মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সত্যিই বঙ্গবন্ধু ভুল করলে আমাদের কী হতো...

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

সত্যিই বঙ্গবন্ধু ভুল করলে আমাদের কী হতো...

দেখতে দেখতে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর শেষ হতে চলেছে, সঙ্গে বছরও। আজ কদিন থেকেই ভাবছি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুই কথা লিখি। যে বঙ্গবন্ধু না হলে, যার নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব না হলে হয়তো আজও আমরা পরাধীন থাকতাম, পাকিস্তানের দাস থাকতাম। সেই বঙ্গবন্ধুর পদে পদে ভুল ধরা হয় তাঁরই ত্যাগে স্বাধীন দেশে বাস করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগ নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে কেন মন্ত্রী বানিয়ে ছিলেন তা তিনিই জানেন, আমি জানি না। সেই এ কে খন্দকারের শেষ বয়সে বই লেখার শখ হয়েছিল। তাঁর ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’-তে যা লিখেছেন তাতে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেরও ভুল ধরেছেন। সারা বিশ্ব যে ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়েছে সে ভাষণের ভুল ধরতে এ কে খন্দকারের একটুও বাধেনি! এক নম্বর ভুল, তিনি ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করে দিলে এত লোক মরত না। পাকিস্তানি হানাদাররা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরোবারই সুযোগ পেত না। কিন্তু কী করে হানাদারদের ফেরাতেন তা তিনি বলেননি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন ওই উদ্যানের ওপর দুটি হেলিকপ্টার উড়ছিল। হেলিকপ্টারে মেশিনগান, রকেট ছিল। কী জন্য মেশিনগান ও রকেট নিয়ে ২০-২৫ লাখ মানুষের সমাবেশের ওপর পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের হেলিকপ্টার উড়ছিল তা সবাই জানে। শুধু হেলিকপ্টার নয়, এ কে খন্দকার তখন পূর্ব পাকিস্তানে বিমানবাহিনীর সব থেকে বড় কর্মকর্তা। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ছয়টি যুদ্ধবিমান তেজগাঁও বিমানবন্দরে তৈরি ছিল। কীসের জন্য তৈরি ছিল তা তিনি বলেননি। বোমা নিয়ে ছয়টি যুদ্ধবিমান নিশ্চয়ই হাওয়া খাওয়ার জন্য তৈরি ছিল না। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ যদি এ কে খন্দকারকে যুদ্ধবিমান উড়িয়ে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বোমা ফেলতে বলতেন তিনি যে বোমা ফেলতেন না তার কী গ্যারান্টি ছিল? ৭ মার্চ বা তার আগে সশস্ত্র বাহিনীতে যে বাঙালিরা কর্মরত ছিল তার একজনও আমাদের সঙ্গে যোগদান করেননি। সাবেক সৈনিকরা, সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক যোদ্ধারা কেউ কেউ দলবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আনুগত্য প্রকাশ করলেও পাকিস্তানের অধীনে কর্মরত কোনো বাঙালি ৭ মার্চের পরও বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে একাত্মতা ঘোষণা করেননি- সে জয়দেবপুরে দ্বিতীয় বেঙ্গলই হোক, কুমিল্লার চতুর্থ বেঙ্গল কিংবা চট্টগ্রামের অষ্টম বেঙ্গল বা অন্যান্য বাহিনী। চট্টগ্রামে নবগঠিত অষ্টম বেঙ্গলের টুআইসি ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। অষ্টম বেঙ্গলের যিনি সিও ছিলেন তিনি কোনো দিনই বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেননি, দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারও করেননি, চতুর্থ বেঙ্গলেরও না, যশোরে যারা ছিলেন তারাও না। ২৫ মার্চের আগে ঢাকা থেকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবার জয়দেবপুরের দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে গেলে টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সাধারণ মানুষ রুখে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এখনো বেঁচে আছেন। সত্য বলার সাহস থাকলে তিনি নিশ্চয়ই বলতে পারবেন। সেটা ছিল ১৯ মার্চ। জাহানজেব আরবার দলবল নিয়ে জয়দেবপুর যাওয়ার পথে তেমন বিপত্তি ঘটেনি, বিপত্তি ঘটেছিল যখন জয়দেবপুরের মানুষ শুনতে পায় বাঙালি সৈন্যদের অস্ত্র কেড়ে নিতে ঢাকা থেকে জাহানজেব আরবার জয়দেবপুরে গেছে তখন চারদিক থেকে বীর জনতা ছুটে যায়। যার নেতৃত্বে আ ক ম মোজাম্মেল ছিলেন। বীর জনতা যখন সমস্ত রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিয়েছিল তখন ব্রিগেডিয়ার আরবার মেজর শফিউল্লাহকে রাস্তা মুক্ত করে তাদের নিরাপদে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। বাধ্য হয়েই হোক আর পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য থেকেই হোক মেজর শফিউল্লাহর নির্দেশে রাস্তা মুক্ত করতে গুলি চালানো হয়েছিল। যে গুলিতে কয়েকজন মারা গিয়েছিল। ১৯ তারিখ যে সেনাবাহিনীর বাঙালিরা পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ারের নির্দেশে গুলি চালাতে পারে বা চালায় ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে হেলিকপ্টার থেকে আসা মেশিনগানের গুলি কে ফেরাত? ছয়টি যুদ্ধবিমান যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লাখো মানুষের ওপর বোমা ফেলতে উড়ে আসত না তা কে বলবে? যারা বঙ্গবন্ধুর অমন আহ্বানের পরও ১৯ মার্চ বীর জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে তারা ঘোষণা দিলেই পাকিস্তানিদের কবজা করে ফেলত তা বোকার স্বর্গে বাস করেও বিশ্বাস করা যায় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১৩-১৪ জন সাধারণ সৈনিক ১৩-১৪ মার্চ চৌরাস্তার কাছে বীর জনতার মিছিলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পথে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের সঙ্গে শরিক হয়েছিল। এ সৈনিকরা এক মাস আগে থেকে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জে ছিল। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বাঙালি সৈনিকদের অনেক আগেই ক্যান্টনমেন্টের বাইরে বের করে দিয়েছিল যাতে তারা কোনো গোলমাল করতে না পারে। উপরন্তু মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো বাঙালি সৈন্যদের দিয়ে আন্দোলন দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। যার উজ্জ্বল প্রমাণ ১৯ মার্চ ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের নির্দেশে মেজর শফিউল্লাহ তাঁর বাহিনীকে গুলি চালাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। যে ১৩-১৪ জন বাঙালি সৈনিক ময়মনসিংহ থেকে ফেরার পথে মিছিলকারীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এবং ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত বীর জনতাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করেছিলেন যদি আমরা যুদ্ধজয়ী না হতাম, বাংলাদেশ না হতো কমান্ড ভেঙে জনতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় পাকিস্তান কাঠামোয় তাদের ফাঁসি হতো। এ তো গেল জয়দেবপুর। কুমিল্লার চতুর্থ বেঙ্গলের খালেদ মোশাররফ, শাফায়েত জামিল ও অন্যরা। তাদেরও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে সীমান্তে পাঠানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ভারতীয় নকশালবাদীরা সীমান্ত অতিক্রম করেছে তাদের মোকাবিলা করতে হবে। চতুর্থ বেঙ্গলের অবাঙালি সি ও তাদের সঙ্গে ছিলেন। যাকে শাফায়েত জামিল, খালেদ মোশাররফের লোকেরা ২৫ তারিখ রাতে হত্যা করেছিলেন। শুধু কমান্ডিং অফিসারকে নয়, চতুর্থ বেঙ্গলের সঙ্গে যে কজন অবাঙালি ছিলেন তাদের সবাইকে হত্যা করেছিলেন। অন্যদিকে ২৫ মার্চ অষ্টম বেঙ্গলের সহঅধিনায়ক বা সেকেন্ড ইন কমান্ড পাকিস্তানি কমান্ডের হুকুমে চট্টগ্রাম জেটিতে যাচ্ছিলেন অস্ত্র খালাসের জন্য। সেখান থেকে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং তিনি বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরের ইতিহাস সবার জানা। ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা যদি ওভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানার ইপিআর ব্যারাক, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ঝাঁপিয়ে না পড়ত তাহলে কি সবাই বাংলাদেশের পক্ষে অস্ত্র ধরত? একেবারে হলফ করে বলা যায় না। তাই সবকিছুরই একটা পরিবেশ লাগে, একটা সময় লাগে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই সময়ের একজন উপযুক্ত নেতা। যখন যা করার উপযুক্ত ছিল তা তিনি ঠিকঠাকমতো করেছিলেন বলেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। যদি ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা সর্বোপরি ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এককভাবে নেতৃত্বে বেরিয়ে না আসতেন তাহলে ওভাবে সবাই বঙ্গবন্ধুর পেছনে কাতারবদ্ধ হতো না। যদি রাজারবাগে পাকিস্তান হানাদাররা নির্বিচার গোলাবর্ষণ না করত, পিলখানায় ওভাবে হত্যাযজ্ঞ না চালাত তাহলে সব ইপিআর, সব পুলিশ আমাদের পক্ষে অস্ত্র ধরত- এটা বিশ্বাস করা যায়? আমি তো দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্তরাই ভয়ে বেশি বিরোধিতা করত। পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলে নিজেদের জান বাঁচাতে চাইত। কিন্তু আমরা দু-চারটা ছোটখাটো যুদ্ধে জয়ী হলে সাধারণ মানুষ যেমন সাহস পায় তেমনি আওয়ামী লীগের লোকেরাও। যুদ্ধের শুরুতে আমার একেবারে প্রিয় সহকর্মীদেরও খুঁজে পাইনি। প্রায় সবাই পালিয়ে বেরিয়েছে। অনেকে তো এও বলেছে, কাদের সিদ্দিকী একটা অপরিণামদর্শী মানুষ। সে নিজেও মরবে, আমাদেরও মারবে। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু যে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, ঘুরিয়ে অন্যভাবে তার চাইতে অনেক বেশি দিয়েছিলেন তা আমরা বুঝেছিলাম। সামরিক বাহিনীর দু-চার জন নাও বুঝতে পারেন, আমাদের বুঝতে বাকি ছিল না। আমরা যে বুঝেছিলাম তা তো কর্মক্ষেত্রেই দেখিয়েছি। সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনীর প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে। বিশ্বশান্তি স্থাপনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সেনা-পুলিশ-নৌ-বিমান বা অন্য যারাই গেছে তাদের সুনামে আমাদের বুক ভরে যায়। তাই বঙ্গবন্ধু যদি ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন তাহলে ওই সভাতেই কয়েক লাখ লোক মারা যেত। পৃথিবীর সবচাইতে বড় রক্তপাত হতো। ঝড়-তুফান থেমে গেলে অনেক বড় বড় কথা বলা যায়। কিন্তু ঝড়-তুফানে প্রকৃত মাঝির কৃতিত্ব বোঝা যায়। তা বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বে আমাদের সঠিকভাবে বুঝিয়েছিলেন। ত্রুটিহীন নেতৃত্ব কাকে বলে তা ভাবীকালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যখন গবেষণা হবে, চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে তখন তাঁর অপরিসীম দক্ষতা-যোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তিনি যদি এখনকার মতো মাথা গরম কাঁচা খেলোয়াড় হতেন তাহলে ইয়াহিয়ার সঙ্গে পেরে উঠতেন না। আচ্ছা, যদি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা থেকে নীরবে নিভৃতে ধীরে সুস্থে ভদ্রলোকের মতো সীমান্তে যেত তাহলে কি বাড়িঘর ছেড়ে এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিত? পাকিস্তানিরা পদে পদে ভুল করেছে। তারা বুদ্ধি দিয়ে নয়, শক্তি দিয়ে সবকিছু দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। একদিন তাদের পাতা ফাঁদেই তারা পড়েছে এবং পরাজিত হয়েছে। তারা গোলাগুলি করে আকাশ-বাতাস দিগি¦দিক কাঁপিয়ে না গেলে লাখ লাখ মানুষ সীমান্তে যেত না। যদি তা না যেত তাহলে ভারতের জন্য একটা অস্বস্তিকর আইনশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতো না। গোলাগুলি করে দিগি¦দিক কাঁপিয়ে সীমান্তে গিয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা ভেবেছে বাঙালিদের শত বছরের জন্য ইঁদুরের গর্তে ঢুকিয়ে দিলাম। দেশবাসীর কারও জীবনের কোনো নিরাপত্তা না থাকা পাকিস্তানিদের জন্য কাল হয়েছিল। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যমুনা-ব্রহ্মপুত্র দিয়ে পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলেন আসামে, যে আসাম তিনি ছেড়েছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টির সময়। যদি মওলানা ভাসানী আমাদের সঙ্গে না থাকতেন, আমাদের পাশে না দাঁড়াতেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধ করা কি খুব সহজ হতো? এখন আওয়ামী ভাবাপন্ন অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন মওলানা ভাসানী আবার কী। কিন্তু আমরা জানি মওলানা ভাসানী আমাদের পক্ষে না থেকে বিপক্ষে দাঁড়ালে কী হতো।

কেউ কেউ  বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যুদ্ধ চাননি, তিনি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেননি, ইচ্ছা করে পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। যে যাই বলুন, শেখ মুজিব মাথা নোয়াবার মানুষ ছিলেন না। তিনি বাড়ি ছাড়েননি এটা শাশ্বত সত্য। পাকিস্তানের হাতে তাঁর ধরা দেওয়া সেটাও ছিল এক মস্তবড় সফল রাজনীতি। সেদিন পাকিস্তানি হানাদাররা যদি ধানমন্ডির বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে না পেত তারা কি অস্ত্র গুটিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেত, নাকি গোলাগুলি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েই যেত? বঙ্গবন্ধুকে জীবিত অথবা মৃত যতক্ষণ না ধরতে পেত ততক্ষণ ২৫ মার্চ রাতের মতো দেশের সর্বত্র বঙ্গবন্ধুকে খুঁজত, জ্বালাও-পোড়াও আর হত্যা করত। ৭ মার্চে যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেললে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে অবস্থা হতো ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে না পেলে পাকিস্তান হানাদাররা ওই একই কাজ করত। দেশের নানা শহরে বঙ্গবন্ধুকে খোঁজার নাম করে রাতদিন ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাত। ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে হাতে পেয়ে অনেকটাই আশ্বস্ত হয়েছিল যে মূল নেতাকে ধরেছি। এখন দু-চারটা গুলি ফোটালেই বাঙালিরা ইঁদুরের গর্তে লুকাবে। সে ভরসাতেই ওভাবে চারদিকে জ্বালাও-পোড়াও করতে করতে সীমান্ত পর্যন্ত গিয়েছিল। পাকিস্তানিরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ভেবেছে বাঙালিদের ভয় দেখিয়ে চিরতরে স্তব্ধ করে দেবে। বেশি ভয় দেখানো ভালো নয়। ভয় পেতে পেতে একসময় নিরুপায় মানুষ সাহসী হয়ে ওঠে। সেটাই মুক্তিযুদ্ধে আমরা করে দেখিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের কারাগারে থাকা আমাদের জন্য শাপেবর হয়েছিল। প্রায় সব সময় মনে হয়েছে বিশেষ করে আমরা যারা অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম তারা যুদ্ধে জয়ী হতে না পারলে, পাকিস্তানিদের পরাজিত করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাব না। তাই শোকও যে কখনো কখনো শক্তিতে পরিণত হয় পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বন্দী থাকাও আমাদের জন্য ছিল এক মহাশক্তি। প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অন্তর কাঁদত বঙ্গবন্ধুর জন্য। তাই মুক্তিযোদ্ধারা যেমন মনেপ্রাণে যুদ্ধ করেছে আত্মিক তাগিদে তেমনি ধীরে ধীরে দেশের মানুষও বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়ার তীব্র বাসনায় সর্বস্ব ত্যাগ করেছে, যে যেভাবে পেরেছে যুদ্ধে সাহায্য করেছে। আমি জানি না পৃথিবীর আর কোথাও কোনো নেতার জন্য সাধারণ মানুষ কখনো অতটা উদ্বেল ছিল কিনা। এক পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার অবসর জীবনে লিখতে বাধ্য হয়েছেন, ’৭১-এ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তার তিন-চার বছরের বাচ্চাও দিনরাত সারা ঘরময় ‘জয় বাংলা জয় বাংলা’ বলে মাতিয়ে রাখত। কত বাঙালি বঙ্গবন্ধুর জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করেছে। খুব কম মা-বোন ছিলেন যারা জায়নামাজে বঙ্গবন্ধুর জীবন প্রার্থনা করেননি। সৃষ্টির প্রার্থনা স্রষ্টা অস্বীকার করতে পারেন না। তাই পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর জীবনহানি করতে পারেনি। তাই আমরা স্বাধীন হয়েছি, পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়েছে। প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রবলের দিক থেকে আমরা পাকিস্তানের কাছে শত-সহস্র গুণ পশ্চাৎপদ ছিলাম। তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ বাহিনী আমাদের কাছে পরাজিত হয়েছিল। তাদের কোনো ন্যায়নীতি ছিল না, কোনো নৈতিকতা বা আদর্শ ছিল না। তাদের অত্যাচারে আল্লাহর আরশ কেঁপেছে। তাই পরম প্রভু আল্লাহ আমাদের দয়া করেছেন, আমরা বিজয়ী হয়েছি।

আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকায় আমাদের অন্তরাত্মার জ্বলন বেড়েছে হাজার গুণ। আমাদের নেতৃবৃন্দ নিশ্চয়ই যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেননি। কিন্তু তাই বলে তাঁরা তাঁদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব করতে কখনো ভুল করেননি। বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে গিয়েছিলেন। আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, অন্যান্য এমএনএ-এমপি ভারতে যাওয়ায়। কিন্তু আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি ভারতে যেতেন তাহলে তাতে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি না হয়ে খর্ব হতো। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন, তাঁকে বিচারের নামে প্রহসন করে ’৭১-এর আগস্টে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল তাতে জ্বলন আমাদের আরও বেড়েছিল। যদি পালিয়ে থাকতেন, কোনো নিরাপদ জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেন, সে যেখানেই হোক পাকিস্তানি হানাদাররা বলত বঙ্গবন্ধু ভারতে, ভারতের দালাল, ভারতের লেলিয়ে দেওয়া...।

পাকিস্তানি প্রশাসন মানুষকে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়ত। আর বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন বা অন্য নেতৃবৃন্দ ভারতে যাওয়ায় আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ভারতে গেলে কি আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হতো? কিছুতেই না। বঙ্গবন্ধু ভারতে গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ভারতের কারসাজি বলে চালিয়ে দেওয়া হতো এবং মানুষ তা বিশ্বাস করত। আমরাও সাধারণ মানুষের অন্তরে ঠাঁই পেতাম না। ভারতের দালালদের এ দেশের মানুষ কোনোমতেই বুকে ঠাঁই দিত না, আগলে নিত না। সে জন্য বঙ্গতাজের ভারতে যাওয়ায় শক্তি, বঙ্গবন্ধুর ভারতে আশ্রয় নেওয়া আমাদের জন্য ছিল দুর্বলতা। এটা আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু কারাগারে না থেকে পৃথিবীর যেখানেই থাকতেন আমাদের সবলতার চাইতে তা দুর্বলতা হতো। ইংল্যান্ড-আমেরিকা-কানাডা-জাপান-জার্মানি-ইতালি-ফ্রান্স এসব দেশে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করলে তাও অনেক কথা হতো। কিন্তু ভারতে আশ্রয় নিলে শত বছরেও আমরা স্বাধীন হতে পারতাম না- এটাই বাস্তব সত্য।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর