বুধবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

পশ্চিমবঙ্গে টাকা ছড়াচ্ছে বিজেপি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

পশ্চিমবঙ্গে টাকা ছড়াচ্ছে বিজেপি

পর্শ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন আসন্ন। বর্তমান বিধানসভার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২৬ মে। সরকারি সূত্রে বলা হয়, সাত-আট কিস্তিতে ৮ কোটির অধিক ভোটারের ভোট নেওয়া হবে। এ নির্বাচন কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে গোটা রাজ্যে সন্ত্রাস, খুন-জখম, লুট, বোমা তৈরি, অগ্নিসংযোগ, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ- কী নেই! গত এক মাস ধরে রাজ্যের ২৩ জেলায় হিংসার বাতাবরণ ঊর্ধ্বগতিতে এগিয়ে চলেছে। এক কথায় বলতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে এখন গণতন্ত্র বিপন্ন। গোটা রাজ্যই ফ্যাসিবাদের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে।

এর অন্যতম কারণ দাদা নরেন্দ্র মোদি ও গোটা বিজেপি ঘোষণা করেছেন, তারা পশ্চিমবঙ্গ দখল করবেন। তাদের ভাষা-ভঙ্গিতে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ একটি বিদেশি রাষ্ট্র। তাই তারা যুদ্ধ করে দখল করবেন। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে দিল্লি থেকে মোদির মন্ত্রিসভার ডজনখানেক সদস্য করোনা উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় শিবির খুলেছেন। এক বছরের বেশি সময় ধরে তারা ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে আরএসএসের প্রশিক্ষণ শিবির চালাচ্ছেন। প্রতিদিন সকালে স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল খুললে দেখা যায় তারা কীভাবে হিংসা ছড়াচ্ছেন। এ হিংসার অন্যতম কারণ অর্থ। কে কত টাকা রোজগার করতে পারে। হিংসার উদ্যোক্তা নব বনাম আদি বিজেপি। নব বনাম আদি তৃণমূল। স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিশ্বহিন্দু পরিষদ বা বিজেপি একটি আসনও পায়নি। কেবল ২০১৬ সালে তিনটি আসন পেয়েছিল। সেই বিজেপি ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ১৮টি আসন পায়।

এবারের নির্বাচনে বিজেপি, তৃণমূল ও বাম-কংগ্রেস জোট- এ তিন শক্তির লড়াই হতে চলেছে। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস ২৭ বছর, বাম জোট ৩৪ বছর এ রাজ্যটি শাসন করে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করে। এবারের নির্বাচনে বিজেপির লক্ষ্য ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি। মমতারও তা-ই। নির্বাচন সামনে রেখে বাম-কংগ্রেস জোট তাদের প্রচারে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপরই বেশি জোর দিচ্ছে। বিজেপি হিন্দু ভোট নেওয়ার জন্য ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে টাকা বিতরণ করছে বলে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন। তারা মনে করছেন তাদের ‘বস’দের জানিয়েও লাভ নেই। কারণ সর্বোচ্চ আসনে বসে আছেন স্বয়ং অমিত শাহ। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার এ নায়ক ঘন ঘন পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসছেন। আর বাংলাদেশের মতুয়া সম্প্রদায়কে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার লোভ দেখাচ্ছেন (মতুয়া, অর্থাৎ নমশূদ্র)। অন্যদিকে গত দুটি নির্বাচনে উত্তর বিহার থেকে একদা পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছে যেসব বিহারি, এর মধ্যে জামায়াত আছে, জেএমবি আছে, রাজাকার আছে, আছে আরও হরেকরকমের সন্ত্রাসবাদী। মমতার দৌলতে গত ১০ বছরে এরা ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়ে গেছে। এর অধিকাংশেরই বাসস্থান এখন উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, মালদা, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর। গত কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, বাঙালি সংগঠকরা মমতার দলকে কখনো ভোট দেয়নি। তিনি বিহারিদের ভোট পেয়েছেন।

আসন্ন নির্বাচনে বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার শিল্প- সবকিছু ধ্বংস করার জন্য বিজেপি রবীন্দ্রনাথকে টেনে এনেছে। মোদি ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা বলছেন, বিজেপি বাংলা দখল করেই ‘সোনার বাংলা’ করে দেবে। আর মমতা নির্বাচনী সভাগুলোয় বক্তৃতা শেষে বলছেন ‘জয় বাংলা’। এ দুটি স্লোগানই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সৃষ্টি। ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের এ স্লোগান গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ভোটে জেতার জন্য বিজেপিওয়ালারা বারবার স্বামী বিবেকানন্দের উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। অথচ স্বামীজি কী বলেছিলেন, তা বোধ হয় তারা পড়ে দেখেননি। স্বামীজি বলেছিলেন, ‘ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগ নেই।’ বাঙালিদের দুর্ভাগ্য, তারা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল- যাঁরা বাংলার সংস্কৃতি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন, তাঁদের কথার অপব্যাখ্যা করে এরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত পশ্চিমবঙ্গ সফর করে মমতার আমলে তৈরি আরএসএসের ১২৮টি স্কুল পরিদর্শন করে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য নির্দেশ দিয়ে গেছেন। আরএসএস স্বয়ং বিশ্বভারতীকে নির্বাচনী হাতিয়ার করেছে। বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য যিনি ছাত্রজীবন থেকেই আরএসএসের সদস্য, সেই বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর আবিষ্কার- নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বিশ্বভারতীর জমি চুরি করেছেন!

ভোটব্যাংকের জন্য আরএসএসের এ কুৎসিত মনোভাব ছাপার অক্ষরে লেখা যায় না। বিশ্বভারতীর ইতিহাস নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা কেউ জানেন না বা বোঝেন না। অমর্ত্য সেন শান্তিনিকেতনের যে বাড়িটিতে থাকেন প্রতীকী ট্রাস্টের সে বাড়িটি তৈরি হয়েছিল ৬০ বছর আগে। তৈরি করেছিলেন নোবেলজয়ীর বাবা আশুতোষ সেন, যিনি একসময় বিশ্বভারতীর উপাচার্য ছিলেন। অমর্ত্য সেনের দাদু (মাতামহ) ক্ষিতীশ মোহন সেন, যিনি রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, এ বাড়িটি তৈরিতে তাঁরও ভূমিকা ছিল। গেরুয়া বাহিনী দলিল-দস্তাবেজ খুঁজে বের করেছে ওই বাড়ির মাত্র ৫ ডেসিমেল বিশ্বভারতীর জমির মধ্যে পড়ে। কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শান্তিনিকেতনে গিয়ে এ তথ্য খুঁজে পান। তার পরই পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নেতারা বলতে শুরু করেন, অমর্ত্য সেন জমিচোর। অর্ধশিক্ষিত অপসংস্কৃতির ধারক ও বাহক গেরুয়া বাহিনীর এ মন্তব্যে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা পৃথিবীর সুধীমহলের ধিক্কারে ফেসবুক টুইটার ভরে গেছে। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের ওপর বিজেপির রাগ কেন? ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর দাবি করেছিলেন, গোটা ভারতকে তিনি গুজরাট মডেলে উন্নীত করবেন। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সেদিন বলেছিলেন, গুজরাট মডেল বলে কিছু নেই। গুজরাটে মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছে, বেকার সমস্যায় জর্জরিত। অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি যা দেখেছিলেন তা-ই বলেছিলেন। অমর্ত্য সেন তখন ছিলেন গয়ার বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। জাপানের আর্থিক সাহায্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে উঠেছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের আমলে। গুজরাট মডেলকে চ্যালেঞ্জ করতেই অমর্ত্য সেনকে উপাচার্য পদ থেকে সরিয়ে দেয় মোদি সরকার। সেই থেকেই গেরুয়া বাহিনী অমর্ত্য সেনের ওপর ক্ষুব্ধ।

মহামতি গোখলে বলেছিলেন, ‘হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টু ডে ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমোরো।’ ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ভেঙে কিছু লোককে টাকা দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করা হয়েছিল মমতার নেতৃত্বে। বিজেপি কোটি কোটি টাকা ছড়িয়ে মমতার দল থেকে লোক ভাগিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন পুরসভা, বিধানসভা, লোকসভা কেন্দ্রে। একেই বলে ইতিহাসের নির্মম পরিহাস! সেদিন বহুদর্শী অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘পর্শ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে টেনে আনার ফল ভোগ করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ কখনই জাতপাতের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না, করবে না। এখানে সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বাস করে।’ এ বিভাজন শুরু হয়েছিল মমতার হাত ধরে, সে বৃত্ত সম্পন্ন হলো বিজেপির উদ্যোগে।

রাজনৈতিক বিশেষদের প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন কোন পথে হাঁটবে? ধর্মীয় বিভাজনের পথে নাকি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-স্বামীজির ধর্মনিরপেক্ষতার পথে? এর উত্তর পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও ১২০ দিন।

 

            লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর