সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আত্মগর্ব ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়

মাকিদ হায়দার

আত্মগর্ব ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়

প্রাচীন গ্রিসের এক দার্শনিক আমাদের জানিয়েছেন, ‘মানুষ পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে থাকবে তার সঙ্গে থাকবে আশা, স্বপ্ন এবং ছায়া’। সেই গ্রিক দেশেরই আরেক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বেশ কয়েক হাজার বছর আগেই জানিয়ে গিয়েছেন চারটি বস্তুকে কখনোই প্রশ্রয় দেওয়া সমীচীন নয়। যেমন ১. আগুন, ২. অসুখ ৩. ঋণ এবং ৪. লোভ। আগুনের ধর্ম পুড়িয়ে দেওয়া। অসুখের কর্ম হচ্ছে মানুষকে কখনো কখনো মৃত্যুশয্যায় নিয়ে যাওয়া। ঋণ যদি কেউ একবার গ্রহণ করে তার ভিতরে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যায়। ‘লোভ’ যাকে একবার পেয়ে বসে, তিনি হিতাহিত বিবেচনা না করে লোভের হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে একবারও সেই লোভী লোকটির মনে পড়ে না, লোভের শেষ কোথায়, সে জন্যই দার্শনিক অনেক আগেই সাবধান করে গিয়েছিলেন, ওই চারটি বস্তুকে বাড়তে দিলেই মহাবিপদ।

আমি অ্যারিস্টটলের নাম জানলেও আরেক জনের নাম কিছুতেই মনে করতে না পারার জন্য নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত। মাঝে মাঝে স্মৃতি নিজেই দোদুল্যমান, যেহেতু স্থির নয়, আমার বারবার মনে হয় আশাহীন মানুষ, স্বপ্নহীন মানুষ এবং ছায়াহীন মানুষ পৃথিবীতে দুর্লভ। কারও আশা থাকে একদিন রাজনীতিবিদ হবেন, দেশ-জাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করবেন, যেমন করেছেন মহাত্মা গান্ধী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। হয়তোবা আরও অনেকেই আছেন যারা আশা করছেন, আগামী দিনের নেতা-নেত্রী হবেন। কিংবা কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক। আশার সঙ্গে স্বপ্নের বসবাস। স্বপ্ন সাধারণত আমরা রাতে দেখলেও দিবা স্বপ্নও অনেকেই দেখে থাকেন। একদিন জজ-ব্যারিস্টার, বিশাল ব্যবসায়ী হয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান করবেন। এই আশা, এই স্বপ্নের সঙ্গে থাকে ছায়া। ছায়া তখনই দৃশ্যমান হয়।  যখন নিজের শরীরের ওপর তিন প্রহরের রোদ ঝরে পড়ে আকাশ থেকে। সেই ছায়ার সকালের রূপ একরকম, দুপুরের আরেক রকম, বিকালের রোদের বিপরীতে দাঁড়ালেই দেখতে পাওয়া যায় প্রলম্ববিত ছায়া। হতে পারে ১০ থেকে ১৫ ফুট বা তারও অধিক। মানুষের লোভও যখন অধিক থেকে অধিকতর হয়ে যায় সে বা তারা, তখন হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর এবং জ্ঞানশূন্য। ‘ঈশপ’ কয়েক হাজার বছর আগে বলেছিলেন, ‘আত্মগর্ব মানুষের ধ্বংসের কারণ হতে পারে।’ অপর দিকে গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৬-৪০৬) বলেছেন, ঈশ্বর বড়াইকারীকে পছন্দ করেন না। এসব কথা আমরা অনেকেই মনে রাখি না। এমনকি পবিত্র কোরআন শরিফে বারবার বলা হয়েছে, সীমালঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর থেকেই কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তিনি ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে ভ্রমণ করতে এসেই, সেকালের রেসকোর্স ময়দানের এক জনসভায় এবং কার্জন হলের ছাত্রসভায় অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই জানিয়ে ছিলেন তার প্রিয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জানিয়েছিল প্রতিবাদ। তবে ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হলেও পূর্ববঙ্গের সব বাঙালির দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষা হতে হবে বাংলা। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বাঙালিরা এগিয়ে থাকলেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ছিলেন জিন্নাহর উক্তির পক্ষে। যার ফলশ্রুতিতে তরুণ ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক ছাত্রই রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে রাজপথে নেমেছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মর্মন্তুদ বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল পূর্ববঙ্গে।

১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে তখনকার দিনের ১৭টি জেলায়ই গড়ে উঠেছিল, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচি থেকেই স্থির করা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জেলায় পাঞ্জাবি একজন ক্যাপটেন বা মেজরকে পোস্টিং দিতে হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পাবনায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল ক্যাপ্টেন জায়েদি নামক এক হিংস্র দানবকে। দানবের বাড়ি ছিল পাঞ্জাব প্রদেশে। পাবনায় এসেছিল ১৯৫৩ সালে, পাঞ্জাবে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে ফেলে রেখে। যেহেতু তার চাকরিটাই ছিল গুপ্তচর বৃত্তি। তাই সে কারণে-অকারণে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে যেত, সঙ্গে থাকত স্থানীয় গুপ্তচররা। সে যে শুধু সহচর নিয়ে এডওয়ার্ড কলেজেই যেত তাই নয়, মাঝে মাঝে যেত পাবনা গার্লস হাইস্কুলে, প্রধান শিক্ষক ছিলেন মিসেস মুখার্জি এবং শিক্ষিকাদের প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। দ্বিতীয় শিক্ষক ছিলেন লাহিড়ি পাড়ার পুষ্পালয় ভবনের মালিক অর্চনা গোস্বামী। অর্চনার স্বামী ছিলেন কংগ্রেসের পাবনা শাখার নেতা এবং শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছিল কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং আওয়ামী লীগ, নেজামে ইসলাম, বোধকরি জামায়াতে ইসলামও ছিল না কি ছিল না সে কথা আমার জানা নেই।

ক্যাপ্টেন জায়েদির পরিবার তখন পাঞ্জাবে থাকলেও শহরের কেউই জানত না, তার পরিবার-পরিজন আদৌ ছিল কিনা, উপরন্তু, কংগ্রেস নেতা গোস্বামীর স্ত্রী অর্চনা গোস্বামীর কাছ থেকে দানব জায়েদি জানতে আসত তার সহচরদের নিয়ে-তার স্বামীর খবরাখবর। দানব বাংলা জানত। প্রায়শ তাকে দেখা যেতে গার্লস হাইস্কুলে। গার্লস হাইস্কুলে তার আসার প্রধান কারণ ছিল, সুশ্রী সুন্দরী যে কোনো একটি মেয়েকে গৃহিণী করার অভিলাষে। দানব নবম এবং দশম শ্রেণিতে গিয়ে দেখতেন কোন মেয়েটি সুশ্রী।

শহরের উত্তরদিকে সুচিত্রা সেনের বাড়ির বিপরীত মহল্লাটির নাম জামতলা। জামতলা নিবাসী অ্যাডভোকেট আবদুল হাকিমের বড় মেয়েটি পড়ত গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণিতে, দেখতে অপরূপা। সেই অপরূপার দিকেই দৃষ্টি পড়েছিল মানুষরূপী দানব ক্যাপ্টেন জায়েদির। অপরূপার নাম ছিল সখিনা বেগম। অ্যাডভোকেট হাকিম সাহেবের কাছে বাঙালি সহচরদের দিয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। অ্যাডভোকেট সাহেব সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও দানবের ভ্রুকুটি থেকে রেহাই পাননি তিনি। হাকিম সাহেবের যুক্তি ছিল- অবাঙালি, পাঞ্জাবে তার ছেলেমেয়ে আছে কিনা ইত্যাদি। কোনো কথাই শোনেনি দানব। জোর করেই ধুমধামের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল পাবনা পলিটেকনিক স্কুলের মাঠে ১৯৫৩ সালে। উপরের তথ্যগুলো আমাকে দিয়েছেন আমাদের সেজোবোন সেলিনা হায়দার ঝর্ণা। ঝর্ণাপা পাবনা গার্লস হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন সেই সময়। ক্যাপ্টেন জায়েদি সেই যে পাবনায় এলেন, তিনি আর পাঞ্জাবে ফিরে যাননি ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের আগ পর্যন্ত। ইতিপূর্বে শহরের রূপকথা সিনেমা হলের দক্ষিণে একজন হিন্দু জমিদারের দৃষ্টিনন্দন একটি বাড়ি দখল করেছিলেন, যেটি এখনো আছে ইছামতি নদীর পূর্বপাড়ের ঘাটসংলগ্ন। বাড়িটির ভিতরে ফলের বাগান এবং একটি চিড়িয়াখানা বানিয়েছিলেন ভূতপূর্ব জমিদার। সবকিছুই দখল করে নিয়েছিল দানব। এবং সেই বাড়িটিতেই বানিয়েছিল পিআইএর একটি অফিস। ঈশ্বরদী থেকে মাত্র ২২ টাকায় পিআইএর ডাকোটা বিমানে তখনকার দিনে ঢাকায় যাওয়া যেত, সেটি ৬০ দশকের দিকে অথবা মাঝামাঝি সময়ে। এর কিছু দিন পরেই পাবনার মুসলিম লীগ নেতারা তাকে পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান বানিয়েছিলেন। চেয়ারম্যান হওয়ার পরে তার রুদ্ররূপ দেখতে পেয়েছিল পাবনাবাসী। ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে সরকার বিরোধী বিশাল আন্দোলন/বিক্ষোভ হয়েছিল। সেই বিক্ষোভের বিপরীতে ছিল এডওয়ার্ড কলেজের  চীনপন্থি একটি ছাত্র গ্রুপ। বিক্ষোভে যখন উত্তাল তখন বিক্ষোভের স্বপক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ছিলেন। তবে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ছেলে। নাসিম পরে পাবনা থেকে এসে জগন্নাথ কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে। ছিলেন আমার সহপাঠী। তখনকার দিনে শহরে বিজলির বাতি পাওয়ার হাউসের মালিক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক মুসলিম ব্যবসায়ী মতলুব আলী মোল্লা। আদিবাড়ি হুগলি জেলায়। শহরের ভবানী সাহার চারতলা ভবনে জনাব মোল্লা তিনিও থাকতেন ওই ভবনে। আরও ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উদবাস্তুরা। পাওয়ার হাউসের পাওয়ার সাপ্লাই ঠিকমতো না হলেও শহরবাসীর কিছু করার ছিল না। চেয়ারম্যান জায়েদিই প্রথম এডওয়ার্ড কলেজের সামনে থেকে দক্ষিণে, শহরের সদর পোস্টাপিস পর্যন্ত ‘ফ্ল্যাডলাইট’ লাগানোর পর চর আশুতোষপুর, চর কোষাখালী থেকে হাজার কয়েক লোক নতুন ব্রিজের পূর্ব-পশ্চিমে সেই দিন সন্ধ্যা থেকে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত অবাক দৃষ্টিতে উপভোগ করেছিলেন সেই ফ্ল্যাডলাইটের আলো। লাইট লাগানোর পরে জায়েদির পক্ষে জনমত বাড়াতে এগিয়ে  এলো শহরের পশ্চিম দিকের কেষ্টপুর মহল্লার মুসলিম লীগ নেতা খবির উদ্দিন আহমেদ এবং বাণী সিনেমা হলের দক্ষিণের মোসলেম তালুকদার। তালুকদার সাহেব ছিলেন পেশায় একজন মোকতার। অপর দিকে মুসলিম লীগের আরেক নেতা নুরু খোন্দকার। বাড়ি এডওয়ার্ড কলেজের পেছনের মহল্লায়। উনারা চারদিকের জনসভায় জানিয়ে দিলেন, মুসলিম লিগই একমাত্র রাজনৈতিক দল। যারা দেশের মঙ্গল কামনায় এই শহরে ফ্ল্যাডলাইট জ্বালিয়ে অন্ধকার দূর করতে পেরেছে। অন্যকোনো রাজনৈতিক দল নয়। তাদের বক্তব্য ছিল, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। সম্ভবত তখন পাবনার আওয়ামী লীগ সভাপতি ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। তিনি পেশায় ছিলেন অ্যাডভোকেট বা উকিল। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রণয়ন করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান জুন মাসে। আমি মুড়ির টিন নামের সেই বিখ্যাত বাসে, মালিবাগ থেকে জগন্নাথ কলেজে যাওয়ার পথে, জীবনে প্রথম বিনা পয়সার টিয়ার গ্যাস খেয়েছিলাম জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। সেই আমার প্রথমবার টিয়ার গ্যাসের স্বাদ গ্রহণ করা। পরে খেয়েছিলাম একাধিকবার ’৬৯-এর গণআন্দোলনের সময়। মিছিলে স্লোগান ছিল- জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব, আমাদের তারুণ্যের সময় হরতালে, মিছিলে, আইয়ুব খান, মোনয়েম খান বাধ্য হয়েছিলেন শেখ মুজিবকে জেলখানা থেকে ছেড়ে দিতে। পরের বছর ১৯৭০ সালে উভয় পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে এগিয়ে থাকলেও পাকিস্তান সরকার কিছুতেই রাজি নয়, শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে। করাচি থেকে নিয়ন্ত্রিত রেডিও পাকিস্তান থেকে এক বাঙালি পাঠক সংবাদে জানালেন ইয়াহিয়া খান নির্বাচন স্থগিত করেছেন। সম্ভবত সেটি ছিল মার্চ মাস ১৯৭০ সাল। হঠাৎ এই খবর ছড়িয়ে যাওয়ার পরে শহরময় উত্তেজনা ছড়াতে সময় লাগেনি, আর ওইদিন আমি আর আমার বন্ধু গাজী আজিজুর রহমান ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম, পাকিস্তান বনাম অন্য একটি দেশের। সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চলছিল খেলা। ওই সংবাদ প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বাঙালি দর্শকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানের সেই সময়ের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের ওপর। প্রচন্ড হাতাহাতি মারামারি শুরু হওয়ায় পুলিশ এসে ওই সব খেলোয়াড়দের রক্ষা করেছিল। তবে অনেকেই ক্রিকেট ব্যাটের আঘাতে খুবই ভালোভাবে আহত হয়েছিল এবং Stamp Pad দিয়ে অনেক বাঙালি দর্শক পিটিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেই দিন থেকেই একটি গুমোট আবহাওয়া তৈরি হলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ছিলেন নির্বিকার। দেখতে দেখতেই ১৯৭১ সাল এসে পড়ল। চারদিকে সে আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। সেই আগুনের লেলিহান শিখা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লেও বাঙালিরা তখনই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ১৮ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের পৃথিবীবিখ্যাত যে ভাষণটি সেদিন তিনি রেসকোর্স ময়দানে দিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষের সামনে, সেটি ছিল অবিস্মরণীয়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই ৭ মার্চের ভাষণ শোনার। বঙ্গবন্ধু ওই ভাষণেই জানিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির মনের আশা-আকাক্সক্ষার কথা। চারদিকেই তখন জয় বাংলার জয়ধ্বনিতে মুখরিত। সবারই মনে শঙ্কা জেগেছিল না-পাক বাহিনীরা কখন বাঙালিকে আক্রমণ করে বসে। ৭ মার্চের পর থেকে ইয়াহিয়া-ভুট্টো পাকিস্তানে বসেই ঠিক করেছিল পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র মানুষগুলোকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মদ্যপ ইয়াহিয়া স্বগর্বে বলেছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তান বা মিট্টি চাহিয়ে আদমি নাহি’ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, এ দেশের মানুষকে চাইনে। ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় এসে প্রহসনের নাটক শেষ করে যাওয়ার আগে ঢাকাস্থ ক্যান্টনমেন্টের সব পাঞ্জাবি, বেলুচি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হুকুম দিয়েছিল জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে হবে বাঙালিদের। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকেই হার্মাদ/দস্যুরা নিরীহ সব মানুষকে নির্বিচার জ্বালিয়ে মারল। প্রথম আঘাতটি ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে। আমরা তখন থাকতাম ১৪/২ মালিবাগে। আমাদের মা ওই রাতেই পবিত্র কোরআনের কয়েকটি সুরা বারবার পড়ছিলেন। অগ্রজ জিয়া ভাই, আমি, দাউদ, ছোট বোন হেনা থাকতাম ওই ভাড়া বাড়িতে। সেজো ভাই রশীদ তিনি থাকতেন খিলগাঁও আনসার ক্যাম্পের ঠিক বিপরীতে লুৎফর রহমান ঝিনুদের ভাড়া বাড়িতে। সঙ্গে থাকত দাউদ, জাহিদ। ’৭১-এর ২৭ মার্চের পর থেকেই শুরু হয়েছিল বাঙালির দুর্বিষহ জীবন। জ্বালাও, পোড়াও এবং বাঙালি নিধনের উৎসব। উৎসবের সূত্রপাত ২৬ মার্চ থেকে। সমগ্র পাকিস্তানে কারফিউ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল খুনিরা পাকিস্তানে। শুরু হয়েছিল অবরুদ্ধ জীবন। আমরা কেউ-ই ঘর থেকে বের না হলেও চাল, ডাল যে টুকু ছিল তা প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল। মাঝে মাঝে কারফিউ শিথিল শুরু হলে জিয়াভাই রশীদভাইকে ডেকে জানালেন, ঢাকায় থাকা ঠিক হবে না।

                লেখক : কবি।

সর্বশেষ খবর