সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে ভালো কাজে

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে ভালো কাজে

যুবারা শক্তি। যুব সমাজের প্রজ্বলিত মন সমাজকে যেমনি আলোকিত করতে পারে, তেমনি সমাজ বিনির্মাণে তাদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনে, এমনকি ১৯৭১-এর সশস্ত্র সংগ্রামে যুবকদের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। হোক সে স্কুল-কলেজের ছাত্র অথবা যুব কৃষক, শ্রমিক এমনকি বেকার যুবক। এই যুবকেরা স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামকে বেগবান করেছিল। অনস্বীকার্য এ মন্ত্রে দীক্ষিত করতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য জীবন-যৌবন সবই ত্যাগ করতে হয়েছিল। অনেক হতাশার মধ্যেও আশার আলো ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি শুধু যুব সমাজ নয় পুরো জাতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে প্রজ্ব¡লিত করেছিলেন।

তখনকার সময় পাকিস্তানি নির্যাতনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, যাদের সান্নিধ্য আমরা পেয়েছিলাম তাদের ব্যক্তিত্ব এবং সার্বিক শিক্ষা প্রদান কর্মসূচি আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। সামরিক শাসনকে ভয় না করে তারা ছাত্রদের সামনে সত্য কথাটি বলতে দ্বিধান্বিত ছিলেন না। এক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দর একটি বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই-‘এস, মানুষ হও। ... নিজেদের সংকীর্ণ গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে গিয়ে দেখ, সব জাতি কেমন উন্নতির পথে চলেছে। তোমরা কি মানুষকে ভালোবাস? তোমরা কি দেশকে ভালোবাস? তাহলে এস, আমরা ভালো হওয়ার জন্য-উন্নত হওয়ার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি! পেছনে চেয়েও না-অতি প্রিয় আত্মীয়-স্বজন কাঁদুক, পেছনে চেয়েও না। সামনে এগিয়ে যাও।’ তরুণদের মনে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠা পেতে হলে বিবেকানন্দের কথায় বলব, যুব সমাজকে সব সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। আমার ধারণা, যুব সমাজ হাসতে যেমন জানে, জানে কাঁদতে, কেননা আবেগ তাদের যেভাবে নাড়া দেয়, তার সঠিক বহিঃপ্রকাশও তারা ঘটাতে পারে। যুব সমাজের মনে যা প্রবেশ করানো হয় ঠিক সে রকমই বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।

মানুষের মন অত্যন্ত জটিল। বায়ুকে যেমন আবদ্ধ করে রাখা যায় না, তেমনি চঞ্চল মনকেও আবদ্ধ করা যায় না। আমি নিজে দেখেছি, ভোরে প্রার্থনা করতে বসলে যখন শুধু স্রষ্টার কথা মনে আসার কথা, তখনো চারদিকে থেকে অনেক কিছু মনের ইন্দ্রজালে পাক খেয়ে ঘুরে বেড়ায়। কারণ মানুষের মনের দুটি অংশ। একটি সচেতন মন অপরটি অবচেতন মন। সচেতন মনের চিন্তার খোরাক থাকে, যুক্তি-তর্ক মেনে চলে। সচেতন মন গ্রহণ যেমন করতে পারে, তেমনি পরিত্যাগও করে। অবচেতন মন শুধু গ্রহণ করে, এখানে প্রবেশের কোনো ক্ষমতা থাকে না। যেমন আমরা যদি অবচেতন মনকে শুধু ভয়, সন্দেহ এবং ঘৃণা দিয়ে পরিপূর্ণ করে রাখি তবে দেখা যাবে সেগুলোই হবে এবং বাস্তবতায় রূপ নেবে। অবচেতন মন সচেতন মনের চেয়ে শক্তিশালী। অবচেতন মন যেমন পক্ষে কাজ করে তেমনি বিপক্ষেও কাজ করতে পারে। যেমন একটি বাগান বা কৃষি জমিতে আগাছা জন্মে, পরিচর্যার অভাবে, ঠিক আমাদের মনেও আগাছা জন্মাতে পারে এবং এটা একটা পরির্চযার বিষয়।

আপনার চারপাশে লক্ষ্য করলে দেখবেন কিছু মানুষ খুব সফল এবং কিছু মানুষ ব্যর্থ। কিছু মানুষের মনের জোর খুব বেশি। আপনি হয়তো দেখবেন কিছু মানুষ খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে এমনকি আপনার মা-বাবাও। আপনি তা পারেন না। অনেক মানুষ আছে যারা সহজে ক্লান্ত হয় না। নিজের কাজটুকু এমনকি অন্যের উপকারটুকুও মনোযোগ সহকারে করেন। এখন প্রশ্ন হলো তারা কীভাবে এগুলো করে? তারাও আপনার মতো সাধারণ মানুষ। এত মানসিক শক্তি তারা কোথা থেকে পায়? তারা জানেন তাদের অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের দিয়ে এ কাজ করতে হবে। কীভাবে আপনি অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করবেন। এখানে Dr. Goseph Murphy-এর লেখা বিখ্যাত বই The Power of Sue Conscious Mind এর বিশ্লেষণ অনেক সাহায্য করবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলা হয়ে থাকে মনের শুধু ১০ ভাগ চেতন মন, বাকি ৯০ ভাগই অবচেতন ক্ষমতার অধিকারী। অবচেতন মন, চেতন মনের চেয়ে ৩০ হাজার গুণ ক্ষমতার অধিকারী। যাকে তুলনা করা যায় সমুদ্রে ভাসমান বরফের সঙ্গে-যার শুধু ১০ ভাগ পানির ওপরে, বাকি ৯০ ভাগ পানি পৃষ্ঠের নিচে।

চেতন মনের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হলো, সে যখন জেগে থাকে তখন সে তার ১০ ভাগ চেতনার ক্ষমতা নিয়ে আপনার সঙ্গে যুক্তিপূর্ণ প্রশ্নই শুধু করবে, আপনার সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করবে। অপনি কাজটি করবেন কি করবেন না, সে বিষয় নেই এবং আপনাকে যেমন উদ্বুদ্ধ করে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তেমনি নিজে ও নিজের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করে আপনাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহায্য জোগায়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘এগিয়ে যাও বৎসগণ। সমগ্র জগৎ জ্ঞানালোক চাইছে-উৎসুক নয়নে তার জন্য আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হে বীরহৃদয় যুবকগণ, তোমরা বিশ্বাস কর যে, তোমরা বড় বড় কাজ করার জন্য জন্মেছ। কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকে ভয় পেয়েও না-এমনকি আকাশ থেকে প্রবল বজ্রাঘাত হলেও ভয় পেয়েও না-খাড়া হয়ে ওঠ; ওঠ, কাজ কর।’ তাঁর আহ্বান স্পষ্ট। তিনি বলছেন, যুব সমাজকে সব তর্ক-বিতর্কের ঊর্ধ্বে ওঠে নির্ভয় হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। তিনি এ ইঙ্গিত দিয়েছেন, বজ্রাঘাত এলেও তোমরা নির্ভীক থেক।

অবচেতন মন সম্বন্ধে আমাদের ধারণা মোটেও নেই। কিন্তু সে চেতন মন ও আমাদের শরীর ও স্বাস্থ্যের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলে। অবচেতন মন আমাদের মনের কোন অংশ সেটাও আমরা জানি না। অবচেতন মন আমাদের প্রশ্ন করে না, তক-বিতর্ক করে না, কিন্তু আমাদের বিভিন্ন কাজ, অনুভব-আবেগ, দুঃখ ও বেদনার ওপর প্রভাব ফেলে। এক কথায় অবচেতন মন শিশুর মতো, কোনো যুক্তি-তর্ক মানে না। নিজের ইচ্ছাকে চেতনাশক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করে দেয়। প্রত্যেক মহামানব, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, দার্শনিক স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী তারা কিন্তু জীবনের প্রথমদিকে সাধারণ মানুষ ছিলেন। তাদের সাফল্যের কারণ হলো অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করে কাজ করা। কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল, সেখানে পৌঁছার অদম্য ইচ্ছা ছিল, এবং অবচেতন মনকে অর্থাৎ ৯০ শতাংশকে ১০ শতাংশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ছিল। এই ক্ষমতা তারা অর্জন করেছিল শুধু বহিঃইন্দ্রিয়ের কঠোর নিয়ন্ত্রণ। অবচেতন মনকে সব সময় নিজের নিয়ন্ত্রিত বন্ধু হিসেবে ভাবতে হবে। আপনি প্রতিদিন ঘুমোতে যাওয়ার সময় আপনার পরবর্তী করণীয় হিসেবে আপনার বন্ধু অবচেতন মনকে শুধু স্মরণ করিয়ে দেবেন। কমান্ড দিয়ে রাখুন আগামীকাল আপনার কখন বিছানা ত্যাগ করতে হবে। কখন কী কী কাজ করবেন তার তালিকা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। চেতন মন আপনার সঙ্গে নিদ্রিত থাকে। অবচেতন মন আপনার নিদ্রিত অবস্থায়ও জেগে থাকে। প্রতেকদিন এ রকম কমান্ড দিয়ে রাখলে, সে নিশ্চয়ই আপনার নিয়ন্ত্রণে আসবে। অবচেতন মনকে বন্ধু ভাবুন, দেখবেন বন্ধু থেকে ভালো এবং বিশ্বস্ত বন্ধু হতে শুধু সামান্য সময়ের প্রয়োজন। তখনই আপনার সব অর্জন করতে কোনো বাধা থাকবে না, আসলে বাধাটা থাকে নিজের মনে। কখনো অবচেতন মনে নেগেটিভ বা ঋণাত্মক প্রেরণা দেবেন না। শুধু ধনাত্মক বা পজিটিভ প্রেরণাই তাকে বিশ্বস্ত করে তুলবে। মনে রাখা ভালো, অবচেতন মনের নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে। আমি এ কাজ পারব না, এ কথা ভুলে গিয়ে মনে রাখতে হবে। আমাকে এ কাজ করতে হবে। নতুন নতুন সমস্যার সমাধানের জন্য তাকে উৎসাহ দিতে হবে। দিন শেষে কাজ করে বাড়ি ফেরার পর আপনার আপনজন মা-স্ত্রী বা সন্তান বলল, আপনি এখন আর বাইরে যাবেন না। আপনি ক্লান্ত অথচ চিন্তা করেছিলেন ঘরে ফিরে আপনি একটু চা-পান করে মাঠে খেলতে যাবেন বা বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে যাবেন। আপনি যদি আপনার অবচেতন মনে এ ইমপালস দেন, দেখবেন আপনি ক্লান্ত। আপনি যদি বাসায় ফেরার পূর্ব পর্যন্ত যে রকম ভাবছিলেন, আপনি আরও কিছু কাজ করবেন তাতে দৃঢ় থাকেন তাহলে দেখবেন আপনার চেতন মন, অবচেতন মনকে দমিত করে অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছেন, আপনারও কোনো ক্লান্তিবোধ নেই।

আমরা সব সময় বন্ধুবান্ধব বা নিজের সন্তানদের বলি, তোমাকে দিয়ে এ কাজ হবে না। আপনি এটা গ্রহণ করলেই আপনি হেরে গেলেন, আপনি আপনার চেতন এবং অবচেতন মনকে বলে দিন, আমি একাজ করব এবং সুন্দরভাবে করব তাহলে দেখতে পাবেন, সত্যিই কাজটি আপনি করে ফেলেছেন। আপনার ঘরের মানুষ, নিকটতম বন্ধু বা প্রতিবেশী, আপনাকে কিছু বললে এবং সেটা যদি নেগেটিভ বা ঋণাত্মক হয় তাহলে অবশ্যই ধনাত্মক চেতনা দিয়ে চিন্তা করবেন। এটাই শুধু আপনাকে ভালোভাবে চালাতে পারবে। ঋণাত্মক চিন্তা-চেতনা আপনাকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অতীতে যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেনি এবং ডাক্তার ও রোগীর সংখ্যা কম ছিল তখন কিন্তু মানুষ কিছু বিশ্বাস অবলম্বন করে বেঁচে যেত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ওই সময় সব দেশের মানুষ অসুস্থ হলে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা এবং ওদের পুরোহিতদের কাছে যেতেন, সাধু-সন্ত, সুফি-হুজুর, দরগায় গিয়ে মানত করতেন তাবিজ-কবজ-আংটি আনতেন। এসব ব্যবহার করে তারা ভালো হয়ে যেতেন। অবচেতন মনের শক্তি তাদের সুস্থ করে তুলত। এ অবচেতন মন আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে, বর্তমান যুগে ডাক্তারের কাছে না গেলে বা ওষুধ না খেলে রোগ ভালো হবে না। এখনো অনেকে এ প্রাচীন পদ্ধতি বিশ্বাস করেন।

এখানে একটি দরগা এবং একটি পুকুরের কথা বলছি। দরগাটি আমাদের গ্রামের, পুকুরটি ভারতে অবস্থিত। মানত করে ওই দরগায় মোমবাতি জ্বালালে সব অসুখ-বিসুখ ভালো হয়ে যেত এবং ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা পূর্ণ হতো। যে পুকুর ভারতে অবস্থিত সেটির তথ্য ভুলে গেছি এবং আর্কাইভ থেকেও সংগ্রহ করতে পারিনি। সেই পুকুরে ¯œানের জন্য আমার দাদু প্রতি বছর শীতকালে গিয়ে ¯œান করতেন বাতের ব্যথা সারানোর জন্য, হয়তো কিছু সেরেও যেত। আমার ধারণা অবচেতন মন সব সময় বলতে থাকে তোমার বাতের ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ রাইট ভ্রাতৃদ্বয় মানুষকে আকাশে উড়াচ্ছেন। এডিসন বৈদ্যুতিক আলো জ্বালিয়েছেন। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ঘর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে দূর আলাপনীর মাধ্যমে কথা বলতে শিখিয়েছেন। এখানেও কিন্তু অবচেতন মনের বিশাল ভূমিকা আছে। আমি পারব চিন্তাকে বাস্তবে রূপদান করতে! এ ভাবনা তাঁদের জয়ী করেছে। তারা যখন এসব কীর্তি আবিষ্কার করেন, তখনো তাদের যুবক বলেই গণ্য করা যায়। সচেতন বা অবচেতন মন সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের এক মহান উক্তি- ‘মন মানুষকে জ্ঞানী বা অজ্ঞানী করে, মন মানুষকে আবদ্ধ বা মুক্ত করে। কেউ পবিত্র হয় মনের জন্য, দুষ্ট হয় মনের জন্য। যে মন মানুষকে পাপী করে, সেই মনই মানুষকে ধার্মিক করে তোলে।’ এ জন্য তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে ভালো কাজে, তাহলে তারা দেশপ্রেমী হবে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর