শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

একি বললেন ডা. জাফরুল্লাহ

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

একি বললেন ডা. জাফরুল্লাহ

ডা. জাফরুল্লাহর প্রতি আমার শ্রদ্ধার ঘাটতি নেই। কারণ তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং তিনি তাঁর নিজ রাজনৈতিক দল বিএনপির সমালোচনা করতেও ছাড়েন না। কিন্তু তিনি মাঝেমধ্যে খেই হারিয়ে ফেলেন। গত ২০ ডিসেম্বরও তিনি খেই হারিয়ে মারাত্মকভাবে ভ্রমাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন যাকে অবান্তর বলা যায়। এ ব্যাপারে কিছু লিখব কিনা তা নিয়ে আমি দ্বিধান্বিত থাকলেও ইতিহাস বিকৃতি রোধেই লেখার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিলাম, কেননা ডা. জাফরুল্লাহ একজন খ্যাতিমান লোক হওয়ায় মানুষ তাঁর কথা বেদবাক্য হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর প্রদত্ত অবিশ্বাস্য বক্তব্যকেই বিশ্বাস করতে পারে।

তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান কারাগার থেকে জীবিত ফেরত পাওয়ার মূল কাজটি করেছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও স্যার ফজলে হাসান আবেদ ভাই। ডা. জাফরুল্লাহ আরও বলেছেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ ’৭১-এ ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন করেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিয়ে সারা বিশ্বে আমাদের দুঃখের কাহিনি পরিচয় করান।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ আমাদের গর্ব, আমাদের সবারই অতি শ্রদ্ধার পাত্র। বিশ্বের বৃহত্তম এনজিওর স্রষ্টা এবং প্রতিপালক হিসেবে তিনি দেশের বহু হতদরিদ্রের কর্মসংস্থান করে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি একমাত্র বাংলাদেশি যিনি ব্রিটিশ রানীর থেকে নাইটহুড পেয়েছেন। বেঁচে থাকলে হয়তো নোবেলও পেতে পারতেন, কেননা ড. ইউনূসের থেকে স্যার আবেদের অবদান অনেক বেশি। ড. ইউনূস বিতর্কিত, কিন্তু স্যার আবেদের কর্মকান্ড ছিল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু যে সময়ের কথা ডা. জাফরুল্লাহ বলেছেন, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে ফজলে হাসান আবেদ, যাকে আমি তখন থেকেই আবেদ ভাই বলে ডাকতাম, স্যার ফজলে হাসান আবেদ হয়ে ওঠেননি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তো দূরের কথা, তিনি তখন জাতীয়ভাবেও পরিচিত ছিলেন না, ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ, সুতরাং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য কিছু করার মতো অবস্থানে বা মর্যাদায় তিনি তখন মোটেও ছিলেন না। দেশে-বিদেশে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর সৃষ্ট ‘ব্র্যাক’-এর অভূতপূর্ব সাফল্যের সঙ্গে, যা ঘটেছিল ’৭১-এর অনেক বছর পরে। ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামক ইংরেজদের গড়া মুক্তিসংগ্রাম সংস্থা যে মোটেও আবেদ ভাই সৃষ্টি করেননি এবং এ ব্যাপারে ডা. জাফরুল্লাহ যে ভুল বলেছেন তা আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেবের লেখা বই ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’, ‘৭১ বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের জন্য পঠিত’ স্টিয়ারিং কমিটির পাঁচ সদস্যের অন্যতম শেখ আবদুল মান্নানের বই ‘মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বাঙালির অবদান’, ডা. জাফরুল্লাহর দলেরই এক নেতা ড. খন্দকার মোশাররফের ‘মুক্তিযুদ্ধে বিলেতে প্রবাসীদের অবদান’ এবং খ্যাতনামা বঙ্গবন্ধু গবেষক আবদুল মতিন সাহেবের বই ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি’ থেকেই পরিষ্কার এবং তাই আমি এ কটি বই থেকে নিচে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর বইয়ের ৪৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আমাদের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর পরই কয়েকজন উৎসাহী ইংরেজ তরুণ-তরুণী “বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি” নামে একটি কর্মচঞ্চল সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। পল কনেট এবং ম্যারিয়েটা এই সংগঠনের নেতৃত্ব দান করেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন উৎসাহী ইংরেজ কর্মী।’ তাঁর বইয়ের ৮৫ পৃষ্ঠায় বিচারপতি চৌধুরী লিখেছেন, ‘ইংল্যান্ডে বাঙালি পরিচালিত অনেক সমিতি ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও “অ্যাকশন বাংলাদেশ” নামে একটি প্রতিষ্ঠান শুধু ইংরেজ তরুণ-তরুণীদের নিয়েই গঠিত হয়। এর কমিটির প্রধান ছিলেন পল কনেট।’

 

স্টিয়ারিং কমিটির শেখ আবদুল মান্নান তাঁর উল্লিখিত বইয়ের ৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২০ এপ্রিল বাংলাদেশ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ সাহায্যদানের কর্মসূচি তৈরি করার জন্য “পিস নিউজ” পত্রিকার অফিসে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন পল কনেট, মিস ম্যারিয়েটা প্রকোপে ও পিস নিউজের সম্পাদক। বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) ও খন্দকার মোশাররফ এ বৈঠকে যোগ দেন। কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার পর “অ্যাকশন বাংলাদেশ” নামের একটি সংস্থা গঠন করা হয়। পল কনেটের নেতৃত্বে ম্যারিয়েটা এ সংস্থার সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।’

বঙ্গবন্ধু গবেষক আবদুল মতিন তাঁর উল্লিখিত বইয়ের ৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘ইতিপূর্বে বাংলাদেশ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ সাহায্য দানের কর্মসূচি তৈরি করার জন্য পাক্ষিক “পিস নিউজ” পত্রিকার অফিসে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন পল কনেট, মিস ম্যারিয়েটা প্রকোপে ও পত্রিকাটির সম্পাদক। যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) ও খন্দকার মোশাররফ এ বৈঠকে যোগ দেন। কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর “অ্যাকশন বাংলাদেশ” নামক একটি সংস্থা গঠন করা হয়। পল কনেটের নেতৃত্বে ম্যারিয়েটা এ সংস্থার সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি তাঁর উৎসাহের কারণ সম্পর্কে শামসুদ্দিন চৌধুরীর প্রশ্নের উত্তরে ম্যারিয়েটা বলেন “যেখানে একটি পশুশক্তি এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিঃসহায় মানুষগুলোর ওপর সেখানে কী করে অন্য দেশের মানুষেরা বসে থাকতে পারে। মানুষকে তার দেশ গোত্রের ভিত্তিতে আলাদা করে দেখাটা মস্তবড় অন্যায় নয় কি?”’

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তাঁর বইয়ের ৭১ পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন তা হলো, ‘আগস্ট মাসের প্রথম দিন লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবিতে এক ব্যতিক্রমধর্মী ও গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এত দিন যত সভা-সমাবেশ হয়েছে তা বাঙালিদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ১ আগস্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করে লন্ডন এন ডব্লিউ-১-এর ৩৪ নম্বর স্টার্টফোর্ড ভিলাস্থ “অ্যাকশন বাংলাদেশ” নামে একটি স্থানীয় সংগঠন। যুবনেতা পল কনেটের নেতৃত্বে এবং ব্রিটিশ এমপি, সমাজকর্মী ও আইনজীবী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে উক্ত সংগঠনটি লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।’ ওপরে উদ্ধৃত করা চারজন অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং ওয়াকিবহাল ব্যক্তির লেখা থেকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটি ফজলে হাসান আবেদ গঠন করেছিলেন বলে ডা. জাফরুল্লাহ যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ অসত্য।

আসলে ’৭১-এর ২০ এপ্রিল যুক্তরাজ্য ছাত্রসংগ্রাম পরিষদে, যেটি ছিল বাংলাদেশ আন্দোলনের জন্য বিলেতের প্রথম সংগ্রাম পরিষদ, ‘পিস নিউজ’ নামক পত্রিকার সম্পাদক রোজার গোয়েন ফোন করে বলেন, কয়েকজন ইংরেজ বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদে একটি সংগঠন করার মানসে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সহায়তা চান। পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খন্দকার মোশাররফ হোসেন (পরে বিএনপির মন্ত্রী) এবং স্বয়ং আমি কিংস ক্রসে পিস নিউজ অফিসে গিয়ে পেলাম পল কনেট নামক পিএইচডি গবেষণারত এক ইংরেজ যুবনেতা, ম্যারিয়েটা প্রকোপে নামক ক্যামব্র্র্রিজ শিক্ষয়িত্রী এক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত কন্যা, পিস নিউজ সম্পাদক রোজার গোয়েন এবং ব্রিটিশ এমপি মাইকেল বার্নসকে। আবেদ ভাই তাঁর ধারেকাছেও ছিলেন না। সে সভায়ই ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামক ইংরেজদের সংস্থা সৃষ্টি হয় পল কনেটকে সভাপতি ও ম্যারিয়েটা প্রকোপেকে সাধারণ সম্পাদক করে। তবে ম্যারিয়েটা সেই সভাতে বলেছিলেন, ফজলে হাসান আবেদ নামে (যিনি তখন ছিলেন এক অপরিচিত অখ্যাত ব্যক্তি) তাঁর এক বন্ধুর থেকে ম্যারিয়েটা বাংলাদেশে গণহত্যার কথা শুনেছেন। আবেদ ভাই অবশ্য অ্যাকশন বাংলাদেশের কর্মকান্ডে বহু বাঙালির মতো অংশ নিতেন এবং সেখানেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। অ্যাকশন বাংলাদেশের একজন স্রষ্টা এবং সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার পল কনেটকে ‘বাংলাদেশ আন্দোলনের বিদেশি বন্ধু’ হিসেবে পদকও দান করেছে, যা মরণোত্তর ম্যারিয়েটাকেও দেওয়া হবে বলে শোনা যাচ্ছে।

আবেদ ভাই অ্যাকশন বাংলাদেশ গঠন করেছেন মর্মে অসত্য কথাটি বলে ডা. জাফরুল্লাহ স্যার ফজলে হাসান আবেদের মতো এক মহান ব্যক্তির আত্মাকে অবমাননা করেছেন, অবমাননা করেছেন পল কনেট এবং ম্যারিয়াটা প্রকোপেকেও। আবেদ ভাইয়ের বহুমাতৃক প্রজ্ঞা এবং মানুষের মঙ্গলে তাঁর অবদান এতই অসাধারণ যে অ্যাকশন বাংলাদেশের ব্যাপারে তাঁকে নিয়ে অসত্যের আশ্রয় নেওয়ার কোনোই প্রয়োজন ছিল না, যেখানে এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিপ্রাপ্ত ব্যক্তির অবদান ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাষণ দিয়েও শেষ করা যায় না। এমনকি ’৭১-এ লন্ডনে তাঁর সত্যিকারের কর্মকান্ড নিয়েও অনেক কথা বলা যেত। কেন ডা. জাফরুল্লাহ এ ধরনের অসত্যের আশ্রয় নিলেন তা বোধগম্য নয়। তবে ’৭১-এ ডা. জাফরুল্লাহ অল্প সময়ই বিলেতে ছিলেন বলে সেখানকার কর্মকান্ড তাঁর জানার কথা নয়।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং আবেদ ভাই এ দুজনই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান কারাগার থেকে জীবিত ফেরত পাওয়ার মূল কাজটি করেছিলেন বলে ডা. জাফরুল্লাহর উদ্ভট কথাটি শুনে অনেকেই হতভম্ব। অনেকেই একে প্রলাপই মনে করছেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রবাসে মুক্তি আন্দোলনের নেতা ছিলেন এবং মুজিবনগরভিত্তিক বাংলাদেশ সরকারের নিয়োজিত প্রতিনিধি হিসেবে, ঢাকা হাই কোর্টের একজন বিচারপতি হিসেবে তাঁর পদমর্যাদার কারণে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য অবদান রাখার যথেষ্ট সক্ষমতা ছিল যা তিনি পুরোমাত্রায় সদ্ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, যেমন তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই গণহত্যার কথাসহ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির কথাও তুলেছিলেন। তা ছাড়া বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভা, জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ যেখানেই গেছেন সেখানেই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু ’৭১-এ আবেদ ভাই মোটেই সে রকম কোনো অবস্থানেই ছিলেন না। তখন তিনি ছিলেন প্রায় অপরিচিত অতি সাধারণ একজন মানুষ। ২০০০ সালে স্যার ফজলে হাসান আবেদ আর ’৭১-এর আবেদ ভাইয়ের মধ্যে ছিল বিরাট পার্থক্য। ডা. জাফরুল্লাহ বলেছেন, আবেদ ভাই ’৭১-এ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় গমন করেছেন। এ কথাটাও ঠিক নয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে ’৭১-এর বাংলাদেশ আন্দোলনে যারা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন, যারা তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন, ডা. জাফরুল্লাহ এবং এ প্রবন্ধের লেখক শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ তাদের প্রত্যেকের নামই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বইয়ের বহু পৃষ্ঠায় রয়েছে। কিন্তু বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বইয়ের কোথাও ফজলে হাসান আবেদ ভাইয়ের নাম নেই। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, আবেদ ভাই ’৭১-এর আন্দোলনে কাজ করেননি। অন্য বহুজনের মতো আবেদ ভাইও কাজ করেছেন। আমি যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। কিন্তু আমরা যেমন প্রত্যক্ষভাবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছি, যার জন্য আমাদের নাম তাঁর বই এবং অন্যান্য বইতে রয়েছে, আবেদ ভাই বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে সরাসরি কাজ করেননি, তিনি কাজ করেছেন পল কনেট এবং ম্যারিয়েটার নেতৃত্বে ইংরেজদের সংস্থা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এ আরও বহু বাঙালির সঙ্গে, যাদের কর্মকান্ডের সব খবর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে সব সময় পৌঁছাত না। তবে আবেদ ভাই যে ধরনের কাজ করেছেন সে ধরনের কাজ করেছেন বিলেতের শত শত বাঙালি। পাকিস্তানি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে ছাড়িয়ে আনা কোনোক্রমেই সহজ কাজ ছিল না। এর জন্য প্রয়োজন হয়েছিল বহু বিশ্বনেতার ঐকান্তিক এবং জোরালো প্রচেষ্টা। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সেই দলভুক্ত ছিলেন তাঁর অবস্থানের এবং মর্যাদার কারণে। যার ফলে তিনি এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন। এ প্রচেষ্টায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। আগস্টেই ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বনেতাদের কাছে জরুরি চিঠি পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকার ব্যাপারে তাঁর  বইয়ের ৯৩ পৃষ্ঠায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী যা প্রকাশ করেছেন তা হলো- ‘আগস্ট মাসে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার জন্য আবেদন করা হয়। ১০ আগস্ট তাঁর গোপন বিচার শুরু হওয়ার পর এই তৎপরতা পৃথিবীর সর্বত্র বৃদ্ধি পায়। ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের কাছে এ বেআইনি বিচার বন্ধ করার জন্য সর্বপ্রকার পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।’ এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ, পদগর্নি, কসিগিন, মার্কিন রাজনীতিকগণ, বিশেষ করে এডওয়ার্ড কেনেডি, আইরিশ নেতা নোবেলজয়ী শোন মেকব্রাইট, জার্মান নেতা নোবেলজয়ী উইলি ব্রান্ট, ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ, অ্যামনেস্টি প্রধান মার্টিন এনালস প্রমুখ বিশ্বনেতা। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে যাঁদের অবদানের কথা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন।

বিচারপতি চৌধুরী এ ব্যাপারে আরও যাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন তাঁরা ছিলেন ব্রিটিশ মন্ত্রী স্যার ডগলাস হিউম, এমপি পিটার শোর, জনস্টোন হাউস, ডগলাস ম্যান, মাইকেল বার্নস, আর্থার বটমলি, টবি জেসেল, ভারতের সাবেক প্রতিমন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নোবেলজয়ী আইরিশ নেতা শোন মেকব্রাইটকে পাকিস্তানে পাঠিয়েছিলেন জুলাইয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য, কিন্তু পাকিস্তানিরা তা করতে দেয়নি। (বিচারপতি চৌধুরীর পুস্তকের পৃষ্ঠা ৭৪)। এসব বিশ্বনেতার সঙ্গে দেখা করার বা তাঁদের প্রভাবিত করার অবস্থানে তখন আবেদ ভাই মোটেও ছিলেন না। বিচারপতি চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি জানানোর জন্য ৫ আগস্ট জেনেভায় আন্তর্জাতিক রেডক্রস অফিসে গমন করেছিলেন খ্যাতনামা ব্যারিস্টার ড্রেপারকে সঙ্গে নিয়ে। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর বইয়ের ৭২ পৃষ্ঠায় ‘পাঁচই আগস্ট ড্রেপার এবং আমি সকাল দশটার দিকে জেনেভা পৌঁছাই। আমরা বিমানবন্দর থেকে একটি ট্যাক্সি করে আইসিআরসির প্রধান কার্যালয়ে যাই। সেখানে বেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ড্রেপার আইসিআরসির উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা এবং সঠিক সংবাদ পরিবেশন করতে অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, শেখ মুজিব বাঙালির জাতির নেতা। তাঁর খবরের জন্য সমগ্র জাতি উদগ্রীব এবং নিদারুণ উৎকণ্ঠায় সময় যাপন করছে। তাঁকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।’

সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়ে বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘেও যে ১৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের সবার নাম তাঁর বইয়ের ১৬৫ পৃষ্ঠায় রয়েছে, সেখানে আবেদ ভাইয়ের নামগন্ধও নেই।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে ভারতের আরও ভূমিকা সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরী তাঁর বইয়ের ১৭৭ পৃষ্ঠায় ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংহের জাতিসংঘ-প্রদত্ত ভাষণ ব্যক্ত করে লিখেন, ‘তিনি (শরণ সিং) এ সমস্যার সমাধানকল্পে অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানান। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে হলেই সেটিকে শেখ মুজিব এবং অন্যান্য নির্বাচিত সদস্যদের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তিনি শেখ মুজিবের আশু মুক্তি দাবি করেন।’

ডা. জাফরুল্লাহ ’৭১-এর আবেদ ভাইকে তাঁদের, বিশেষ করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর এবং ওপরে উল্লিখিত বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের কাতারে এনে এবং শুধু বিচারপতি চৌধুরী এবং সে সময়ের অপরিচিত ফজলে হাসান আবেদ ভাই বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করেছিলেন বলে একটি গুরুতর বিষয়কে হালকা বানিয়েছেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীসহ যেসব বিশ্বনেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তাঁদের কাজকেও খেলো বানিয়ে দিয়েছেন। নিশ্চিতভাবে ’৭১-এর ফজলে হাসান আবেদের নাম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর এাবং উল্লিখিত বিশ্বনেতাদের নামের পাশে আসতে পারে না এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ফজলে হাসান আবেদ ভাই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে মিলে এককভাবে করেছিলেন বলে ডা. জাফরুল্লাহ যে মনগড়া কথাটি বলেছেন তা ইতিহাস বিকৃতিরই শামিল। ডা. জাফরুল্লাহ কেন এবং কীভাবে এ ধরনের অবিশ্বাস্য তথ্যের অবতারণা করলেন তা বুঝে উঠতে পারছি না। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বই, যার বহু পৃষ্ঠায় ডা. জাফরুল্লাহর নাম রয়েছে, তিনি তা পড়েননি সেটা তো বিশ্বাস করা যায় না। যাই হোক, তিনি মানুষকে ভুল তথ্য দিয়ে একদিকে যেমন স্যার ফজলে হাসান আবেদের আত্মাকে অবমাননা করেছেন, তেমনি অবমূল্যায়ন এবং অবমাননা করেছেন বিলেতপ্রবাসী বহু মুক্তিযোদ্ধা যাঁদের অবদান আবেদ ভাইয়ের থেকে কম ছিল না। ডা. জাফরুল্লাহ বলেছেন, আবেদ ভাই ব্রিটিশ এমপিদের লবি করতেন। অত্যন্ত সত্যি কথা। কিন্তু বিলেতে যারাই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁদের সবারই অন্যতম কাজ ছিল ব্রিটিশ এমপি এবং রাজনীতিবিদদের লবি করা। যাঁরা এভাবে লবি করতেন তাঁদের সংখ্যা দুই-তিন শর কম ছিল না।

ডা. জাফরুল্লাহ স্যার ফজলে হাসান আবেদের মতো একজন বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এহেন অসত্য, অবিশ্বাস্য রকমের ভুল কথা বলে ইতিহাস বিকৃত করেছেন, যা তাঁর মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পক্ষে ঠিক হয়নি। জনগণ যেন ভুল তথ্য না পায় সে জন্যই আমার এই লেখা।

                লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর