ব্যবস্থা আছে? নেই বলেই ওরা আমাদের কাছে ছুটে আসে। তা ছাড়া এ সময় শীতপ্রধান দেশগুলোয় খাবারেরও প্রচ- সংকট থাকে। সে জন্যই শীত এলে হিমালয়ের আশপাশের পাখিরা ঝাঁক বেঁধে আমাদের দেশে চলে আসে। প্রত্যাশা তাদের একটাই- আর তা হলো নিরাপদ আশ্রয়। অথচ তাদের সেই প্রত্যাশার চোখে বন্দুকের নল তাক করতে আমাদের বিন্দুমাত্র হাত কাঁপে না। অনিন্দ্যসুন্দর এ পাখির কারুকার্য খচিত ডানা থেকে রক্ত ঝরানোতেই যেন আমাদের যত আনন্দ। সৌন্দর্যের প্রতীক পাখির মায়াবী চাউনিতেও আমাদের অন্তরে সামান্য মায়ার উদ্রেক হয় না। জাগে না মনুষ্যত্ব বা মমত্ববোধ। কতটা নির্দয় হলে অকারণে পাখিদের হত্যা করা যায়! অথচ ইসলাম অকারণে পাখি হত্যাকে করেছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অকারণে পাখি হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তার হিসাব নেবেন।’ নাসায়ি। মনে রাখতে হবে, পাখি আমাদের পরম হিতৈষী, পরোপকারী বন্ধু। পাখি হলো প্রকৃতির কীটনাশক। পাখির সংখ্যা কমে গেলে কীটপতঙ্গের অত্যাচারে ফসল ফলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় পাখির বেঁচে থাকা কতটা গুরুত্ববহ। পাখি আছে বলেই পৃথিবীতে এখনো বৃষ্টি নামে, গাছে ফুল ফুটে, ফল ধরে। ফুলে ফলে সুন্দর হয়ে ওঠে আমাদের পৃথিবী। তাই মানুষের মতো পাখিদের অধিকার আছে এই পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচার। শঙ্কাহীন বিচরণ করার। পাখিরা আসুক। তাদের কলকাকলিতে ভরে উঠুক আমাদের চারপাশ।

 

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাস্সির সোসাইটি।

সর্বশেষ খবর