শুক্রবার, ১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

হুকুমেরও সময়-অসময় আছে বইকি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

হুকুমেরও সময়-অসময় আছে বইকি

মানসিক রোগ যে একটি বড় রকমের সমস্যা, এবং পুঁজিবাদী উন্নতির দুঃসহ দুঃশাসন যে ওই রোগের প্রসার ও গভীরতা ক্রমাগত বাড়িয়ে দিচ্ছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ট্রাম্প আর কতটা অসুস্থ, তাঁর চেয়ে অনেক অনেক অধিক অসুস্থ আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। স্বপ্ন-দিয়ে-ঘেরা আমাদের নিজেদের দেশের শতকরা ১০ জনের অধিক মানুষ নাকি কোনো না কোনোভাবে মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। উন্নয়ন তাদের জন্য সুখ আনেনি।

মন বলে একটা সজীব জিনিস তো আছে, এবং তার ওপর যদি চাপ এসে পড়ে, যদি দেখা যায় পাশে কেউ নেই, কেউ সাহায্য করে না, আশা দেয় না, উল্টো মুখ ঘুরিয়ে নেয়, ভয় দেখায়, যন্ত্রণা দেয়, তাহলে মনের আর দোষ কী? সে-বেচারা ভালো থাকে কী করে? থাকছে না। মানুষ বিষণ্ণ হচ্ছে, হতাশায় ভুগছে। বহু মানুষ কাজ পাচ্ছে না, পেলেও সে-কাজে আনন্দ নেই, সৃষ্টিশীলতা অবরুদ্ধ ও অবমূল্যায়িত। অভাব-অনটন সঙ্গ ছাড়ে না। করোনাভাইরাস যা করছে তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্গত বিচ্ছিন্নতা ও আত্মকেন্দ্রিকতারই অতি নগ্ন উন্মোচন বই নয়। এ ব্যবস্থার পক্ষে ভালো যা দেওয়ার ছিল তা মোটামুটি নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন মন্দগুলো প্রবল হয়েছে, উথলে উঠছে, উপচে ও চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। শরীরে যারা বাঁচছে তারাও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাধির বিস্তার বাড়ছে, ব্যাধির গভীরতাও পিছিয়ে নেই।

সামাজিকভাবে থেকে ব্যাধিগ্রস্ত হলে অনেক মানুষ হিংস্র হয়ে পড়ে, ভাঙচুর ঘটায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেমনটা করেছেন ও করতে চাচ্ছেন। অনেকেই মাদকাসক্ত হয় এবং মাদক প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীরা তাদের উৎসাহ জোগায়। বিষণ্ণ, অবসাদগ্রস্ত হয়ে বহু মানুষ নিজের ও অন্যের ওপর বোঝা হয়ে পড়ে; আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বা করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। মনের জোর শরীরের জোরের চেয়ে কম জরুরি নয়, মনের জোর ভেঙে গেলে টিকে থাকাটা কঠিন। করোনাকালে মানুষের মন ভেঙেছে। তাই আত্মহত্যার সংখ্যাও বেড়েছে। সব খবর জানা যায় না, কিন্তু যেগুলো আসে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করবার জন্য তারাই যথেষ্ট। ধরা যাক, সেই মেয়েটির কথা। ভোলার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা সে; মা ও খালার সঙ্গে লঞ্চে করে ঢাকায় আসছিল; পথিমধ্যে রাতের অন্ধকারে নদীতে সে ঝাঁপ দিয়েছে। মা ও খালা তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন, সজাগ হয়ে দেখেন মেয়েটি নেই; তারা চেঁচামেচি করেছেন, সারেং লঞ্চ থামিয়েছেন, নদীতে জেলেরা মাছ ধরছিলেন, তারা মেয়েটিকে উদ্ধার করেছেন। জেলেরা মেহনতি মানুষ। বুকের মধ্যে তারা সংবেদনশীলতা বাঁচিয়ে রাখেন, তাই সাড়া দিয়েছেন। মাছ ধরলে লাভ, মানুষ বাঁচালে লাভ তো নেই-ই, উপরন্তু সাক্ষ্য দিতে গিয়ে পুলিশের হাতে হেনস্তা হওয়ার শঙ্কা। তবু তারা দমেননি। ঝাঁপ-দিয়েছেন নদীর পানিতে। টেনে তুলেছেন অর্ধমৃত মেয়েটিকে। কিন্তু মেয়েটি কেন অমন অস্থির হলো আত্মপ্রাণ-সংহারে? হতে পারে বিয়ে হয় না দেখে আত্মধিক্কার জেগেছিল; দু-একটি পাত্রপক্ষ দেখে গেছে, পরে জানাবে বলে চলে গেছে, আর জানায়নি। অথবা বিবাহিত সে, স্বামী ব্যস্ত পরকীয়ায়, হয়তো-বা স্বামীটি বিয়েই করে ফেলেছে কাউকে। এমনও হওয়া সম্ভব যে চাকরির ব্যাপারে অসুবিধা দেখা দিয়েছিল। বাবা নেই, সংসার তাকেই চালাতে হয়। আমরা জানি না কারণটা কী, কিন্তু এটা জানি যে তার মন ভেঙে গিয়েছিল, জীবন তার কাছে দুঃসহ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, বইতে পারছিল না; জীবনকে তাই সে ফেলে দিতে চেয়েছে নদীর পানিতে। ঝাঁপ দিয়েছে অন্ধকারে। অথচ চারদিকে তো উন্নতি ঘটছে। না, উন্নতি তাকে বাঁচাতে পারেনি। উন্নতি তাকে বিচ্ছিন্ন করে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর দিকে।

ভোলার এ মেয়েটি আত্মহত্যা করতে সক্ষম হয়নি, কিন্তু ওই একই সময়ে সাতক্ষীরার এক ছেলে নিজেকে ঠিকই শেষ করে দিয়েছে। জানা গেল সে রাজনীতিতে ছিল; কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে : ‘বোনটা খুব কাঁদছে। অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি হয়তো। ...ভালো থেকো সবাই। দূর থেকে দেখব সবাইকে। ভালো থাকুক ভালোবাসার মানুষগুলো। ...ছোটবেলা থেকে আমার রক্তে মিশে গেছে রাজনীতি। আমি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তাঁর দেখানো পথ ধরেই চলে আসছি আজ অবধি। চাকরি বা বিয়ে কোনোটাই করিনি ছাত্রলীগ করব বলে। বাট, আজ দলও টাকার কাছে জিম্মি। আমার জীবনে আর কী বাকি আছে, হয়তো বেঁচে থাকতাম দুই মুঠো ভাতের জন্য। কিন্তু যখন অসহায় মানুষগুলো কাঁদে আমি তাদের কান্না সহ্য করতে পারি না। আমার নেতা বঙ্গবন্ধুও পারেননি। ... আমিও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারিনি, তাই আমি খারাপ। আমার জীবনে আজ অবধি যত খারাপ সময় তার সবকিছু এই রাজনীতির জন্য। ভবিষ্যতের কথা ভাবিনি কখনো, আজ জীবনের এই শেষ সময়ে কেন জানি মনে হচ্ছে এই ছাত্রলীগের নেশাটাই আমাকে শেষ করে দিল। হারিয়েছি সব; ঘর, পরিবার, ভালোবাসার মানুষ, কাছের মানুষ সবকিছু হারিয়েছি এই রাজনীতির জন্য। তাই চলে গেলাম এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে।’

মৃত যুবকের পিতা জানিয়েছেন ওর মা মারা গেছেন দুই বছর আগে। এর পরই মানসিকভাবে সে কিছুটা ভেঙে পড়েছিল। এরই মধ্যে তার ছোট বোনের বিয়ে নিয়ে পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি হলে তার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। ছাত্রলীগের পদ না-পাওয়ার ক্ষোভ তাকে গ্রাস করে ফেলে। সে খলিলনগর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি হতে চেয়েছিল। কিন্তু পদ দিতে ১ লাখ টাকা চেয়েছিল উপজেলা ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতা। টাকা দিতে না পারায় পদ সে পায়নি।

উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জানিয়েছে ছেলেটি তার সময়ে খলিলনগর ইউনিয়নের হরিশচন্দ্রবাটি ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ছিল। খলিলনগর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সে সভাপতি হতে চেয়েছিল। কিন্তু পদ পেতে ১ লাখ টাকা চায় উপজেলা ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতা। টাকা দিতে পারেনি, তাই পদও পায়নি। (দেশ-রূপান্তর, ০৮-১১-২০২০)

মন্তব্য করা কঠিন, কলম কেঁপে ওঠে। রাজনীতি যে টাকার অধীনে চলে গেছে এমন কথা শোনা যায়, ওই তরুণ তো তারই প্রমাণ রেখে গেল, আপন প্রাণ-বলিদানে। রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তরুণদের প্রাণদান বিরল নয়; কিন্তু এ মৃত্যু, এ আত্মহত্যা তো কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, এ হচ্ছে রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণের প্রাণঘাতী পরিণতি। দলবাজি এখন একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত চলে গেছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের নামে দুর্নীতিকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, এখন এমনকি সরকারি দলের ছোট ছোট অঙ্গসংগঠনের পদ কেনাবেচা-সংক্রান্ত দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে একেবারে ঘরের ভিতরেই ঢুকে পড়েছে।

স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আগে হতো নির্দলীয় পদ্ধতিতে। অর্থাৎ প্রার্থীর ব্যক্তি-পরিচয়ে। এখন সেখানেও দলীয় পরিচয়ে প্রার্থীরা দাঁড়ান। সরকারি দলের মার্কা পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। টাকা-পয়সার লেনদেন যে অবাধে ঘটে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। মার্কা পেয়ে গেলে নির্বাচিত হওয়ার পথে আর কোনো বাধা থাকে না, আর একবার নির্বাচিত হতে পারলে যা ইচ্ছা তা-ই করা সম্ভব হয়। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের কারও কারও দুষ্কর্মের খবর চাপাচাপির আবরণ ভেদ করেও মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়ে, যদিও অধিকাংশ খবরই চাপা পড়ে থাকে। যেমন ঢাকা মহানগরীর একজন সংসদ সদস্যের নেশাই নাকি জায়গাজমি দখল করা। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ওপর থাবা তো তিনি বসানই, তবে তার বিশেষ দৃষ্টি সরকারি জায়গাজমির ওপর, সেগুলোর দামও অধিক, এবং সরকারের লোক বলে দখল করা ও দখলে রাখার সুযোগও বেশি। তিনবার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন; তার এক পুত্র কেবল যে সংসদ-সদস্য-পুত্র তাই নন, অন্য এলাকার একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্যের জামাতাও। পুত্রটি আবার ওয়ার্ড কাউন্সিলরও বইকি। ছেলেটির গাড়ির সঙ্গে একটি মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগার কারণে নৌবাহিনীর একজন অফিসারকে প্রকাশ্যে ও জনবহুল রাস্তায় নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। থানায় মামলা দেওয়া হয়, এবং অন্য ক্ষেত্রে হলে যা ঘটত, কোনো গুরুত্বই দেওয়া হতো না, নয় তো বলা হলো প্রহৃত ব্যক্তিটি অন্যায় করেছিল তাই সে জনতার রুদ্ররোষে পড়েছিল, জনতা তাকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিয়েছে, এ ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। কারণটা অপরিষ্কার নয়। প্রহৃত মানুষটি সামরিক বাহিনীর অফিসার। প্রাথমিক বিচারটা অতিদ্রুতই ঘটেছে। র‌্যাবের সদস্যরা সংসদ সদস্যের পুত্রের আস্তানায় ঢুকে তদন্ত করেছেন, এবং অপরাধের চিহ্ন-নির্দেশক নানান বস্তু খুঁজে পেয়েছেন। সঙ্গে র‌্যাবের একজন ম্যাজিস্ট্রেটও উপস্থিত ছিলেন, তৎক্ষণাৎ তিনি সাজাও ঘোষণা করেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলোক অবশ্য পরে বদলি হয়ে যান, তবে তার বদলি এই শাস্তিদানের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয় বলে ‘নিশ্চিত’ করা হয়েছে সরকারি মহল থেকে। প্রবল প্রতাপে ছিলেন ওই সংসদ সদস্য, হাজী সেলিম তাঁর নাম, মক্কায় গিয়ে তিনি হজ করে এসেছেন, তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য সব চলে ‘মদিনা’ গ্রুপ নামে, মক্কা-মদিনাকে একসঙ্গে টেনে এনেছেন বাংলাদেশে। ধর্ম যে কেবল রাজনীতিতেই ব্যবহৃত হয় তা নয়, ব্যবসায়ও ঢের কাজে লাগে; অবশ্য রাজনীতিও তো আজকাল এক রকমের ব্যবসাই। হাজী সাহেব ব্যবসা করেন, রাজনীতিও করেন; রাজনীতি তাঁর ব্যবসাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। রাজনীতি ও ব্যবসাকে একাকার করবার ব্যাপারে চকবাজারে হাজী সেলিম আর নিউইয়র্কের ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভিতর কোনো পার্থক্য থাকে না; হাজারটা ব্যবধান পেরিয়ে দুজনে দুজনের ইয়ার দোস্ত হয়ে যান। সেলিম সাহেব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে একটা ধাক্কা খেয়েছেন, সেটা দেখতে পেয়ে সরকারের অন্যান্য কর্তৃপক্ষও তাদের হারানো সাহস কিছুটা ফিরে পেয়েছে, তারা তার দখলে-চলে-যাওয়া জায়গাজমি উদ্ধার করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। হাজী সাহেব নিজে নাকি একবার আদালত থেকে সাজার হুকুম পেয়েছিলেন, সে-সাজা কার্যকর হয়নি, এখন যদি হয় তবে সেটা বিস্ময়ের ব্যাপার হবে না। হুকুমেরও সময়-অসময় আছে বইকি।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর