শনিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বারোমাসি আমে বছরজুড়ে আয়

শাইখ সিরাজ

বারোমাসি আমে বছরজুড়ে আয়

ডিসেম্বরের শীতমাখা দিনের নরম রোদের এক সকালে এসে পৌঁছালাম ফেনীর সোনাগাজী। সোনাগাজী থেকে ২০ কিলোমিটার পথ শেষে মহুরী প্রজেক্ট। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। মনে পড়ছে খুব সম্ভবত গত শতকের আশির দশকের প্রথম দিকে, আমি তখন সানমুন ভিডিও প্রতিষ্ঠা করি। দেশে তখন বিয়ে-শাদি, সামাজিক অনুষ্ঠানের ভিডিও ধারণ ও বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু হয়েছে। বলতে গেলে আমাদের হাত দিয়েই শুরু হয়েছিল। মুহুরী প্রজেক্টের একটি অংশের নির্মাণকাজ পেয়েছিল এবিসি কনস্ট্রাকশন। তাদের হয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরির জন্য এ এলাকায় সপ্তাহখানেক থাকতে হয়। মনে পড়ছে বাঁধের ওপর থেকে পশ্চিমে সূর্য ডুবে যাচ্ছে এমন একটি দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে আমাকে পরপর তিনটি বিকাল অপেক্ষা করতে হয়েছিল। প্রথম দুই দিন ছিল মেঘে ঢাকা আকাশ, তৃতীয় দিন সে দৃশ্য ধারণ করতে সফল হই। ভাটার সময় ফেনী নদীর তীরে চিকচিকে কাদায় সূর্যের লাল আভার প্রতিফলন আর দূরে রঙিন আকাশ নদীর পানিতে মিশে গিয়ে অনন্য এক দৃশ্য তৈরি হয়েছিল। যাই হোক, সে সময় দেখেছি এ এলাকার মানুষের দুর্দশা। এক মৌসুমে সেচ না থাকায় ফসল ফলত না, আবার আরেক মৌসুমে বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যেত সব। অভাব-অনটনে এলাকার মানুষ ছিল জর্জরিত। প্রতিবেদন নির্মাণের জন্য সেই আশির দশক থেকে বেশ কয়েকবার এ এলাকায় আমার আসা-যাওয়া হয়েছে। দেখেছি কি দারুণভাবে বদলে গেছে এ জনপদ। ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের চিত্র এখন বেশ ভালোভাবেই চোখে পড়ে। এখন এখানকার পুকুরের পর পুকুরভরা মাছ। এখন দেশের সবচেয়ে বড় মৎস্য জোন হিসেবে পরিচিত এ এলাকা। এ সময়টায় হেমন্তের ধান কাটা শেষে মাঠের পর মাঠ কাটা ধানের খড় পড়ে থাকত, চাষহীন। এখন কোনো খেত আর খালি নেই। প্রতিটি খেতেই কোনো না কোনো ফল-ফসল। কোথাও শর্ষের হলুদ চত্বর, কোথাও বা বাঁধাকপির সবুজ উদ্যান, শিমের মাচা। আম, কুল আর পেয়ারার বাগানও আছে। শস্যবৈচিত্র্যে অনন্য হয়ে উঠেছে পুরো বাংলাদেশ। চার দশকের বেশি সময় ধরে চোখের সামনে বাংলাদেশের কৃষির এ পরিবর্তন আমাকে বেশ উদ্বেলিত করে। আমার গন্তব্য ওই এলাকার এক কৃষি খামারে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সোলায়মান সেখানে গড়ে তুলেছেন বিশাল এক কৃষি খামার। এর আগে বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। বছর দশক আগে বস্তাভরা পেঁপে নিয়ে আমার অফিসে হাজির। বললেন, রেডলেডি পেঁপে। ওই রকম পেঁপে আগে থাইল্যান্ডে দেখেছি। দেখতে যেমন সুন্দর, স্বাদেও মিষ্টি। যত দূর জানি মেজর সোলায়মানের হাত ধরেই রেডলেডি পেঁপে আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি মূলত মাছ ও পেঁপে চাষের জন্য সুপরিচিত। তবে এবারে তার ভিন্নরকম আয়োজন। পাঠক! সে গল্পই বলব আপনাদের। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সোলায়মান একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমরা পা রেখেছি বিজয়ের পঞ্চাশতম বছরে। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনের দ্বারপ্রান্তে। ই সময়ে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কৃষি উদ্যোগের কথাই আপনাদের শোনাতে চাই। সকালের রোদে ঝকমক করছে চারপাশ। এদিকে করোনার বালাই  নেই। মাস্ক খুলে ফ্রেশ বাতাস বুকে টানলাম। অনেক দিন পর এমন ঝকঝকে নীল আকাশ দেখলাম, যেখানে ধূলির কুয়াশা নেই, ধোঁয়া নেই। সোলায়মান সাহেবের খামারের প্রবেশপথ থেকে তাকিয়ে দেখি দূরে আকাশে উঁকি দিচ্ছে উইন্ডমিলের টারবাইনের সারি। অপরূপ দৃশ্য! এমন দৃশ্য সাধারণত বিদেশে দেখা যায়। মনে পড়ল নেদারল্যান্ডসে দেখা শত শত উইন্ডটারবাইনের দৃশ্য। চীনেও দেখেছি প্রচুর। বাংলাদেশে এমন দৃশ্য দেখে মন ভরে গেল। সোলায়মান সাহেবের খামার সবুজ এক অঙ্গন। গাছ আর গাছ। বিশাল বিশাল সব পুকুর। পুকুরের পাড়জুড়ে নারকেলের সারি, ফলের বাগান। 

শীত মানেই খেজুরের রস। আর শীতের ফল বলতে কমলা। কিন্তু এ শীতে গাছভর্তি পাকা আম যদি দেখেন তাহলে বিস্মিত না হয়ে পারবেন? বারোমাসি কাটিমন আমের কথা যারা শুনেছেন তারা হয়তো ততটা বিস্মিত হবেন না, কিন্তু সোলায়মান সাহেবের খামারে একটি অংশে গাছভর্তি আম দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। না, কাটিমন আম নয়। জাতের নাম বারি-১১। শুটিং শুরু হয়ে গেল। সমতলভূমি থেকে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার লেন্সে পুরো বাগানের দৃশ্য ধরা কঠিন কাজ। যথারীতি ড্রোন ক্যামেরার সহযোগিতা নিতে হলো। ড্রোন থেকে পাওয়া দৃশ্য স্ক্রিনে দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। সবুজে ঘেরা ছোট বাংলোর পাশে পুকুরের সারি। পুকুরের পাড় ধরে সারি সারি নারকেল গাছ যেন ওপরের দিকে উঁকি দিয়ে জানাচ্ছে সমৃদ্ধির বারতা। পাশেই বহমান ফেনী নদী। আর তার তীরে সুউচ্চ চারটি উইন্ডটারবাইন। ড্রোন ক্যামেরায় খামারের এমন চিত্র দেখে অভিভূত হলাম।

শরীরের বয়স বাড়লেও কৃষির সংস্পর্শে থেকে এখনো যেন টগবগে তরুণ সোলায়মান সাহেব। তিনিও বলছিলেন, চাকরি থেকে অবসর নিয়ে শরীর আর মন নিয়ে সুন্দরভাবে টিকে থাকতেই বেছে নিয়েছিলেন কৃষিকাজ। ১৯৮৬ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ভাবছিলেন কী করা যায়। চেষ্টা করেছেন অনেক কিছুই। কিন্তু কিছুতেই প্রশান্তি মিলছিল না। শেষে ১৯৯৩ সালে মাত্র ৬৪০ শতাংশ জমিতে পুকুর কেটে মাছ ও পেঁপে চাষ দিয়ে শুরু হয় তাঁর কৃষিজীবন। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। সময় যত গড়িয়েছে সোলায়মান কৃষিতে ততই সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। নতুন নতুন ফল-ফসল, জৈবকৃষি ও কৃষিপ্রযুক্তি বিষয়ে নানা তথ্য ও ধারণা পেয়েছেন। এসব তিনি নিজের খামারে প্রয়োগ করেছেন। অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দিয়েছেন। দিনে দিনে তাঁর খামারটি পরিণত হয়েছে ২১০ বিঘার বিশাল এক সমন্বিত কৃষি খামারে।

চারপাশ চমৎকার সাজানো গোছানো। পুকুরের চওড়া পাড়জুড়ে নানা ফলের গাছ। মাঝখানে লম্বা বড় একটি জায়গাজুড়ে ৮০ জাতের আম উৎপাদন হয়। যেখান থেকে গত আমের মৌসুমেও ২২ টন আম পেয়েছেন। এ আম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে উন্নত জাতের নারকেল গাছ। বড় ২২টি পুকুর। ৩৩ একর জলায়তনের পুকুর আর ফলফলাদির বাগান দেখে যে কেউ একে পার্কও ভাবতে পারেন। সোলায়মান বলছিলেন এ করোনার সময়টাতে ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে বেশ ভালোই সময় কাটছে তাঁর খামারে। মিষ্টি এক শিশু আয়েশা। সোলায়মান সাহেবের নাতনি। বয়স আট-নয় বছর। সেও জানাল শহরের চেয়ে সবুজ প্রকৃতির এ চত্বরই তার প্রিয়। এখানে আয়েশার প্রিয় জিনিসগুলোর একটি হয়ে উঠেছে বারি-১১ আম।

সোলায়মান সাহেবের বারি-১১ জাতের আম গাছ আছে ৭০টি। মাত্র পাঁচ বছর বয়স এসব গাছের। প্রতিটি গাছে সব বয়সী আমের দেখা মিলছে। পাতার ভাঁজে ভাঁজে আম, গুটি, মুকুল মিলে অন্যরকম এক উৎপাদন সাইকেল। একই গাছে আমের মুকুল, গুটি আম, কাঁচা আম, পাকা আম। মুকুল থেকে গুটি আম হচ্ছে, গুটি আম বড় হচ্ছে, কোনো আমে পাক ধরেছে। বছরজুড়েই গাছে এ ফল উৎপাদনের সাইকেল। গাছে আম নেই, বছরের কোনো সময়ই এমনটি হয় না। সোলায়মান সাহেব খুলে বললেন তাঁর আমজয়ের গল্প। ২০০৮ সালে মালয়েশিয়া-প্রবাসী এক বন্ধুর কাছ থেকে সংগ্রহ করেন বারোমাসি লুবনা জাতের সায়ন। সেখান থেকে উৎপাদন করেন চারা। চারা থেকে গাছ। গাছ থেকে ফল। অমৌসুমে এমন সৌরভভরা মিষ্টি আম আগে কখনো দেখেননি। সে লুবনা জাতের আমটির চারা তিনি দিয়েছিলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে। সে চারাটিই উন্নত হয়ে নাম হয়েছে বারি-১১।

বারি-১১ আম সৌরভে, মিষ্টতায়, স্বাদে অসাধারণ! যার বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও ব্যাপক বলছিলেন উদ্যোক্তা। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের কাছে সুলভমূল্যে বছরব্যাপী সুমিষ্ট আম পৌঁছে দিতে পারাটাই তাঁর কাছে বড় এক অর্জনের মতো। সফল একজন আমবাগান উদ্যোক্তা হিসেবে মেজর সোলায়মানের সাম্প্রতিক কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তিনি বলছেন, ফলের প্রাচুর্য দেখে না জেনে বুঝে কেউ যেন বড় বিনিয়োগে বাগান গড়তে না যান। তাঁর হিসাবে আমবাগান একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। সঠিক চারা যাচাই-বাছাই থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা।

আমের স্বাদ নেওয়ার সৌভাগ্য হলো। সত্যিই স্বাদে অনন্য। বেশ মিষ্টি। একই গাছে মুকুল ও ফল ঝুলছে। গাছ থেকে আম পেড়ে ওজন করলাম। দুটি আমের ওজন হয় এক কেজির ওপরে। বাগান থেকেই আম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। পাইকাররা ৪০০ টাকা কেজি দরে আম কিনে নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করেন বলে তিনি পাইকারদের কাছে আম বিক্রি করেন না। পাইকাররা ৪০০ টাকা কেজি দরে কিনে নিয়ে ১ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করেন। এটা তার পছন্দ নয়। তিনি অনলাইনে ও তাঁর বাগানে আসা ক্রেতাদের কাছে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন আম। তিনি বলেন, সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে বারি-১১-এর মতো উন্নত জাতের আম উৎপাদন করে দেশীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। সারা দেশেই এখন কমবেশি বারোমাসি আম বারি-১১ জাত দেখা যাচ্ছে। দুই বছর আগে চুয়াডাঙ্গার আবুল কাশেমের বাগানেও দেখেছি কাটিমন জাতের আমের পাশাপাশি বারি ১১ জাতের আম। আবার কয়েক দিন আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে রফিকুল ইসলামের আমবাগান নিয়েও প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম চ্যানেল আইয়ে। সেখানেও বারি-১১ জাতের আম রয়েছে। তবে ফেনীর এ সমৃদ্ধ বাগানের মালিক দাবি করছেন, কৃষক পর্যায়ে তাঁর বাগানেই প্রথম আলোর মুখ দেখে বারি ১১ জাতের আম।

মেজর (অব.) সোলায়মান তাঁর বাগানের ৭০টি গাছের উৎপাদন নিয়ে যে হিসাব তুলে ধরছেন তাতেই বোঝা যায় এ জাতটির বাণিজ্যিক গুরুত্ব কতখানি। মেজর সোলায়মান আনন্দের সঙ্গে জানালেন, ৭০টি বারি-১১ জাতের আম গাছ থেকেই বছরে ২৬ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। প্রতিটি গাছ থেকে কমপক্ষে ১০০ কেজি আম পাওয়া যায়। ৪০০ টাকা কেজি ধরে একটি গাছ থেকে আসে ৪০ হাজার টাকা। ৭০টি গাছ থেকে আসে ২৮ লাখ টাকা। আনুষঙ্গিক খরচ ২ লাখ বাদ দিলে ২৬ লাখ টাকা লাভ খুব কঠিন বিষয় নয়।

আজকের দিনে কৃষি সাফল্য মানেই অর্থনৈতিক সাফল্য। উন্নতমানের ফল-ফসলের সঙ্গে ‘উচ্চমূল্য’ কথাটি অপরিহার্যভাবে যুক্ত। এ উচ্চমূল্যই কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তার উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে ফল-ফসল উৎপাদনে যেসব সাফল্যচিত্র উঠে আসছে তা দেখে অনেকেই আমার সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করছেন। গড়ে তুলতে চাইছেন বাগান। এ ক্ষেত্রে বলতে চাই- কৃষি উদ্যোগের সঙ্গে উদ্যোক্তার আন্তরিকতা যেমন জরুরি, একইভাবে জরুরি বীজ বা চারার সঠিক নির্বাচনসহ অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা। এ কথাটিই বারবার বলেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত মেজর সোলায়মান। আমি বিশ্বাস করি তাঁর এ উদ্যোগ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের তরুণ উদ্যোক্তা ও নতুন কৃষককে দারুণভাবে উজ্জীবিত করবে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের, দেশ সমৃদ্ধ হবে ফল-ফসলে, পূরণ হবে মানুষের পুষ্টির চাহিদা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর