শনিবার, ২ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

স্মৃতিতে কাদের ভাই

শাইখ সিরাজ

স্মৃতিতে কাদের ভাই

সময়টা গত শতাব্দীর সত্তর দশকের শেষের দিকে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ভূগোলে অনার্স পড়ছি। অন্য ১০ ছাত্র যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটাকে উপভোগ করে আমার বেলায় তেমনটি ছিল না। আমি সে সময়টাকে উপভোগ করেছি অন্যরকম ব্যস্ততার  ভিতর দিয়ে। তখন থেকেই আমার টেলিভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, অন্যদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রতিদিন ‘শিল্পায়নে বাংলাদেশ’-এর উপস্থাপনা, শুটিং, এডিটিং ইত্যাদি; শুধু তাই নয়, বন্ধু সাগরের সঙ্গে হোটেল খাবার-দাবার পরিচালনা নিয়েও দারুণ ব্যস্ততা। এর মাঝে একদিন কিছুটা অবসরে বিকালে ক্লাস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে টিএসসিতে আড্ডা দিয়ে ফিরছিলাম। টিএসসির অডিটোরিয়ামের সামনে আসতেই দেখলাম কাদের ভাই নাটকের কতগুলো টিকিট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। কাদের ভাই মানে অভিনেতা আবদুল কাদের। কাদের ভাই তখন কেবল পরিচিত হয়ে উঠছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুহসীন হল ছাত্র সংসদের নাট্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন ডাকসু নাট্যচক্রের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যও। আন্তহল প্রতিযোগিতায় অভিনয়ের জন্য বহুবার পুরস্কার পেয়েছেন। যুক্ত ছিলেন থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে। যাই হোক, কাদের ভাইয়ের চোখে চোখ পড়তেই সালাম দিলাম। তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, কী? নাটক দেখবেন? তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি আর না করতে পারলাম না। বললাম, হ্যাঁ দেখব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই হিসেবে ফ্রি টিকিট দিয়ে দিলেন আমাকে। সেই প্রথম কাদের ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা বলা। নাটক পুরোটা দেখার মতো সময় আমার হাতে ছিল না, শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই বের হয়ে এলাম। গেটে বের হতেই কাদের ভাইয়ের মুখোমুখি। যেন তাঁকে দেখিইনি এমন ভাব করে বের হয়ে এলাম। কিন্তু টের পাচ্ছিলাম কাদের ভাইয়ের বিস্মিত দুটি চোখ আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে পুনরায় দেখা। দিব্যি মনে রেখেছিলেন, বললেন, আরে দুষ্টু! তুই! সেই থেকে দেখা হলেই তিনি আমাকে ‘দুষ্টু’ বলে ডাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই থেকে ব্যক্তিজীবনেও বড় ভাই হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৮০ সালের দিকে বাংলাদেশে বিয়েসহ নানান সামাজিক অনুষ্ঠান ভিডিও ধারণ করার চল শুরু হলো। তখন মগবাজারে ‘সানমুন ভিডিও’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করি। সানমুন ভিডিও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৬ সালের কথা, তখন সানমুন ভিডিওর জন্য কিছু ভিডিও ইকুইপমেন্ট কিনতে সিঙ্গাপুর যাওয়ার প্রয়োজন হলো। জীবনের প্রথমবার বিদেশ যাচ্ছি একা। অন্যরকম এক উত্তেজনা কাজ করছিল। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল বাসার লোকজনের মাঝে। কোথায় থাকব, কী করব নানান প্রশ্ন। বন্ধুতুল্য ছোট ভাই জহিরুদ্দিন মাহমুদ মামুন বহুবার সিঙ্গাপুর গিয়েছে। সে বলল স্যারাঙ্গন স্ট্রিটে ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি হোটেল আছে। খরচও বেশি না। প্রতি রাতে ২০-২৫ সিঙ্গাপুর ডলার। বাসায়ও বললাম সিঙ্গাপুরে গিয়ে থাকব হোটেল নিউ ওয়ার্ল্ডে। প্রথমবার এতগুলো টাকা নিয়ে বিদেশে একা যাচ্ছি। ভিতরে ভিতরে বেশ শঙ্কা কাজ করছিল। যত দূর মনে পড়ে খুব সম্ভবত ১৪ মার্চ সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে রওনা হলাম। ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছে বোর্ডিং পাস নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল কাদের ভাইও দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে দেখে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হলেন, ‘আরে দুষ্টু! কোথায় যাচ্ছিস?’

বললাম, ‘সিঙ্গাপুর। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’

‘আমিও সিঙ্গাপুর যাচ্ছি। বাটা কোম্পানির একটা মিটিং আছে।’

কাদের ভাই তখন বাটা কোম্পানির বড় কর্মকর্তা। দুজনই দুজনকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে আনন্দিত, একজন সঙ্গী পাওয়া গেল। একসঙ্গেই প্লেনে চড়লাম। প্লেনে চড়ে পাশাপাশি বসে নানান বিষয়ে কথা হলো। খুব রসিক মানুষ ছিলেন। পাশের জনকে আনন্দ দিতে ভালোবাসতেন। ব্যাংককে ছিল ট্রানজিট। ব্যাংকক এয়ারপোর্টে নেমে একটা কক্ষে সবাইকে নিয়ে জড়ো করা হলো। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন বিমানের ভিন্ন ভিন্ন প্যাসেঞ্জার। তখন তো আর এখনকার মতো উন্নত ছিল না এয়ারপোর্টের সিস্টেম। কিছুক্ষণ পর একজন এসে নাম ডেকে প্যাসেঞ্জারদের নিয়ে যেতে থাকল। প্রথম বিদেশ ভ্রমণ, এ বিষয়টায় শঙ্কিত হলাম। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওদের? শুনেছি এয়ারপোর্টে চোরাকারবারিদের ধরে আটকে রাখে, ওরা চোরাকারবারি না তো! এর মাঝেই কাদের ভাইয়ের নাম ডাকল। এর পরই আমার নাম ডাকল। যথারীতি আমাদেরও সেই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে হলো। দেখলাম সবাইকে নিয়ে একটা বাসে তোলা হলো। আর আমাদের তোলা হলো একটা ছোট প্রাইভেট কারে। মনে মনে ভাবছিলাম, আমাদের কেন আলাদা গাড়িতে তোলা হলো! কাদের ভাই যেন মনের কথা পড়তে পারলেন। বললেন, ‘এই ওরা বোধহয় ভাবছে আমরা বড় অপরাধী তাই আমাদের পৃথক গাড়িতে তুলে নিয়েছে।’ কাদের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম তিনি রসিকতা করছেন কিনা। দেখি তাঁর চোখ-মুখ শক্ত। এর মাঝেই গাড়ি পৌঁছে গেছে রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানের কাছে। বাস ছিল আগে। বাস থেকে প্যাসেঞ্জাররা নেমে বিমানে উঠছিল। বুঝলাম, বিমানে তোলার জন্যই আমাদের গাড়িতে তোলা হয়েছিল। দেখলাম কাদের ভাইয়ের মুখে সেই চিরাচরিত মুচকি হাসি, ‘কী? কেমন দেখলি? কেমন ভিআইপি আদরে বিমানে তুলছে! কী বুঝলি?’ বিমানে চড়ে আর একটা ধাক্কা খেলাম। এয়ার হোস্টেস অন্যদের বিমানের যেদিকে যেতে বলেছে আমাদের সেদিকে না নিয়ে অন্যদিকে নিয়ে এলো। একেবারে আলাদা আসন ব্যবস্থা। কাদের ভাই এবারও গুরুগম্ভীর ভাব নিলেন। এয়ার হোস্টেস চলে যেতেই বললেন, ‘দেখেছিস! আমার সঙ্গে এসেছিস বলেই এত সুবিধা পাচ্ছিস! এটাকে বলে বিজনেস ক্লাস!’ বিজনেস ক্লাসের সুবিধাদি ভোগ করছিলাম। হঠাৎ মনে হলো মামুন আমাকে বলেছিল, ফ্লাইট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ট্রাভেল এজেন্সির সম্পর্ক ভালো থাকলে বিজনেস ক্লাস খালি থাকলে অনেক সময় ইকোনমি ক্লাসের টিকিটকে বিজনেস ক্লাসে আপগ্রেড করে দেয়। এখানেও তা হয়েছে। আমি টিকিট বের করে দেখি টিকিটে লেখা ‘জে’। অর্থাৎ বিজনেস ক্লাসেরই টিকিট। টিকিট দেখিয়ে কাদের ভাইকে বললাম ব্যাপারটা। কাদের ভাই প্রথমে চুপসে গেলেন, তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘বড় ভাইয়ের সঙ্গে আসছিস বলে এত সেবাযত্ন পাচ্ছিস- এটা ভাবতে তোর সমস্যা কী!’ বললাম, কোনো সমস্যাই নেই। দুই ভাই মিলে বসে গল্প করতে করতে চললাম সিঙ্গাপুরের দিকে। কাদের ভাই জানতে চাইলেন, কীসের জন্য সিঙ্গাপুর যাচ্ছি? কোথায় থাকব? কদিন থাকব? সব বললাম। বললেন, ‘হোটেল নিউ ওয়ার্ল্ডে থাকবি তো! আমাকে নিতে গাড়ি আসবে, তোকে নামিয়ে দিয়ে যাব।’ তাই করলেন। সারাটা পথ সঙ্গী হয়ে ছিলেন। যাওয়ার পথে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। বললেন, ফেরার টিকিট কনফার্ম করতে ১৫ তারিখে বাংলাদেশ বিমান অফিসে যাবেন। আমি জানালাম আমিও যাব। যাই হোক, হোটেলের রিসিপশনে গিয়ে দেখলাম প্রচুর ভিড়। চাহিদার সূত্রে হোটেলের ভাড়াও গেল বেড়ে। মামুন আমাকে যে ভাড়া বলেছিল তার দ্বিগুণ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আশপাশে খুঁজে আর একটা হোটেল বের করলাম। বিপস স্ট্রেট। একটি বাড়ি ভাড়া করে আমাদের চট্টগ্রামের এক ছেলে হোটেল বানিয়েছে। খাবারদাবারও দেশি। কাঁচকি মাছ থেকে শুরু করে করলা ভাজি, মসুরের ডাল সবই আছে। দেখে ভালো লাগল। ভাড়াও কম। বিপস স্ট্রেটেই উঠে পড়লাম। খাবারদাবার ভালো। থাকার জায়গাও স্বচ্ছন্দময়। তবু অপরিচিত জায়গা বলে ঘুম হলো না সারা রাত। সকালের দিকে ঘুম এলো। ঘুম ভাঙল অদূরে হট্টগোলের শব্দে। প্রথমে ভাবলাম বিদেশে বোধহয় এমনই। কিন্তু শোরগোল বেড়েই চলছিল। সঙ্গে গাড়ির শব্দ। সাইরেন। প্রচুর অ্যাম্বুলেন্স আসা-যাওয়া করছে। রেডি হয়ে নিচে নেমে রিসিপশনে গেলাম। দেখলাম সবাই স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের দিকে। প্রথমে কিছুই বুঝলাম না। টেলিভিশনে মনে হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো জায়গার ছবি দেখাচ্ছে। পরে বুঝতে পারলাম হোটেল নিউ ওয়ার্ল্ড ধসে পড়েছে। সিঙ্গাপুর টেলিভিশনে লাইভ দেখাচ্ছে। বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। আল্লাহর অশেষ দয়ায় বেঁচে গেছি, গত রাতে ওখানেই আমার ওঠার কথা ছিল। প্রচুর মানুষের হতাহতের খবর আসছিল।

কিছু দিন আগেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে এশিয়াভিশনের সংবাদ বিনিময়ের একটি চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিতে ছিল এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ঘটে যাওয়া সংবাদের ভিডিও ফিড এশিয়াভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিভিশন পাবে। আমি ভাবলাম, এ সংবাদটি বাংলাদেশে প্রচার হলে আমার পরিবার আমাকে নিয়ে শঙ্কাগ্রস্ত হবে। সবাই অস্থির হয়ে যাবে। তাদের কাছে হোটেল নিউ ওয়ার্ল্ডের কথা বারবার বলেছি, বলেছি সিঙ্গাপুরে এখানেই উঠব। তখন তো এখনকার মতো চাইলেই যোগাযোগ করা যেত না। টিঅ্যান্ডটির যুগে বিদেশ থেকে কল করাও ছিল কঠিন এবং ব্যয়বহুল। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলাদেশ বিমান অফিসে যাই, সেখানে কোনো বাঙালি পেলে নিশ্চয়ই টিঅ্যান্ডটিতে ঢাকায় কল করার সুযোগ পাব। বিমানের অফিসে গেলাম। সেখানে ম্যানেজার ছিলেন ফারুক সাহেব। তাঁকে সব খুলে বললাম।

তিনি ফোনে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমার ফেরার টিকিট কনফার্মেশন হলো। ফারুক সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে ফেরার সময় বললাম, ‘কাদের ভাইও আসবেন টিকিট কনফার্ম করতে। তিনি হয়তো আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। কারণ তিনি জানেন আমি হোটেল নিউ ওয়ার্ল্ডে উঠেছি। আপনি অনুগ্রহ করে তাঁকে জানাবেন আমি ভালো আছি।’ আমি হোটেল বিপস স্ট্রেটের ফোন নম্বরসমেত কার্ড রেখে এলাম। হোটেলে ফিরতে না ফিরতেই ফোন এলো। কাদের ভাইয়ের কণ্ঠ। কণ্ঠে উৎকণ্ঠা। ‘সিরাজ! সব ঠিক তো!’ আমি বললাম, কাদের ভাই, আল্লাহর রহমতে বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। গত রাতে ওই হোটেলে ওঠার কথা ছিল কিন্তু উঠিনি। সব শুনে তিনি শান্ত হলেন। কিন্তু অনুভব করলাম এক বড় ভাইয়ের হৃদয়ের উষ্ণতা।

কাদের ভাইয়ের সঙ্গে এক অসাধারণ হৃদ্যতার বন্ধনে জড়িয়ে গেলাম। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও চ্যানেল আই প্রতিষ্ঠার পর কাদের ভাই হয়ে উঠলেন আমাদের আরও কাছের জন। আমরা হয়ে উঠলাম একই পরিবারের স্বজনের মতো। আমাদের অনুষ্ঠান, নাটক, টেলিফিল্মে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল। এই তো মাস ছয়েক আগেও, করোনা বিস্তারের প্রথম দিকে একদিন ফোন করলেন কাদের ভাই। তাঁর আদরের নাতনি সিমরিন লুবাবা শিশুদের হাত ধোয়া নিয়ে একটা ভিডিও বানিয়েছে তা দেখার জন্য। নাতনিকে উৎসাহ দিতে আমরা সেটি টেলিভিশনেও প্রচার করেছিলাম। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি প্রায়ই বলতেন ব্যাকপেইন নিয়ে খুব কষ্টে আছেন। তখনো তিনি জানতেন না তাঁর ক্যান্সার। এর মাঝে একদিন ভাবি ফোন করলেন। কান্নামাখা কণ্ঠে জানালেন কাদের ভাইয়ের ক্যান্সার আক্রান্তের খবর। ভাইকে নিয়ে তাঁরা এখন চেন্নাইয়ের হাসপাতালে। ডাক্তার জানিয়েছেন ক্যান্সার ফোর্থ স্টেজে। ক্যামো দেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা নেই। দেশে ফিরে যেতে হবে। শুনে ভীষণ মন খারাপ হলো। ভাবিকে সান্ত¡না দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলাম না। এরপর কাদের ভাইয়ের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে কথা হয়। প্রতিদিনই ভাবি কিংবা তাঁদের ছেলেবউয়ের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত কাদের ভাইয়ের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। একদিন ভাবি বললেন, ‘সিরাজ ভাই! আমরা ইউএস বাংলা বিমানে আপনার ভাইকে নিয়ে ফিরব। কিন্তু আপনার ভাইয়ের যে শারীরিক অবস্থা ডাক্তার বলছেন জার্নির সময়টাতে সব সময় অক্সিজেন স্ট্যান্ডবাই রাখতে হবে। ইউএস বাংলার চেন্নাই অফিসে যোগাযোগ করেছিলাম, তারা বললেন এ সুবিধা তাদের কাছে নেই। এখন কী করব?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করলাম ইউএস বাংলার স্বত্বাধিকারী আমার ছোট ভাই তুল্য আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে। মামুনকে ফোন দেওয়ার পর সব শুনে বলল, শুধু অক্সিজেন সিলিন্ডার নয় আর কী কী করতে হবে বলেন। আমি বললাম, চেন্নাই অফিসের লোকদের একটু বলে দিও প্লেনে ওঠার আগে পর্যন্ত যে সুবিধাগুলো কাদের ভাইয়ের প্রয়োজন সেগুলো যেন তাঁরা ব্যবস্থা করেন। মামুন তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিল। তার পরদিন সকালে মামুন আমাকে জানাল, ‘একাধিক অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকবে, একটা স্ট্রেস ব্যাড থাকবে এবং আমি চেষ্টা করব ঢাকা থেকে একজন ডাক্তার দিয়ে দেওয়ার। এ রকম রোগী হ্যান্ডল করার অভিজ্ঞতা আছে এমন একজন এয়ার হোস্টেসও রাখার ব্যবস্থা করব।’ মামুন যতটুকু আমাকে বলেছে তার চেয়েও বেশি করেছে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছা অবধি সময়ে সময়ে সে আমাকে কাদের ভাইয়ের অবস্থা সম্পর্কে জানিয়েছে। ছবি পাঠিয়েছে। মামুনের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই। কাদের ভাই ট্রানজিটে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে পৌঁছেই আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। বললেন, ‘সিরাজ! ওরা খুব সেবা দিয়েছে রে।’ ঢাকা পৌঁছে আবার ফোন দিলেন, সিরাজ! নিরাপদে ঢাকায় আসছি। হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি, দোয়া রাখিস।’ আমি বললাম, চিন্তা করবেন না কাদের ভাই। আল্লাহ সহায়, আপনি সেরে উঠবেন।

গত শনিবার সকালে কাদের ভাই চলে গেলেন অচিন দেশে। মাথার ওপর থেকে আর এক বড় ভাইয়ের ছায়া সরে গেল। কাদের ভাই! যেখানে থাকুন আপনার এই দুষ্টু ভাইয়ের ভালোবাসা জানবেন।

যেন বিষেভরা ২০২০ সাল! কত প্রিয় মুখ, কাছের স্বজন চলে গেলেন এ বছরে! ফজলে হাসান আবেদ, ড. আনিসুজ্জামান, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, কামাল লোহানী, রাহাত খান, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমান, এন্ড্রু কিশোর, কে এস ফিরোজ, আলী যাকের, মান্নান হীরা, আবদুল কাদের... আরও অনেকেই। মৃত্যুর এত দীর্ঘ সারি আগে কখনো দেখিনি। মৃত্যুর বছর শেষে ২০২১ হোক ভিন্ন রকম। আশার, জন্মের, নতুন আলোর। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর