শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বায়ুদূষণ

আফতাব চৌধুরী

যান্ত্রিক ও নাগরিক সভ্যতার প্রসারের সঙ্গে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ কলকারখানার চিমনি থেকে বেরিয়ে এসে মিশে যায় আমাদের চারপাশে বেষ্টন করে থাকা বায়ুমন্ডলে। এ বায়ুমন্ডলে আশ্রিত ও লালিত এ বিশ্বসভ্যতা। সভ্যতার প্রসার যতটা হয়েছে বিজ্ঞানের অগ্রগতির দীর্ঘ পথ বেয়ে, ঠিক সে পরিমাণেই উপেক্ষিত হয়েছে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফল এ বায়ুদূষণ। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণ আধুনিক বিশ্বমানবের সামনে নিয়ে এসেছে এক নির্মম চ্যালেঞ্জ। পরিবেশ দূষণের মারাত্মক সংকটের কবল থেকে বিশ্বপ্রকৃতি তথা বিশ্বসমাজকে সুরক্ষিত করার এক অতন্দ্র প্রয়াস। আন্তর্জাতিক চেতনার বিকাশের মধ্য দিয়ে এ প্রয়াস প্রশস্ত পথ তৈরি করে নেবে। অনেক আগে ইউরোপ ও আমেরিকায় লক্ষ্য করা হয় বিভিন্ন প্রাকৃতিক অস্বাভাবিকতা। বিশেষত উপসাগরীয় যুদ্ধের ঠিক পর ঘটে যাওয়া কিছু অস্বাভাবিক প্রাকৃতিক অঘটনের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর মানুষ সচেতন হয়ে উঠেছে পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে। তারা সম্মুখীন হচ্ছে নতুন এ প্রশ্নের- বায়ুমন্ডলের বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থগুলোকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রূপান্তরের ক্ষমতা কতটা? বায়ু কি সত্যি দূষণমুক্ত হয়ে পড়েছে? জীবনের প্রবাহে সংকট কি অনিবার্য?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক বায়ু গুণাগুণ বিশ্লেষণের এক দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করে। বর্তমানে পৃথিবীর ৫০টি দেশ এ প্রকল্পের আওতায় এসেছে। বায়ুদূষণ রোধে হচ্ছে নিরন্তর গবেষণা। এর মাধ্যমে অনেক চমকপ্রদ তথ্য/পরিসংখ্যান বেরিয়ে আসছে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর বিজ্ঞানীরা এ পরিসংখ্যানগুলো ব্যবহার করে চলেছেন তাদের গবেষণার কাজে। এতে আবহাওয়া ও জলবায়ু বিদ্যার আধুনিক গবেষণায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। দেখা গেছে কলকারখানা ও শহরের যানবাহনের ধোঁয়া এ দূষণের অন্যতম কারণ। গন্ধক, অক্সাইড, এনও২, এসপিএম, কার্বন মনোক্সাইড ও বিভিন্ন হাইড্রোকার্বন -এসব জীবনের পক্ষে বিপজ্জনক রাসায়নিক ওই ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে আছে যা বায়ুমন্ডলকে একটি বিপজ্জনক অবস্থার দিকে নিয়ে চলেছে।

সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড, এসপিএম ফুসফুসের রোগের প্রকোপ বাড়ার কারণ। শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট বেড়ে যেতে পারে বায়ুতে এসব উপাদান বিপজ্জনক মাত্রায় থাকার ফলে। কার্বন মনোক্সাইড রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা বিপজ্জনক মাত্রায় কমিয়ে আনে। এসপিএমএ মিশে থাকা কালো ধোঁয়া ফুসফুসের রোগের সঙ্গে রক্তশূন্যতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি ঘিরে থাকা যে বায়ুমন্ডল, হুর গবেষণা তাকেই প্রাধান্য দিয়েছে, কারণ এ বায়ুস্তর মানব জীবনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে প্রতি মুহূর্তে সম্পর্কিত। দূষণ স্তরের মাপজোক দিয়ে গবেষণার পাশাপাশি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে কীভাবে এ দূষণকে বিপৎসীমার নিচে নামিয়ে আনা যায়। সালফার ডাইঅক্সাইডের পরিমাণের জন্য অ্যাসিডিমেট্রিক টাইট্রেসন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। এ ছাড়া দূষণমাত্রা নির্ণয়ের জন্য অন্যান্য পদ্ধতি রয়েছে। যেমন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড পদ্ধতি। কনডাকটিমেট্রিক নীতি। এ রকম নানা আধুনিক উপায়ে কাজ চলছে হুর নেতৃত্বে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক আধুনিক যুগের শিল্পবিপ্লবের তরঙ্গে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক কেন্দ্র, যার অধিকাংশ জনবহুল শহরাঞ্চলে। এ বাণিজ্যিক উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর পরিত্যক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ও ধোঁয়া ক্রমে দূষিত করে চলেছে চারপাশের জনবহুল আবাসন স্থানগুলোকে। বায়ুদূষণের মারাত্মক উপাদানগুলো আমাদের দেশের শহরগুলোর বায়ুর নমুনা পরীক্ষায় পাওয়া গেছে। ভারতের নাগপুরের জাতীয় পরিবেশ ইঞ্জিনিয়ার গবেষণা কেন্দ্র (এনইইআরআই) একটি জাতীয় বায়ুসমীক্ষা কর্মসূচি তৈরি করেছে ১৯৮৭ সালে। ১০টি শহরকে এ ব্যাপারে নমুনা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। পরিবেশ দূষণ সম্পর্কিত গবেষণা ক্ষেত্রে এটি এ দেশে প্রথম সংঘটিত প্রচেষ্টা। এ সংস্থা আমাদের চার মাসে বিভিন্ন জায়গার বায়ুস্তরের নমুনা সংগ্রহ করে বায়ু সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার প্রয়োজনে।

এক তথ্যে জানা যায়, সংগৃহীত পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে এসপিএম দূষণ সারা দেশে বিশেষ করে বিভাগীয় শহরগুলোয় লক্ষণীয় মাত্রায় রয়েছে। নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড, রাসায়নিক দূষণ ক্রমে বিপজ্জনক মাত্রায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে এসব এলাকায়। পরিবেশ বিজ্ঞানের এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো দেশে আবাসন ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কাজে লাগছে।

এ ধরনের গবেষণা আমাদের দেশেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের এক নতুন দিগ্দর্শন যন্ত্রের সূচনা দান করবে। বায়ুদূষণের প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বিঘিœত করে বিশ্বসমাজকে সংকটের দিকে নিয়ে চলেছে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা ও জনসাধারণ অবহিত হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক চেতনা ও তথ্য সহমর্মিতার বিকাশ ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে পৃথিবীর মানচিত্রে। সারা পৃথিবীর মানুষ অনুভব করছে এটি এ গ্রহের সবার সমস্যা। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এ সংকট অবসানের জন্য। এ আন্তর্জাতিক চেতনা নিশ্চয় অনেক বড় আশার কথা।

                জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর