বৃহস্পতিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ছোট ছোট ভাবনা

তসলিমা নাসরিন

ছোট ছোট ভাবনা

১. নববর্ষ, ২০২১। দিনটি যে কোনও দিনের মতো দিন। করোনা এই দিনটির আগেও ছিল, পরেও থাকবে। টিকা কিছুটা নিস্তার দেবে বৈকি। সবাই সমস্বরে শুভ কামনা করছে, এ বছরটি যেন দুর্যোগমুক্ত হয়। আমাদের শুভ কামনায় পৃথিবী এবং প্রকৃতির কিছু যায় আসে না। যেভাবে বছর যায় সেভাবে বছরটি যাবে। ভালো থাকবে, ভালোর গায়ে লেগে খারাপও থাকবে। প্রাচুর্য থাকবে, দারিদ্র্যও থাকবে। অসুখ বিসুখ ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়া না চাইলেও থাকবে। দুর্ঘটনা থাকবে। মৃত্যু থাকবে। সব জেনেও আমরা হ্যাপি নিউ ইয়ার বলেছি যাকে সামনে পাচ্ছি তাকেই। সভ্যতা, উদারতা, মানবিকতা তো এরই নাম। আজও মানুষ শুভেচ্ছা বিনিময় করছে। এমন দিন কি কখনও আসবে কেউ কাউকে আর নতুন দিনের শুভেচ্ছা জানাবে না? যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন তেমন ভয়াবহ দিন আসবে না, এই এক স্বস্তি।

২. ভারতে থেকেও ভারতের কত কিছু যে জানি না। কাল রাতে দক্ষিণ ভারতের এক ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে কথা হলো। সে বলে সে নমঃশূদ্র। আমি জাতপাতে বিশ্বাস করি না, ভেবেছিলাম সেও নিশ্চয়ই করে না। কিন্তু ঠিকই করে। সিনেমা থিয়েটারের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বললো, শিল্প সাহিত্যে, সংস্কৃতি সঙ্গীতে ব্রাহ্মণরা অনেক ভালো। বললো ব্রাহ্মণদের জিনই আলাদা, সুপিরিওর। ভেবেছিলাম মজা করছে বোধহয়। তারপর দেখলাম ও সিরিয়াসলি বলছে এসব। রীতিমতো বিশ্বাস করে। সকালে আমার এই অভিজ্ঞতার কথা লিখে টুইট করলাম, বললাম আমার এক বন্ধু এরকম ভাবছে, তাকে আমি বলেছি, ব্রাহ্মণ জিন বলে কোনও জিন নেই। ও মা, শত শত লোক আমাকে আক্রমণ করলো, বললো আমি নাকি ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছি। তারা আমার সেই বন্ধুকে সমর্থন করলো। তারা সত্যিই মনে করে ব্রাহ্মণদের জিন সুপিরিওর। আমি আকাশ থেকে পড়লাম।

জাতপ্রথা অফিসিয়ালি বিলুপ্ত করার পরও এত লোক জাতপ্রথায় বিশ্বাস করে! এ কারণেই হয়তো সমাজ থেকে জাতপ্রথা বিলুপ্ত হয়নি। কী করে হবে!

এ ঠিক নারীর সমানাধিকারের মতো। আইনে নারীরা সমানাধিকার পায়। কিন্তু সমাজে পায় না। মানুষ যতদিন কুপ্রথা পালন করবে, ততদিন আইন করেও কুপ্রথা দূর করা যাবে না।

৩. ভারতের কত কিছু যে জানি না। উড়িষ্যা আর ছত্তিশগড়ের আদিবাসীদের মধ্যে লাল পিঁপড়ের চাটনি খেয়ে কাশি জ্বর গলাব্যথা শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি দূর করার চল ছিল। সেটি এখন কভিড ঠেকানোর জন্য কেউ কেউ খাবে বলছে। লাল পিঁপড়ের চাটনি কী করে বানাতে হয়? লাল পিঁপড়ে নেবে, সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা। ব্যস বেটে নাও, চাটনি হয়ে গেল। নুন চিনি পরিমাণ মতো।

ভারতে তো মনে হচ্ছে ফাইজার আর মডার্না টিকা আসছে না। অক্সফোর্ড আর কোভ্যাক্সিন পেয়েছে ছাড়পত্র। এ দুটোর মধ্যে একটি নিতে হবে। ডাক্তার নার্স পুলিশ প্রথম নেবে। সাধারণ মানুষের টিকা নিতে ক’মাস অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। এখানে হয়তো আমেরিকা ইউরোপের মতো ব্যক্তির নামে চিঠি আসবে না, যে চিঠিতে লেখা থাকবে অমুক তারিখে অমুক সময়ে অমুক জায়গায় চলে এসো টিকা নিতে। আশা করি কয়েক হাজার লোকের লাইনে দাঁড়াতে হবে না। টিকা কিন্তু কেউ নেবে তো কেউ নেবে না তা হবে না। সবাইকে টিকা নিতে হবে। তা না হলে টিকা-না-নেওয়াগুলোর মধ্যে ভাইরাস ঘুরে বেড়াবে, মিউটেট করবে, বিকট আকার ধারণ করবে, আমাদের টিকা তাদের সঙ্গে পরে যুদ্ধ করে পারবে না।

টিকা আবিষ্কার করতে সাধারণত ১০ বছর লাগে, সেখানে এক বছরের মধ্যে টিকা হয়ে গেল। মানুষ কত কিছু যে পারে! খুব বড় জিনিস পারে, হয়তো ছোট জিনিসই পারে না। চাঁদে গিয়ে চাঁদের মাটি নিয়ে আসতে পারে পৃথিবীতে, কিন্তু মহল্লার গরিবদের অন্ন সংস্থানের উপায় বের করতে পারে না।

৪. সৌরভের মতো ফিট ছেলেরও কিনা হার্ট অ্যাটাক। শরীরে কোনও মেদ নেই, কিন্তু হার্টের আর্টারিতে মেদ। এর কারণ জিন। জিন হলো ভগবান ঈশ্বরের ডাকনাম। ভবিষ্যৎ কপালে লেখা থাকে না, লেখা থাকে জিনে। সুতরাং যত ফিটই হও না কেন, জিম করে দিন রাত যতই পার কর না কেন, জিন যা করার তা করবে।

আমার বাবার হয়েছিল হার্ট অ্যাটাক। আমার দুই দাদারই হয়েছিল হার্ট অ্যাটাক। একজনের হার্টের সব আর্টারি ব্লক ছিল, বাইপাস সার্জারি হয়েছে। আরেকজন প্রথম অ্যাটাকে বেঁচে গেলেও, দ্বিতীয় অ্যাটাকে বাঁচেনি। এই ফ্যামিলি হিস্ট্রি নিয়ে যখন আমি জিম করি, তখন ভাবি, জিম আমাকে বাঁচাবে না, বাঁচালে জিন বাঁচাবে। কিন্তু জিনোম থেরাপি করে খারাপ জিনগুলো ফেলে দেবো সে ক্ষমতা আমার নেই। অগত্যা যা হবে তা হবে বলে দিন যাপন করি। জানি যে কোনও মুহূর্তে দরজায় কড়া নড়ার শব্দ পাবো।

বাপ মা ভাই বোন কার কোন রোগ হয়েছিল, কে কোন বয়সে মারা গেছে, এই তথ্যই ইঙ্গিত দেবে আমার কী আছে, কী হবে, এবং আমি কবে। আমার ফ্যামিলির লোকেরা কেউই দীর্ঘজীবী নয়। সুতরাং আমিও লোল চর্ম হবো না, ফোকলা দাঁত হবো না, লাঠি হাতে নুয়ে নুয়েও হাঁটবো না। সে বয়সে আমাকে আমার জিনই পৌঁছোতে দেবে না।

সৌরভ দ্রুত চিকিৎসা পেয়েছেন বলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। মাঝে মাঝে আমি ভাবি, আমার যদি হার্ট অ্যাটাক হয়, পোষা বেড়ালটি কিছুক্ষণ মিউ মিউ করবে, কিন্তু আমাকে হাসপাতালে তো ও নিয়ে যেতে পারবে না। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ, কেউ তো ঘরে ঢুকতেও পারবে না। না, ওসব ভেবে লাভ নেই। জিন যদি সিদ্ধান্ত নেয় প্রথম অ্যাটাক মাইল্ড করবে, আমাকে মারবে না, তাহলে মরবো না। বড় অ্যাটাক হওয়ার পর গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যেই হাসপাতালে পৌঁছোতে যদি পারি, তাহলে গল্পটা বিচ্ছিরি নাও হতে পারে।

৫. আমি আর এখন ঘৃণা, রাগ, নির্মমতা, হত্যাকান্ড, যুদ্ধ- এসবের খবর শুনে অবাক হই না। মানুষের ভেতর দয়া মায়া যেমন আছে, ক্রোধ এবং প্রতিশোধ প্রবণতাও আছে। সুতরাং এগুলোর প্রকাশ আমরা দেখবোই। যাদের হাতে অস্ত্র, তারা অস্ত্রের জোর দেখাবে, যাদের হাতে অর্থ, তারা অর্থের জোর দেখাবে, যাদের হাতে ক্ষমতা, তারা ক্ষমতার জোর দেখাবে। খুব স্বাভাবিক। কোনও কিছুরই জোর যে দেখায় না, খোঁজ করলে দেখা যায় তার মস্তিষ্কে সমস্যা।

মানুষ কোনও শান্তিপ্রিয় প্রজাতি নয়। মানুষের সবচেয়ে কাছের যে আত্মীয় বানর, যাদের সঙ্গে মানুষের ডি এন এর শতকরা ৯৮.৮ ভাগ মিল, তারা মানুষের চেয়ে বেশি শান্তিপ্রিয়।

মানুষ যদি সবাই বুদ্ধিমান হতো, তাহলে হয়তো অভাব আর অশান্তি বলে পৃথিবীতে কিছু থাকতো না। সকলে বোকাও নয়, বোকা হলে পৃথিবীকে অনেক আগেই ধ্বংস করে ফেলতো।

৬. ধর্মের ভিত্তিতে কোনও রাষ্ট্র, কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক দল গঠন করা শুধু ভুলই নয়, অন্যায়।

পাকিস্তানের মৌলবাদী জঙ্গিরা একটি শিখ মেয়েকে অপহরণ করে ধর্মান্তরিত করেছে। গুরুদুয়ারায় হামলা করার হুমকি দিয়েছে। হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ কাউকে বাদ দেয় না এরা। কোনও অমুসলিমকে এরা বাঁচতে দিতে চায় না। এই জঙ্গিরা আহমদিয়া আর শিয়াকেও নিশ্চিহ্ন করছে। জঙ্গিরা মুক্তচিন্তকদেরও আক্রমণ করছে, জেলে ভরছে, নির্বাসনে পাঠাচ্ছে অথবা খুন করছে- মুক্তচিন্তক সুন্নি সম্প্রদায়ের হলেও। জঙ্গিতে ছেয়ে যায় ধর্মভিত্তিক দেশ। ধর্মের ভিত্তিতে আর কোনও দেশ গড়ার কথা ভুলেও যেন কেউ না ভাবে।

৭. সুন্দরী মেয়ের কুৎসিত বর দেখে অভ্যস্ত আমরা। আবার কুৎসিত দেখতে মেয়ের সুদর্শন সুপুরুষ বরও কিন্তু দেখি।

সেক্সুয়াল সিলেকশান বা ন্যাচারাল সিলেকশান বলে বিবর্তনের যে থিওরিটি আছে, সেটি অন্যান্য প্রাণীর বেলায় খাটলেও মানুষের বেলায় ঠিক খাটে না। প্রাণী জগতে সুন্দরী সুন্দরকে বেছে নেয়। যেমন ময়ূরীকে মুগ্ধ করতে ময়ূর পেখম তুলে নাচে। ময়ূরী যার সুন্দর পেখম যে সুন্দর নাচে তাকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। কিন্তু মানুষের পছন্দ নির্ভর করে আচার ব্যবহার স্বভাব চরিত্র আত্মীয়স্বজন টাকা পয়সা ইত্যাদির ওপর। সে কারণে রূপবতী মেয়ে সবসময় রূপবান ছেলেকে পায় না।

রূপবতী আর রূপবানেই যদি মিলন হতে থাকতো শত শত বছর, তাহলে আমরা রূপে ভরপুর কেমন প্রজন্ম পেতাম জানি না। আর ওদিকে গুণবতী আর গুণবানেই যদি মিলন হতে থাকতো শত শত বছর, তাহলে জানি না গুণে ভরপুর কেমন প্রজন্ম পেতাম। এখন যা আছে তা জগাখিচুড়ি। আপাতত আমরা জগাখিচুড়ি নিয়েই খুশি।

৮. আমাদের পরিবারে ডাক্তার অনেক। কিন্তু কাছের মানুষদের আমরা কেউ বাঁচাতে পারিনি। মা’র কোলন ক্যান্সারের উপসর্গ ছিল স্পষ্ট, আমরা কেউ বুঝিনি, অথবা গ্রাহ্য করিনি। আমার ডাক্তার বাবা, আমিও ছিলাম ডাক্তার, আমিও, মা’কে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত, নিয়ে যাইনি। বাবা নিজে বড় ডাক্তার হয়েও নিজের রোগশোকগুলোকে মোটেও পাত্তা দেননি। বাবা মা দুজনই অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন।

ছোটদা যখন অসুখে পড়লো, পাশে পায়নি তার ডাক্তার মেয়েকে। আর বড়দার যখন হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে, ঘামছে, শ্বাস নিচ্ছে দ্রুত, ডায়বেটিস থাকলে বুকে ব্যথা হয় না বলে বুকে ব্যথা হচ্ছে না, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার ডাক্তার ছেলে ইনহেলার দিল, কিন্তু দিল না যেটা বড়দাকে বাঁচানোর জন্য দরকার ছিল, নাইট্রোগ্লিসারিন, অ্যাসপিরিন। অ্যাম্বুলেন্স ডাকলো দেরিতে। ‘গোল্ডেন আওয়ার’ পার হয়ে গেল। যেটা একেবারেই করতে হয় না, সেটা করলো, বড়দাকে হাঁটাচলা করতে দিল, হেঁটে হেঁটে বড়দা অ্যাম্বুলেন্সে গিয়ে উঠলো। বড়দার পুত্রধন কি সিপিআর দিতে জানে? মনে তো হয় না।

আমাদের জিন ভালো নয়। জিনে ডায়বেটিস, হাইপারটেনশান, ক্যান্সার। মা বেঁচেছেন ৫৭ বছর, ছোটদা ৫৯, বড়দা ৬৪, বাবা ৬৯। আমরা ৭০ পর্যন্ত পৌঁছোতে পারিনা। এখন সামনে আর কেউ নেই, শুধু আমি, আর আমার ছোটবোন। আমিও বাবার মতোই, ডাক্তার হিসেবে ভালো হলেও রোগী হিসেবে ভালো নই। ৬০ অবধি যেতে পারবো তো?

৯. মৌলবাদীরা যা পছন্দ করে না, তা বাংলাদেশে টিকে থাকতে পারে না। আল্টিমেট ডিসিশান মেকার তারাই। কোনও সংগঠন নয়, বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আদালত নয়, রাজনৈতিক দল নয়, সরকার নয়। মৌলবাদীরা চায় না আমি বাংলাদেশে বাস করি, তাই আমাকে বাংলাদেশে বাস করতে দিচ্ছে না বাংলাদেশ সরকার। ঠিক তেমন মৌলবাদীরা চায় না বাংলাদেশে মানবদুগ্ধ ব্যাংক চলুক, মানবদুগ্ধ ব্যাংককে সুতরাং বন্ধ হয়ে যেতে হয়। তারা চায় না সরকারের কি ক্ষমতা আছে শিশুর পুষ্টির জন্য ব্যাংকটিকে চালু করার? নেই। মৌলবাদীরা চায় না লালনের ভাস্কর্য, তাই লালনের ভাস্কর্যকে গড়ে তোলা হচ্ছে না। তাহলে বাংলাদেশের আসল সরকার কে? প্রগতিবিরোধী, নারীবিরোধী, শিশুবিরোধী, মানবাধিকারবিরোধী, ধর্ম ব্যবসায়ীরাই আসল সরকার।

            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর