বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

রক্তাক্ত বেলুচিস্তান

রক্তাক্ত বেলুচিস্তান

ডিসেম্বর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের এ মাসে পাকিস্তানি দখলদারদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। বাংলাদেশের মতো বেলুচিস্তানেও মুক্তিযুদ্ধ চলছে সাত দশক ধরে। তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে ধোঁকা দিয়ে ওই এলাকাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকে। বেলুচরা ইরান থেকে আসা আর্য এবং স্থানীয় আদিবাসী দ্রাবিড়দের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এক জাতি। সিন্ধু সভ্যতারও আগে ভারতবর্ষে যে কৃষিনির্ভর সভ্যতার বিকাশ হয় তার উদ্ভব  বেলুচিস্তানে। বেলুচদের উদ্ভব সম্পর্কে প্রচলিত এ তত্ত্ব নিয়ে ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ কিছুটা দ্বিমত পোষণ করলেও তা খুব একটা জোরালো নয়। ভারতের দক্ষিণাংশ থেকে সিন্ধু উপত্যকা পেরিয়ে পশ্চিমে চলে যাওয়া দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর একটি শাখার সঙ্গে মধ্য এশিয়ার দিক থেকে আসা একটি জনজাতির জিনগত মিশ্রণেই যে বেলুচদের উদ্ভব, তা নিয়ে ইতিহাসবিদ মহলে খুব একটা দ্বিমত নেই।

১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম বা সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন জেঁকে বসে। তখনো বেলুচ রাজ্যগুলো নিজেদের মতো করে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে বেলুচরা প্রথম নতি স্বীকার করে ১৮৭৬ সালে সিপাহি বিদ্রোহের ১৯ বছর পর। কালাত চুক্তির মাধ্যমে চার স্বাধীন শাসকের আওতাধীন চারটি বেলুচ রাজ্য কালাত, খারন, মাকরান ও লাসবেলা ব্রিটিশ বশ্যতা স্বীকার করে। এ চারটি অঞ্চলই ছিল বেলুচিস্তানের মূল অংশ। আফগান আমিরের শাসনাধীন বেলুচিস্তানের অন্য একটি অংশ ছিল কোয়েটা, পিসিন, হরনাই, সিবিসহ কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত। আফগানদের নিয়ন্ত্রিত সে এলাকা স্বাধীন বেলুচ রাজ্যগুলোর চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র ছিল। ১৮৭৯ সালে দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধে আফগানিস্তানের পরাজয় হয়। আফগান আমির ওই অঞ্চলগুলো ভেট হিসেবে ব্রিটিশের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন।

বেলুচিস্তানের চার স্বাধীন রাজ্য ব্রিটিশের বশ্যতা স্বীকার করলেও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কখনই ছেড়ে দেয়নি। বেলুচিস্তানের যে অংশ সরাসরি ব্রিটিশের হাতে ছিল, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের সময় ব্রিটিশ শাসকরা সে অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে। যে চারটি স্বাধীন বেলুচ রাজ্য ব্রিটিশের বশ্যতা স্বীকার করেছিল, ভারত ভাগের পর তারা স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখে। পরে একদিকে সামরিক চাপ অন্যদিকে জিন্নাহর প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে শর্ত সাপেক্ষে তারা পাকিস্তানে যোগ দেয়। কালাতের শাসক বা খানের সঙ্গে ১৯৪৮ সালে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে স্বাধীন বেলুচ রাজ্যটিকে পাকিস্তান সরকার আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দেয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ ওয়াদা দেন। অর্থনীতি, বিদেশনীতি, প্রতিরক্ষা শুধু এ তিনটি বিষয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে চুক্তি হয়। বাকি সব বেলুচদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে স্থির হয়। পাকিস্তান পরবর্তীকালে সে চুক্তির শর্ত আর মানেনি। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হবে বলে যে চুক্তি হয়েছিল, তা পাকিস্তান মানতে অস্বীকার করলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বেলুচরা। এ বিশ্বাসঘাতকতাই স্বাধীনচেতা বেলুচদের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সেই শুরু হওয়া মুক্তির লড়াই আজও চলছে।

বেলুচিস্তানে পাকিস্তানি দখলদারিত্বের পর থেকে একের পর বিদ্রোহ হয়েছে। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ১৯৪৮ সালেই প্রথমবার বিদ্রোহ শুরু হয়। চুক্তিভঙ্গের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বেলুচরা। তারপর ১৯৫৮ থেকে ’৫৯, ’৬২ থেকে ’৬৩ এবং ’৭৩ থেকে ’৭৭ পর্যন্ত বারবার দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বেলুচ বিদ্রোহীরা। নির্মম দমননীতি চালিয়ে, বিদ্রোহ দমিয়ে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে পাকিস্তান।

২০০৩ সালে বেলুচরা আবারও আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই শুরু করেছে। পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ শক্তিবলে বেলুচ বিদ্রোহ সম্পূর্ণ শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নেন। বেলুচ নেতা নবাব আকবর বুগতিকে ২০০৬ সালে একটি পাহাড়ের গুহার মধ্যে অবরুদ্ধ করে নির্মমভাবে খুন করে পাক সেনা। পাকিস্তানি শাসকরা ভেবেছিল আকবর বুগতিকে খুন করতে পারলেই শেষ হয়ে যাবে বিদ্রোহ। কিন্তু তাদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বিদ্রোহের আগুন তারপর দাবানলের মতো ছড়িয়েছে পাকিস্তানিদের বৃহত্তম প্রদেশ বেলুচিস্তানজুড়ে। স্বাধীনতার দাবি দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে বুগতির হত্যার পর থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির বদলে স্বাধীনতার সংগ্রামে। পাকিস্তান সরকার যে দমননীতি চালাচ্ছে বেলুচিস্তানে তাতে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণাই শুধু জমছে। উজ্জীবিত হয়ে ওঠা এ বিদ্রোহীদের রোখা যে আরও কঠিন হয়ে উঠেছে, তা পাকিস্তানি শাসকদের কাছেও স্পষ্ট। স্বাধীনতার লড়াই আড়াল করে ভারতকে দোষারোপের পথ বেছে নিয়েছে পাকিস্তান।

-আজিম উদ্দিন আহমেদ

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর