বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

জলবায়ু ঝুঁকি, কভিড এবং এসডিজি বাস্তবায়নে আমরা কোথায়?

মো. আবুল কালাম আজাদ

জলবায়ু ঝুঁকি, কভিড এবং এসডিজি বাস্তবায়নে আমরা কোথায়?

১৯৯৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বিগত ২০ বছরে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সম্পর্কিত ১২ হাজার মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে এবং এতে প্রায় ৫ লাখ প্রাণহানি ও ৩৫৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পদের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশ এই সময়ে প্রায় ২০০ বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে বর্তমান হারে কার্বন নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে মারাত্মক দুর্যোগের ঘটনা দ্বিগুণ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৪ থেকে ৫ গুণ হবে। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে ২১০০ সালের মধ্যে ৫৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পদের ক্ষতি হবে, আর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি হারে বাড়তে থাকলে ৬৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পদের ক্ষতি হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বন্যা, নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ভূমিধস, বরফ গলন, তুষারপাত, কভিড-১৯ ইত্যাদি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটছে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের দিক থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জার্মানি ওয়াচ নামক একটি জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে তাদের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বিশ্বের সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করেছে এবং এ প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার ক্ষেত্রে অনুকরণীয় অগ্রগতি দেখিয়েছে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় হলেও ২০১৮ সালের জলবায়ু-সহনশীল সূচক (CRI) অনুযায়ী শীর্ষ দশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নেই। ২০২০ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিশ^ব্যাপী মহামারী কভিড-১৯-এ প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায় এবং প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশেও ওই সময় পর্যন্ত কভিড-১৯-এ ৫ হাজার ৪০৫ জন মারা যান। ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের হার ছিল ৮.২% যা করোনার জন্য বৃদ্ধি পেয়ে ৮.৮% হয়। করোনার জন্য বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৭ কোটি ১০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমায় যুক্ত হয়েছে। শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ অতিদরিদ্রের কাতারে শামিল হয়েছে।

এ প্রেক্ষাপটে আমরা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজি বাস্তবায়নের বিষয় বিবেচনা করছি। জাতিসংঘের স্বপ্ন টেকসই উন্নয়নের অন্যতম লক্ষ্য বিশ্বের ১৯৩টি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সম্মান ও উচ্চ মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার জন্য বিশ্বকে তৈরি করা। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে দ্রুতগতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। ২০০৮-২০১৮ পর্যন্ত ১০ বছরে সাক্ষরতার হার ৫৪% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৪.৭% হয়েছে। মাথাপিছু আয় ২০০৮ সালে ৬৮৬ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালে ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০০৮-এ ৬% যা মহামারীর আগে ছিল ৮.১%। গড় আয়ু ৬৯ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭২.৬ বছর হয়েছে। ২০০৮ সালের রপ্তানি আয় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) ছিল মাত্র ৬ হাজার কোটি টাকা, যা ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকায়। ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৩ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াট এবং এটি ২০২০ সালে ৭ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের তিনটি সূচক যথা মাথাপিছু বার্ষিক জাতীয় আয় (GNI), মানবসম্পদ সূচক (HAI) ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক (EVI) অনুযায়ী ২০১৮ সালে বাংলাদেশকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উত্তরণের সুপারিশ করা হয়েছে। আমরা আশা করি, ২০২১ সালের পর্যালোচনায় বাংলাদেশ ২০২৪ সালের মধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের দ্বিতীয় সুপারিশ পাবে এবং ২০২৭ পর্যন্ত এলডিসির সব সুবিধা পাওয়ার সুযোগ অব্যাহত থাকবে। এলডিসি অর্জনের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য একটি পথনকশা প্রস্তুত করা হচ্ছে। ২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়নের সময় প্রায় সব সূচক যেমন দরিদ্রতা হ্রাস, স্বল্প ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ রোধ, মাতৃমৃত্যু নিয়ন্ত্রণ, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু কমানো, শিক্ষা, এইচআইভি, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন কর্মসূচিতে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। এসব উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনিসেফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক ‘সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন’, ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’, ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’, ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ এবং আরও অনেক অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন।

২০১৫ সালে এসডিজি দলিলে স্বাক্ষরের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি আত্মবিশ্বাসী যে বাংলাদেশ এমডিজি অর্জনের মতো এসডিজি অর্জনেও সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারবে।’ আমরা সবাই জানি এসডিজিতে ১৭টি অভীষ্টের অধীনে ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা এবং ২৩২ সূচক (সংশোধিত) রয়েছে। এসডিজির রয়েছে পাঁচটি মূলনীতি বা পাঁচটি P। এগুলো হলো People বা ‘জনগণ’; সব ধরনের ও মাত্রার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সম্পূর্ণ অবসান এবং মর্যাদা ও সমতা নিশ্চিত করা। Prosperity বা ‘সমৃদ্ধি’; প্রকৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে সমৃদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান। Peace বা ‘শান্তি; শান্তিপূর্ণ, ন্যায়পরায়ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থার বিকাশ। Partnership বা ‘অংশীদারি’; বলিষ্ঠ বৈশ্বিক অংশীদারির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের বাস্তবায়ন; প্রভৃতি। এসডিজি বাস্তবায়নে টেকসই উন্নয়ন হলো মূল প্রতিপাদ্য এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়’। এসডিজিতে নির্ধারিত ১৭টি অভীষ্ট হলো দারিদ্র্য বিলোপ, ক্ষুধামুক্তি, সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ, গুণগত শিক্ষা, জেন্ডার সমতা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, সাশ্রয়ী ও দূষণমুক্ত জ্বালানি, শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্প, উদ্ভাবন এবং অবকাঠামো, অসমতার হ্রাস, টেকসই নগর ও জনপদ, পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন, জলবায়ু কার্যক্রম, জলজ জীবন, স্থলজ জীবন, শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান, সর্বোপরি অভীষ্ট অর্জনে অংশীদারি।

মহিলা এবং শিশু, বৃদ্ধ, হিজড়া, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ, দ্বীপে ও হাওরে বসবাসকারী লোকজন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল হচ্ছে ‘কাউকে পেছনে না ফেলা’ তা নিশ্চিত করা। প্রতিটি জেলা ও উপজেলা কাউকে পেছনে না রাখা সম্পর্কিত অন্তত একটি সূচক চিহ্নিত করেছে।

কেউ যাতে পেছনে না থেকে যায় তা নিশ্চিত করার জন্য সরকার শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করেছে। ২০১৬ সালে ২৮.৭% পরিবার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগী হয়েছে, আমাদের বাজেটের ১৫% সামাজিক সুরক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় করা হয়েছে। নাগরিক সুবিধা প্রদানের জন্য অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা প্রদানের জন্য ৫ হাজার ৮৭৫টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সার্ভিস সেন্টার ও ৮ হাজার ৫০০ পোস্ট ই-সেন্টার নিয়মিত কাজ করছে।

বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সব শ্রেণি-পেশার অংশীদারি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাসমূহ, সুশীলসমাজ, পেশাদার গোষ্ঠী, ব্যবসায়ী, মিডিয়া, মহিলা নেটওয়ার্ক এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিভিন্ন কর্মকা-ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের সঙ্গে মিল রেখে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন; ২০২১ ও ২০৪১-এর পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সে মোতাবেক এসডিজি বাস্তবায়নকারী বিভাগ ও মন্ত্রণালয়গুলো একীভূতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এসডিজির যাত্রার সময় ২০১৬-২০২০ পর্যন্ত আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চলমান ছিল এবং এতে এসডিজির ৫৬টি লক্ষ্যমাত্রা সরাসরি ও ১০২টি লক্ষ্যমাত্রা আংশিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পাদিত বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সপ্তম, অষ্টম, নবম এ তিনটি পঞ্চবার্ষিকের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়ন করবে।

শুরু থেকেই বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনা কমিটি রয়েছে। এসডিজির সূচক এবং লক্ষ্যমাত্রাসমূহ বাংলায় অনুবাদ করে সব বিভাগ/ মন্ত্রণালয়কে পথনকশার আওতায় এনে মন্ত্রণালয়সমূহের কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। তথ্য ও সম্পদের প্রয়োজনীয়তা এবং এগুলোর ঘাটতির দিকে নজর দিয়ে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এখন অবধি এসডিজি বাস্তবায়নে একটি প্রশিক্ষণ সহায়িকা, এসডিজির স্থানীয়করণের জন্য কর্মপরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো এবং এসডিজি ট্র্যাকার প্রস্তুত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে এসডিজি অর্জনের অগ্রগতি পরিমাপ করা হচ্ছে। এসডিজি পথনকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিভাগ/মন্ত্রণালয়সমূহের মধ্যে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় চলছে এসডিজি বাস্তবায়ন।

লেখক : সাবেক মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) ও সাবেক মুখ্য সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

সর্বশেষ খবর