১৯৭১ সালে রণাঙ্গনে যখন বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করছিলেন, তখন বিলেত এবং আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিরাও এক ধরনের মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। তাদের যুদ্ধ অস্ত্রহাতে ছিল না, ছিল বাকশক্তি এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য, বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ের জন্য। যা ছিল অপরিহার্য। সে সময়ে বাংলাদেশের বাইরে সর্বোচ্চসংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস ছিল বিলেতে এবং তাই সে দেশেই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সংগ্রাম ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে। অস্ত্রহাতে বীর যোদ্ধারা যেমন প্রতিদিনের বিরাট অংশ কাটাতেন রণক্ষেত্রে, আমরা প্রবাসী যোদ্ধারাও কিন্তু প্রতিদিনের বিরাট অংশ আমাদের আন্দোলনের কর্মক্ষেত্রে কাটাতাম।
সেই দুঃখভারাক্রান্ত দিনগুলোতে প্রথম দিকে বিবিসি বা বিশ্বে প্রচারিত গণমাধ্যম ছাড়া সরাসরি দেশের বা যুদ্ধক্ষেত্রের খবর পেতাম না, দেশে আপনজনদের খবর পেতাম না। জানতাম না অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। তাই সরাসরি খবরের জন্য চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকতাম। ঠিক সে সময়েই এপ্রিলে বিলেতে আমাদের কাছে পৌঁছেছিল একটি অসাধারণ আশাব্যঞ্জক গানের রেকর্ড, যে গানটির কথাগুলো ছিল, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে-বাতাসে উঠে রণি, বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’। যেমন অসাধারণ ছিল গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথাগুলো, তেমনি গায়ক অংশুমান রায়ের কণ্ঠ। এ দুই মিলে সৃষ্টি করেছিল এক অভাবনীয় মূর্ছনা। গানটি প্রবাসী সবার মধ্যে সৃষ্টি করেছিল অভূতপূর্ব উদ্দীপনা। মুহূর্তের মধ্যেই গানটি নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল। গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে আমরা খুঁজে পেলাম আশার প্রজ্বলিত আলো। নিশ্চিত হলাম দেশ স্বাধীন হবে। উপলব্ধি করলাম শিল্পী, সাহিত্যিকসহ ভারতের মানুষ আমাদের পাশে রয়েছে। এর কিছুদিন পরই আমরা পেলাম উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া আরও একটি মনোবল জোগানো গান, যার কথাগুলো হলো- ‘মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি, তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’। হেমন্ত বাবুর সেই রক্তে ঝড় তোলা গান শুনে প্রবাসীরা অস্ত্রহাতে যুদ্ধে নামার জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিলেন। সেই গানের গীতিকারও ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। এটি ছিল শুকনো গাঙে জোয়ার আনার মতো একটি গান। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে কলকাতা থেকে একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের জন্য গাওয়া গানগুলো আসতে লাগল। এর মধ্যে পেলাম শ্যামল মিত্রের দুটি গান যার মধ্যে প্রথমটি ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করার অমর সেই গান, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’। শ্যামল মিত্রের অন্য গানটি ছিল ‘পদ্মা নদীর পারে আমার ছোট সবুজ গ্রাম, আছে মনে সেই যে গ্রামের নাম, সেথায় মাঝির গান আমায় জুড়িয়ে দিত প্রাণ’।
মান্না দে তাঁর আদি একটি গানের পেরোডি করে গেয়েছিলেন এই বলে ‘না না না ইয়াহিয়া তুমি হত্যা যতই করো না, শুনেছি বাঙালিদের মুখে জয় বাংলা মুক্তিধ্বনি, মশাল হাতে পথ দেখাচ্ছে, নায়ক মুজিবর’, আদি গানের কথা ছিল ‘না না না আজ রাতে আর যাত্রা শোনতে যাব না’। এপার বাংলার অতি আপনজন শচীনকর্তা তাঁর আদি গানটি, যা ছিল ‘বাজে তাকডুম তাকডুম বাজে, বাজে ভাঙা ঢোল’, পরিবর্তন করে নতুন করে গাইলেন ‘বাজে তাকডুম তাকডুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল’। মানবেন্দ্র সতীনাথ এবং গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানও আমাদের কাছে যথাসময়ে পৌঁছেছিল, পৌঁছেছিল সমর দাসের সুরে গাওয়া ভূপেন হাজারিকার গান। তবে প্রবাসীদের কাছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যুদ্ধকালীন গাওয়া গানের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল সে গানটি যেটি তিনি বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার পরে গাইলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়’। যদিও কিংবদন্তির গীতিকার, সুরকার, সলিল চৌধুরী যুদ্ধ চলাকালে কোন গানে গীত রচনা বা সুর করেছিলেন এমনটা জানা যায়নি, কিন্তু তাঁর আগের গানগুলো যেমন, ‘ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রী এখানে থেমো না’ এবং ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’ আবার নতুন উদ্যমে প্রবাসীরা শুনেছে। তদুপরি সলিল বাবু এক বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন ভারতের শীর্ষ সংগীত এবং চিত্রশিল্পীদের নিয়ে, যার মধ্যে ছিলেন লতা মঙ্গেশকর, মোহাম্মদ রফি, আশা ভোঁসলে, ওয়াহিদা রহমান, কাইফি এবং শাবানা আজমি, নার্গিস, সুনীল দত্ত, শংকর জয়কিশানসহ অন্যান্য। এ অনুষ্ঠানে যত পয়সা উঠেছিল তার সবটাই গিয়েছিল বাংলাদেশ তহবিলে। সে অনুষ্ঠানের রেকর্ডও আমরা পেয়েছিলাম। বিশ্বনন্দিত সিতারবাদক পন্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর ভক্ত বিটলস জর্জ হ্যারিসনসহ নিউইয়র্কে এক বিশাল কনসার্ট করেছিলেন যেখানে, জর্জ হ্যারিসন ‘বাংলাদেশ’ গানটি লাখো মানুষের সামনে গেয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশে গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছিলেন, রাতারাতি বিশ্ব জনতা জানতে পেরেছিল গণহত্যার কথা। অনুষ্ঠানে রবিশঙ্কর ছাড়াও আল্লা রাখা খান, ওস্তাদ আলি আকবর খান এবং বিটল রিঙ্গু স্টারও ভূমিকায় ছিলেন। বাংলাদেশের জন্য গান গেয়েছিলেন মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ এবং জোন বাজেস। এপার বাংলায় জন্ম নেওয়া সে সময়ে ভারতের হিন্দি গানের জগতে লতা মঙ্গেশকারের একমাত্র মহিলা প্রতিদ্বন্দ্বী গীতা দত্ত জীবিত ছিলেন বটে কিন্তু তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে এতই বিধ্বস্ত ছিলেন যে গান গাওয়া তাঁর হয়ে ওঠেনি।মে মাসের শেষ দিক থেকে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার শিল্পীদের গান পেতে থাকলাম। বেতারের বীর কণ্ঠযোদ্ধাদের যে গানগুলো বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তার মধ্যে ছিল সমর দাসের সুর এবং কণ্ঠ, মোস্তাফিজুর রহমানের লেখা ‘ভেবনাগো মা তোমার ছেলেরা হারিয়ে গিয়েছে পথে’, আবদুল জব্বারের কটি গান যেমন ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের শ্মশান করেছে কে’, যার গীতিকার ছিলেন মোকসেদ আলি সাঁই, ‘মুজিব বাইয়া যাও রে’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, আবদুল জব্বারের কণ্ঠে তখন, ’৭১-এর আগে গাওয়া গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ও প্রথম শুনলাম, যে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতারের সিগনেচার টিউন ছিল। আপেল মাহমুদের ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’, ‘তীরহারা ওই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ গানগুলো সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিলেত পৌঁছেছিল। সম্মিলিত কণ্ঠে গাওয়া ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল’, গানটিও জাগরণের ঢেউ তুলেছিল প্রবাসীদের মনে। স্বপ্না রায়ের কণ্ঠে শুনেছি ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না’, জীবনানন্দ দাশের কবিতার ওপর অজিত রায়ের গান ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ শুনেছি, শুনেছি তাঁর গলায় সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতার ‘হে মহামানব একবার এসো ফিরে’ কথাগুলোয় সুর দেওয়া গান।
স্বাধীন বাংলা বেতারের বহু শিল্পী যথা-
মনোরঞ্জন ঘোষাল, অরূপ রতন চৌধুরী, কাদেরী কিবরিয়া, বুলবুল মহলানবীশ, কল্যাণী ঘোষ, তপন চৌধুরী, প্রবাল চৌধুরী, ফকির আলমগীর, কামালউদ্দিন, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, ওমা খান, অনুপ ভট্টাচার্য, মলয় গাঙ্গুলি, পূর্ণিমা চৌধুরী, নমিতা ঘোষ, রঞ্জন ঘটক, জয়ন্তী লালা, রফিকুল আলম, বিপুল ভট্টাচার্য, রেজাউল করিম, নওশেদ, শাহ আলি সরকার, শেখ জমিরুদ্দিন, মান্না হক, রূপা খান, মালা খান, ইনু খানসহ আরও অনেকের গান শুনেছি। এত বছর পর সবার নাম মনে করতে পারছি না, নিশ্চয়ই তাঁরা এটি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন।
’৬০-এর দশকে আমাদের সংস্কৃতিতে পাকিস্তানি আগ্রাসন রোধে অনন্য ভূমিকা রাখা ছায়ানটের স্রষ্টা সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক এবং তাঁদের সঙ্গে মাহমুদুর রহমান বেনু, শাহীন সামাদ, ডালিয়া নওশিন প্রমুখ ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ডি এল রায়, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গান গাইতেন, তাও আমরা পেতাম যুক্তরাজ্যে।
স্বাধীন বাংলা বেতারের কথা বললে যাঁদের নাম ভোলা যায় না, তাঁরা হলেন- কামাল লোহানী, আবদুল মান্নান, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, এম আর আখতার মুকুল, আলী যাকের। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পিএইচডি গবেষণারত এনামুল হকের (পরে ড. এনামুল হক হিসেবে জাদুঘরপ্রধান) নেতৃত্বে যুক্তরাজ্যে গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ ’৭১-এ প্রবাসীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় উৎসাহ ও চেতনা জিইয়ে রাখার মানসে। সেই সংস্থার সদস্য হিসেবে আমরা এনামুল হক, আলো চৌধুরী রচিত গান ছাড়াও পশ্চিম বাংলা এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠযোদ্ধাদের গানও গাইতাম। মুক্তিযুদ্ধে এসব শিল্পীর অবদানের কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
’৭১-এর সেই দিনগুলোতে সর্বদাই দেখতাম এক মুজিবের কণ্ঠ ধ্বনিই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির মুখে। দুঃখজনকভাবে জিয়া ক্ষমতা হস্তগত করার পর এসব গান দেশ থেকে মুছে ফেলেছিল, যার ধারাবাহিকতা খালেদাও অনুসরণ করেছিলেন। পরে মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতায় ফেরার পর এসব গান আবার নতুন করে প্রাণ পেয়েছে। আজ ঘরে ঘরে বাজছে সে গানগুলো, যার ফলে নতুন প্রজন্মের মানুষগুলো জানতে পারছে সেসব গানের মর্মকথা, জানতে পারছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কদিন আগে একটি দৈনিক পত্রিকায় দেখতে পেলাম বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে কয়েকটি ভিন্ন দেশের শিল্পীর সমন্বয়ে একটি নতুন গান তৈরির কাজ নিয়ে নিহন বাংলা প্রডাকশন নামক এক জাপানি সংস্থা এগোচ্ছে। এর কর্ণধার গীতিকার গোলাম মাসুম জিকো। এ গানের সঙ্গে অন্য জড়িত ব্যক্তিরা হলেন কলকাতার আবৃত্তিশিল্পী শুভদীপ চক্রবর্তী, শিল্পী চিরন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপঙ্কর বাগচী, জয়তি চক্রবর্তী, বাংলাদেশের মণি জামান ও আলিফ আলাউদ্দিন। এ প্রসঙ্গে কলকাতার শিল্পীরা বলেন, বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশেরই স্থপতি নন, তিনি পশ্চিম বাংলার মানুষের কাছেও ঋষিতুল্য। শুধু পশ্চিম বাংলা কেন, ভারতের অনেক জায়গায়, বিভিন্ন সেমিনারে যোগদানের জন্য ভ্রমণের সুযোগে জানতে পেরেছি ভারতের প্রায় সর্বত্রই বঙ্গবন্ধুকে একজন মহামানব এবং সব মানুষের মুক্তির দিশারি হিসেবেই মনে করা হয়। যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে জানতে পেরেছি সেখানকার এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে বার্ট্রান্ড রাসেল, আঁদ্রে মালরো, জর্জ বার্নাড শ্্ প্রমুখ মনীষীর সঙ্গে তুলনা করে থাকেন।
উল্লিখিত নতুন গানটিও ১৯৭১-এ গাওয়া গানগুলোর মতোই, যেগুলো আজও ঘরে ঘরে প্রতিনিয়ত বাজছে, বঙ্গবন্ধুকে নতুন প্রজন্মের কাছে যথাযোগ্য উপস্থাপন করবে বলে সবাই আশান্বিত। নতুন প্রজন্ম জানবে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরই সেদিন প্রতিধ্বনিত হয়েছিল সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির কণ্ঠে।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।